বিজ্ঞান ও বিস্ময়ঃ পর্ব-০২।। যে হাসিতে মৃত্যু হয়

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৪ আগস্ট ২০২০, সোমবার

ডা. আসির মোসাদ্দেক সাকিব
ডেন্টাল সার্জন,
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ

হাসি স্বাস্থ্যের জন্য ভালো হলেও অট্টহাসি অনেক সময় ক্ষতিকর হয়, এমনকি মৃত্যুর কারণ পর্যন্ত হয়। ভয়াবহ রকমের এ হাসিকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে “ম্যালিগন্যান্ট লাফিং” বা “প্যাথোলজিক্যাল লাফিং” বলে।

ইতিহাসে এরকম ভয়াবহ অট্টহাসিতে মারা যাবার বেশকিছু ঘটনা আছে। কয়েকটি বলা যায়ঃ

১) ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লস খুব খেয়ালী রাজা ছিলেন। অনেকে ভাবতো তিনি রাজা হবার যোগ্য নন। রাজা তার প্রথম স্ত্রীকে খুব ভালোবাসতেন। কিন্তু পরপর ৪ টা বাচ্চা মারা যাওয়াতে, তিনি রুষ্ট হয়ে আরো ৭ টি বিয়ে করেন। এরপর ১৩ টি বাচ্চার বাবা হন ৩ বছরের ভেতরেই। তবে প্রথম স্ত্রীকে তিনি এতই ভালোবাসতেন যে স্ত্রীর যৌনস্থানের লোম (pubic hair) তিনি একটা থলেতে জমিয়ে রাখতেন এবং এগুলো দিয়ে পরচুলা বানিয়ে পড়তেন নিজের মাথায়। এরকম খেয়ালী রাজার সিংহাসনে আরোহণের কথা কানে গেল বিখ্যাত স্কটিশ বহুমাত্রিক জ্ঞানী থমাস আর্কুহার্টের। এই ঘটনায় আর্কুহার্ট এত মজা পেলেন যে প্রচন্ড এক হাসি দিলেন। সে এমন এক হাসি যা আর শেষ হচ্ছেই না। হাসতে হাসতে আর্কুহার্ট, হার্ট ফেইলিউর হয়ে ওখানেই মারা গেলেন।

২) মিশরের রাণী ক্লিওপেট্রার এক সখী ছিল। ইতিহাস তার সঠিক নামটি মনে রাখেনি। এই সখী তার স্বামীর সাথে সারাক্ষণ ঘ্যানর ঘ্যানর করতো। ক্লিওপেট্রা এই ব্যাপারে জানতেন। একদিন এক রাজনৈতিক কারণে মারামারিতে সেই সখীর স্বামীটি মারা যায় এবং এই সংবাদ ক্লিওপেট্রা তার সখীকে নিভৃতে ডেকে বলে। সখী এই ঘটনায় এত খুশি হয় যে সে প্রচন্ড রকমের হাসি দেয় ও হাসতে হাসতে মারা যায়।

৩) গ্রিক পেইন্টার জিওক্সিস একবার দেবী আফ্রোদিতির মডেল খুঁজছিলেন। এক বুড়ি মডেল হিসেবে রাজি হলেন। ছবি কম্পলিট হবার পরে নিজের হাতে আঁকা ছবি দেখে ওনার এত হাস্যকর লাগলো, হাসতে হাসতে মারা গেলেন জিওক্সিস!

৪) গ্রিক দার্শনিক ক্রিসিপাস তার পালিত গাধাকে একদিন ইচ্ছা করে অভুক্ত রেখে দিলেন। পরদিন দরজা খুলে দেখলেন ওই গাধা বাসার সামনে মানুষের ফেলে যাওয়া কাঠ বাদামের মত এক প্রকার বাদাম চিবুচ্ছে, যা সাধারণত গাধারা খায় না। এই ঘটনায় তার খুব হাসি পায় ও হাসতে হাসতে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যায়।

এই গেলো উদাহরণ, এবার দেখি এটার ব্যাখ্যায় বিজ্ঞান কি বলে?
আমাদের কোন হাসি শুরু হলে সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আমাদের মস্তিস্কে একটা জটিল প্রক্রিয়া চলে। এটার জন্য অতিরিক্ত অক্সিজেন প্রয়োজন হয়। হঠাৎ কেউ প্রকাণ্ড দীর্ঘ অট্টহাসি দিলে, আমাদের নাক ও ফুসফুস সেই অতিরিক্ত অক্সিজেন টেনে নেবার ফুরসৎ পায় না। এই হাসি সামলানোর জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেন না পেলে আমাদের মস্তিষ্কে ক্যাটাপ্লেক্সি (cataplexy) নামের একটা ঘটনা ঘটে। এটি আমাদের মাংসপেশিকে হঠাৎ অবশ করে দিবে এবং পুনরায় শ্বাস নেবার মত আর শক্তি পাওয়া যাবে না। এই চক্র শুরু হলে দেহে ক্রমশ আরো অক্সিজেন ঘাটতি হবে। এর ফলে আমাদের মধ্য মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস নামক অংশটি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর ফলশ্রুতিতে একটি বিশেষ ধরনের খিঁচুনি শুরু হবে। একে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় জেলাসটিক সিজার (gelastic seizure) বলে। এই খিঁচুনির ফলে আপনার মস্তিষ্কের পনস, মেডুলা আর সেরেবেলাম নামক অংশগুলো আর কাজ করবে না অথবা অস্বাভাবিক সংকেত পাঠাবে মাংশপেশিতে। এই ভুলভাল সংকেত পেয়ে আমাদের হৃদপেশী এক মিনিটের ভেতরেই অচল হয়ে পড়বে, যার একমাত্র ফলাফল হবে- কার্ডিয়াক এরেস্ট। অর্থাৎ আমাদের হৃদপিণ্ড কোনপ্রকার রোগ ছাড়াই স্তব্ধ হয়ে যাবে।

চিকিৎসা বিজ্ঞানে আরো বলা হয় যে, বিভিন্ন রকম রোগের বা আঘাতের কারণে আমাদের মস্তিস্কে ইমোশন নিয়ন্ত্রণ করার জায়গায় সিউডো বাল্বুলার এফেক্ট (Pseudobulbar Affect) নামের একটা গোলযোগ দেখা যায়। এই এফেক্টের ফলে সেই লোকেরা হাসি বা কান্না কোনটাই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এই ধরনের লোকেদের অট্টহাসিতে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই হাসি হৃদপিন্ডের স্বাস্থ্য ভাল রাখে বলা হলেও, অনেকের জন্য হঠাৎ অট্টহাসি খুবই খারাপ।

Md. Nafiul Islam

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

দ্বিতীয়বার ভাবার সময় হয়ত এসে গেছে

Tue Aug 25 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৫ আগস্ট, ২০২০, মঙ্গলবার ডা. নূর ইসরাত আইসিইউ মেডিকেল অফিসার, কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারী হাসপাতাল। নিচের এ ছবিগুলো মে, ২০২০ এর। আমরা একবার আমার প্রথম পোস্টিং প্লেস পঞ্চগড় থেকে বাসায় এসেছি অনেক কাহিনী করে অনেক মাস পর। লকডাউন থাকায় কয়েকজন কলিগ মিলে ভাড়া করা মাইক্রোবাসে ১১ ঘন্টা জার্নি […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo