দানবের মৃত্যু:গুঁটিবসন্ত নির্মূলকরণের সেই কালজয়ী উপাখ্যান

Small Pox Girl
১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে গুটি বসন্ত আক্রান্ত মেয়ে

ছোটবেলায় মা বাবার কাছে গল্প শুনতামদানবের গল্পদানবরা মানুষের রাজ্য আক্রমন করেরাজকুমাররা সেই দানবকে হত্যা করে মানুষকে বাঁচায়
সেটা ছিল রূপকথার দানব
আরেকটি দানবের গল্প শুনতাম 
সেটা আজ থেকে ৪০ বছর আগেও ছিল
কোন গ্রামে তা যদি কোন বাড়ি আক্রমন করত সেই বাড়িতে কান্নার রোল পরে যেতআশেপাশের মানুশ হয়ে পড়ত শঙ্কিত
দানবের আগমনে পুরো গ্রাম বিলীন হয়ে যেত
কখনও বিশাল জনপদকেউ ছিল না তাদেরকে বাঁচাতেঅবশেষে এলো এক রাজকুমারএক বীরনতুন সাজে সজ্জিত হয়ে দানবের সাথে যুদ্ধ করতএবং অবশেষে সেই দানব মারা গেল

সেই দানবের নাম গুটি বসন্ত এবং সেই রাজকুমারের নাম আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান

গুটি বসন্ত বা Small Pox একটি ভাইরাস জনিত রোগভাইরাসটির দুটি Strain আছে Variola major and Variola minorলাতিন ভাষায় রোগটিকে Variola অথবা Variola vera বলা হয়এ কথাটি এসেছে লাতিন Varius থেকে যার অর্থ গুটিSmall pox শব্দটি প্রথম ১৫ শতাব্দীতে ইউরোপ মহাদেশে ব্যবহার করা হয়েছিল great pox বা সিফিলিস হতে একে আলাদা করতে

এটি বিশ্বের একমাত্র রোগ যেটিকে নির্মূল করা সম্ভব হয়েছেগুটি বসন্ত নিশ্বাস প্রশ্বাসের মাধ্যমে অথবা সরাসরি স্পর্শের সাহায্যে ছড়াতএই রোগের ভিক্তিমদের শরীরে বিশেষ করে মুখে এবং হাতে অসংখ্য গুটি দেখা দিতমারা যাওয়ার হার ছিল ৩০-৭৫%১ বছরের শিশুদের ৪০-৫০% মারা যেতবিভিন্ন অঙ্গে ইনফেকশন দেখা দিতHeart Failure, Pulmonary Edema তে রোগী মারা যেতজ্বর হওয়ার ৬ দিনের মধ্যেই রোগী মারা যেতশেষ দিকে অণুচক্রিকা ও দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যেত

শ্বসনতন্ত্রে ব্রঙ্কাইটিস থেকে শুরু করে নিউমোনিয়া হতমস্তিষ্কের প্রদাহ হতমুখে গুটি চেহারাই পরিবর্তন করে দিতচোখে গুটি হলে চোখ নষ্ট হয়ে যেত

মানব জাতির আদি লগ্ন থেকে রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়৩০০০ বছর আগের মিশরীয় মমির শরীরে গুটি বসন্তের চিহ্ন পাওয়া গেছেভাইরাসটি প্রথম পৃথক করে কালচার করতে পারেন ১৫০০ অব্দে ভারতের চিকিৎসকরা

গুটি বসন্তের জীবাণু সমৃদ্ধ ভায়াল 
গুটি বসন্তের জীবাণু সমৃদ্ধ ভায়াল

১৫০০ অব্দে ভারতে এটা ধারনা করা হয় মিশরীয় বনিকরা ভারতীয় উপমহাদেশে রোগটি নিয়ে আসে১ম শতকে এটি চীনে যায়ষষ্ঠ শতকে এটি জাপানে যায়৭৩৫-৭৩৭ এর ভিতর গুটি বসন্তের মহামারীতে জাপানের তিনভাগের একভাগ মানুষ মারা যায়হিপক্রাটাসের বর্ণনায় রোগটি নেইএ থেকে ধারণা করা হয় ঐ আমলে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে রোগটি হয়ত ছিল নাকারো কারো মতে আরবরা যখন স্পেনসহ ইউরোপ আক্রমণ করে তখন তাদের মাধ্যমে রোগটি ইউরোপ অঞ্চলে যায়

পারস্যের বিখ্যাত বিজ্ঞানী মোহাম্মাদ বিন জাকারিয়া আল রাজী ৯ম শতকে তার Kitab fi al-jadari wa-al-hasbah (The Book of Smallpox and Measles) বইতে গুটি বসন্তের প্রথম সুন্দর উপস্থাপন করেনতিনিই প্রথম হাম ও জলবসন্তের থেকে এর ব্যবধান করেনক্রুসেডের সময় ইউরোপ এ রোগটি ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পরেএরপর বিভিন্ন জায়গায় ইউরোপিয় দের গমনের ফলে রোগটি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পরেস্প্যানিশদের মাধ্যমে ১৫০৭ সালে ক্যারিবিয়ানে এবং ১৫২০ সালে উত্তর আমেরিকার মুল ভুখণ্ডে রোগটি ছড়িয়ে পরেইনকা ও অ্যাজটেকরা শত শত মারা যায় এই রোগে১৬৩৩ এ রেড ইন্ডিয়ানরা মহামারীতে মারা যায়১৭৮৯-১৮২৯ এর ভিতর তা অস্ত্রালিয়াতে ছড়িয়ে পরেঅস্ত্রেলিয়ান আদিবাসীরা শয়ে শয়ে মারা যায় 

১৮৫৩ সালে হাওয়াই তে গুটি বসন্ত নির্মূল হাসপাতাল
১৮৫৩ সালে হাওয়াই তে গুটি বসন্ত নির্মূল হাসপাতাল

অবশেষে বিজ্ঞানীরা এই মহামারী রোধে এগিয়ে আসেনগুতি বসন্তের জীবাণুর বিরুদ্ধে টিকা বানানোর সফলতা আসে ৫ কারনেঃ
ভাইরাসটির ছিল একটি মাত্র সেরোটাইপ
শুধু মানুষ বাহক, প্রাণীরা নয়
এর বিরুদ্ধে এনটি বডির কার্যক্ষমতা দ্রুত হয়
লক্ষণ দেখেই রোগটি চিহ্নিত করা যায়এবং সেইমতো দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া যায়
রোগটি গুপ্ত থাকে না

১৭৯৬ সালে এডঅওার জেনার গোবসন্ত আক্রান্ত নারীর পুঁজ মানবদেহে ঢুকিয়ে দেখেন এতে জীবাণু প্রতিরোধ করা যায়

১৮০৩ সালে স্প্যানিশরা তাদের উপনিবেশগুলিতে টিকাদান কর্মসূচী চালু করেব্রিটিশরা ভারতে টিকা দান কর্মসূচী চালু করেনমিয়ানমারে অশিক্ষিত জনগণ টিকা নিতে অসম্মতি জানায়
১৮৫৩ তে আইন করে ব্রিটেনে টিকা গ্রহন বাধ্যতামুলক করা হয়
১৮৯৭ এর ভিতর আমেরিকা হতে এই রোগ প্রায় নিরমুল হয়ে যায়১৯৫০ এর মাঝামাঝিতে টিকাদান কর্মসূচি জোরেসরে শুরু হয়কোথাও রোগ দেখা গেলে রিং ভাক্সিনাসনের মাধ্যমে রোগটি ছড়িয়ে পড়া বন্ধ করে দেয়া হয়রিং ভাক্সিনাসনের পদ্ধতি ছিল যে জনপদে গুটি বসন্ত দেখা দিবে তার আশেপাশের সবাইকে টিকা দিতে হবেসোভিয়েত ও আমেরিকানরা প্রথমে টিকাদান কর্মসূচিতে অর্থ সাহায্য করতপরে ১৯৭৩ এর ভিতর ৮০% দেশেই টিকা উৎপাদন শুরু হয় 

১৯১২ সালে আমেরিকাতে গুটি বসন্তের রোগী
১৯১২ সালে আমেরিকাতে গুটি বসন্তের রোগী


১৯৭২ সালে যুগোস্লাভিয়াতে সর্বশেষ মহামারীটি দেখা দেয়কসভর এক তীর্থযাত্রী মধ্যপ্রাচ্য থেকে আক্রান্ত হয়তার মাধ্যমে বলকানে রোগটি মহামারী আকারে দেখা দেয়১৭৫ জন আক্রান্তের ভিতর ৩৫ জন মারা যায়কোয়ারেনটাইনের মাধ্যমে এবং টিকাদানের মাধ্যমে রোগটি নিয়ন্ত্রণে আসে 


আধুনিক ভায়াল
আধুনিক ভায়াল

১৯৭৭ এর ভিতর হর্ন অফ আফ্রিকা ছাড়া আর সব অঞ্ছল থেকে গুটি বসন্ত নির্মূল হয়ে যায়Variola minor এর সর্বশেষ ঘটনা রেকর্ড করা হয় ১৯৭৭ সালের ২৬ অক্টোবরসমালিয়ার এক হাসপাতালের পাচক আলি মাও মালিন নামে এক ব্যক্তি আক্রান্ত হয়Variola major এর সর্বশেষ কেস পাওয়া যায় ১৯৭৫ এর অক্টোবরে বাংলাদেশের ভোলা দ্বীপের কুরালিয়া গ্রামেরহিমা বানু নামে ২ বছরের এক মেয়েWHO টিম আসে এবং বানুকে সুস্থু করে তুলে


১৯৭৫ এর অক্টোবরে রহিমা বানু
১৯৭৫ এর অক্টোবরে রহিমা বানু

১৯৭৯ সালের ৯ ডিসেম্বর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গুটি বসন্ত নিরমুল্করনের সনদপত্র দেয়১৯৮০ সালের ৮ মে ঘোষণা আসে,


Having considered the development and results of the global program on smallpox eradication initiated by WHO in 1958 and intensified since 1967 … Declares solemnly that the world and its peoples have won freedom from smallpox, which was a most devastating disease sweeping in epidemic form through many countries since earliest time, leaving death, blindness and disfigurement in its wake and which only a decade ago was rampant in Africa, Asia and South America.”

—World Health Organization, Resolution WHA33.3

১৯৬০ ও ১৯৭০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টার রোগ নিয়ন্ত্রন কেন্দ্রের মহামারী রোগ বিশারদ ডাঃ ডি এ হেন্ডারসনের পৃথিবী থেকে গুটি বসন্ত দূর করার অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেনএ সম্পর্কে তিনি একটি বই লিখেছেন- নাম হলো Small Pox, The death of a Disease – গুটি বসন্ত-একটি রোগের মৃত্যুগণ স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে তাঁর কাজের বহু অভিজ্ঞতা তিনি এই গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন
১৯৬৭ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গুটি বসন্ত নির্মূল করার অভিযানে নেতৃত্ব দেয়ার গুরু দায়িত্ব ডঃ হেন্ডারসনের ওপর অর্পণ করেছিলো
সেই অভিযান সফল হয়েছিলো এবং বিশ্ববাসী মূত্যু ও যন্ত্রনার সঙ্গে লড়াইয়ে আরো একবার বিজয়ী হলোবিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৮০ সালে পৃথিবী গুটি বসন্ত মুক্ত বলে ঘোষণা করে
ডঃ হেন্ডারসনের আরেকটি কীর্তি – যদি গুটি বসন্তের রোগ জীবানু সন্ত্রাসী হামলার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয় তাহলে তার জন্য প্রস্তুতি গ্রহন
তিনি মেরীল্যান্ড রাজ্যের বাল্টিমোর বন্দর নগরীতে প্রতিষ্ঠা করেন Center for Bio-securityএর প্রস্তুতি স্বরূপ ডঃ হেন্ডারসনের দল ১৮ মাসে ২০ কোটি টীকা বানানোর কাজ সম্পন্ন করেতিনি বলেন মানুষের জীবন বাঁচানোর ভাবনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁর দল এত দ্রুত কাজ করতে পেরেছিল 


Global Smallpox Eradication Program তিন সাবেক পরিচালক গুটি বসন্তের নির্মূলের ঘোষণা দিচ্ছেন
Global Smallpox Eradication Program তিন সাবেক পরিচালক গুটি বসন্তের নির্মূলের ঘোষণা দিচ্ছেন

বাংলাদেশ হতে গুটি বসন্তের নির্মূলকরণে মরহুম ডাঃ কাজী আবুল মনসুরের ভূমিকা অনস্বীকার্যডাঃ কাজী আবুল মনসুর উদরাময় আক্রান্ত রোগী হতে কলেরা রোগের জীবাণু (ভাইব্রিও কলেরা) দ্রুত সনাক্ত এবং পৃথকীকরণের জন্য একটি বিশেষ মিডিয়া উদ্ভাবন করেন যা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে ৷ এ মিডিয়াটি “মনসুর মিডিয়া” নামে সুপরিচিত ৷ তিনি ইনষ্টিটিউট অব পাবলিক হেল্থ-এর পরিচালক থাকাকালীন সময়ে স্হানীয়ভাবে প্রস্ত্তত গুটি বসন্তের টিকার উন্নতি সাধন করে দেশ হতে গুটি বসন্ত নির্মূল অভিযানে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন ৷ বাংলাদেশের ইনষ্টিটিউট অব পাবলিক হেল্থ এর আই, ভি ফ্লুইড প্ল্যান্ট স্হাপনের তিনিই পথিকৃত, যা বর্তমানে বত্সরে বিশ লক্ষ ব্যাগ স্যালাইন তৈরী করছে এবং বাংলাদেশের সকল হাসপাতালে এগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে ৷

লেখকঃ ডা রজত দাশগুপ্ত

rajat

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

MS residency in Dentistry : জানার আছে অনেক কিছু

Wed Aug 10 , 2016
পোস্ট গ্রাজুয়েশনের জন্য বর্তমান বিশ্বে চলমান কোর্স গুলোর মধ্যে Residency কোর্স সবচেয়ে বেশী সমাদৃত ও জনপ্রিয়। অন্যসব কোর্স / ট্রেনিং এর সাথে এর বেসিক যে পার্থক্য সেটা হলো, এখানে দেশ ভেদে ৫ থেকে ৮ বছর একটা হাসপাতালের অধীনে থেকে ট্রেনিং করতে হয় আর ট্রেনিং এর প্রশিক্ষকই আপনার পরীক্ষক যিনি আপনাকে […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo