কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প || পর্ব ৩

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৪ শে জুলাই, ২০২০, শুক্রবার

অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া
চিকিৎসক, কাউন্সিলর
ফিনিক্স ওয়েলনেস সেন্টার বাংলাদেশ

মেয়েটার বাবা একটা বেসরকারি অফিসে চাকরি করেন। এই ক্রান্তিকালের আঁচ লেগেছে ওদের মা-বাবা আর নিজেকে নিয়ে গোছানো ছোট্ট ছিমছাম সংসারেও।

ঠিকা বুয়া বিদায় হয়েছে বেশ কিছু দিন থেকে। মা তাই অবিশ্রান্ত ব্যস্ত ঘরের কাজে। সারাদিনে ঘরে কত যে অদৃশ্য কাজ থাকে একজন গৃহকত্রীই শুধু সেটা বুঝতে পারেন।

এইদিকে বেতন কমে গিয়েছে বলে বাবার কপালে চিন্তার রেখা, বাবার হোম অফিসের সময় অফিসের সম্ভাব্য ছাটাইয়ের গুঞ্জন কিছুই চোখ এড়ায় না মেয়েটার।

এই করোনাকালীন সময় স্কুলে অনলাইনে ক্লাস হচ্ছে কিন্তু ওর বহু পুরাতন সেই কোনা ভাঙা ট্যাবে সাউন্ড আসলে ভিডিও আসে না। বাসায় একটাই ল্যাপটপ সেটা বাবার দখলে!

মেয়েটা একবার ভাবে বাবাকে অনলাইন ক্লাসের জন্য নতুন কম্পিউটার চাইবে, আবার ভাবে এতোগুলি টাকা এই দুর্দিনের বাজারে খরচ করাবে? বাবার চাকরি চলে গেলে কি হবে? অথচ কিছুদিন আগেও কিন্তু ওর ভাবনায় ছিল রোজার ঈদে বিদেশে কই ঘুরতে যাবে।

 

এরপর সেই পুরাতন কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প۔ 

নিঃসঙ্গতা কমাতে মেয়েটি নিজ ভুবনে জীবনযুদ্ধে ব্যস্ত বাবা-মা’র থেকে  আস্তে আস্তে যতটা দূরত্ব বেড়েছে পাল্লা দিয়ে ঠিক ততোটাই বেড়েছে ভার্চুয়াল ফ্রেন্ডের সংখ্যা।

 

মা সারাদিনে নানান কাজের ফাঁকে ফাঁকে মেয়ের দিকে উঁকি দিয়ে ভেবেছেন যাক মেয়ে তো নিজের মনেই আছে নিরাপদ ঘরের কোনে। অথচ আজন্ম তুলু তুলু  ভাবে বেড়ে ওঠা অসূর্যস্পর্শা মেয়েটি যে কত ভিডিও চ্যাট বা ইনবক্সে ছবি শেয়ারের অফার পেলো একই  ছাদের নিচে কেউ জানলো না!

তারপর গৎবাঁধা সাইবার বুলিং-এর খেলা হয় টাকা দাও নাইলে ছবি ভাইরাল করে দেব। 

মা চোখে পানি নিয়ে বলেন, ” আপা, কি  করি নাই মেয়ের জন্য? নিজের ভালো চাকরিটা পর্যন্ত ছেড়েছি, সেটা কি এই দিনের জন্য?”

মেয়ে আপাত রাগ আর ভিতরে অসহায়ত্ব নিয়ে বলছে , ‘আমাকে বাবা-মা কেউ বোঝে না!”

বাবা উদ্ভ্রান্তের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছেন সামাজিক মানসন্মান বাঁচিয়ে এই জিম্মি দশা থেকে মুক্তির উপায়!

 বাবা-মা’র সাথে খোলাখুলি হতাশা, কষ্ট, আনন্দ বেদনাগুলি ভাগ করে নেয়া এই কঠিন সময়ে অনেক বেশি প্রয়োজন। সেই সুযোগটা দিতে বড়দেরই একধাপ এগিয়ে আসতে হবে। বাচ্চাদের মাথায় আস্তে আস্তে ঢুকিয়ে দিতে হবে পরিবারের থেকে বেশি কেউ কিন্তু আমার বিপদে এগিয়ে আসবে না। এর জন্য প্রয়োজন বাবা মা’ র, দরকার নন জাজমেন্টাল হয়ে বাচ্চাদের কথাগুলি শোনা। কথায় কথায় বাচ্চাদের  উপদেশ দেবার দরকার নেই। ওকে ওর মতো শিখতে দিন। ও আলাদা মানুষ, ওর ভালো লাগা মন্দ লাগা একদম আলাদা। সেটা আমি বাবা বা মা বলে আমার ঘড়ি ধরে চলে না।

বড়দের ভুবনে অনেক মানুষ তাই ঠেকে ঠেকে শিখেই আস্তে আস্তে বড়দের অভিজ্ঞতার ঝুলি সমৃদ্ধ হয়। অন্যদিকে  বাচ্চাদের পৃথিবীতে মানুষ হাতে গোনা। ভুল তাঁরা করবে এটাই স্বাভাবিক। আসুন বাচ্চাদের ছোট ছোট ভুল করবার সুযোগ দেই এতে ৩ টা লাভ হবে-

১. ভুল থেকে ঠেকে নিজে নিজেই শিখবে, তাই পরেরবার এই ভুল করবে না।

২. আপনার জানার মধ্যে নতুন কিছু করতে যেয়ে ভুল করছে, যেহেতু আপনি জানেন এর মাশুল বাচ্চার জন্য অনেক পেইনফুল না, তাই সেই কাজটা ওর ইচ্ছা মতো করবার সুযোগ দিলেন নন জাজমেন্টাল ভাবে। ফলে আপনার সাথে তার আস্থার জায়গা মজবুত হবে। 

৩. বড় কোন বিপদে পড়বার আগেই আপনি তাকে সতর্ক ও প্রয়োজনে রক্ষা করতে পারবেন।

বাচ্চাদের মতামতের ভিন্নতাকে সন্মান করুন। এতোদিন যদি এভাবে না ভাবি আজ থেকে ভাবতে দোষ কি?

যাঁরা অন্যদের ভিন্নতা কে নিজের মতের অমিল থাকা স্বত্বেও বিচারকের দৃষ্টিতে ঠিক বেঠিকের তুল্যদন্ডে বিচার করেন না, তাঁদের জন্য অনেক ভালোবাসা। কারণ আমিই যে সবসময় সঠিক এটা কে বললো?

Sadia Kabir

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে ব্যক্তিগত কিছু অভিজ্ঞতা

Fri Jul 24 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৪ জুলাই ২০২০, শুক্রবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নিয়ে আমরা অনেকের কাছ থেকেই অনেক কিছু শুনতে পাই, এবারে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা জানালেন এডভোকেট এম আর খান সবুজ। এডভোকেট এম আর খান সবুজ বলেন, কিছুদিন আগে আমার ছোট বোনের স্বামী মারা যায় […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo