লাইফ ইন লকডাউন, ডে সিক্সটি ফোর

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৯ জুন ২০২০, মঙ্গলবার
ডা. শুভদীপ চন্দ

সাধারণত যে লোক গুলো নিঃসঙ্গ হয় তারা খুব ভাল গল্প বলতে পারে। আমার এক বন্ধু আছে এমন। সরকারি ডাক্তার, বিবাহিত, প্র‍্যাক্টিস ফ্যাক্টিস করে না। অনেক পড়াশোনা- গল্প কবিতা উপন্যাস সিনেমা, এমনকি অনেক বিখ্যাত’র ব্যক্তিজীবন। কথা বলতে তার কিছু লাগে না। কয়েকটি বেনসন আর এক জোড়া উত্তম কান হলেই যথেষ্ট। সে নিজে কিছু লিখেছে ফেসবুকে বা কবিতায়। সেগুলো পড়তে ভাল লাগে না। তার মুখে গল্প শুনতে ভাল লাগে। গল্প শুনি।

সে-ই আমাকে মার্ক টোয়াইনের সে গল্পটির কথা বলেছিল। একই সাথে দুই শিশুর জন্ম হয়। একজন প্রিন্স ওফ ওয়েলস, নাম টিউডর। সারা ইংল্যান্ডের মানুষ তার জন্য অপেক্ষা করছিল। তার জন্মের খবরে শহরে আনন্দের বাধভাঙ্গা উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়ে। লন্ডনাইটসরা গান গায়, বাদ্য বাজায়, আনন্দে জড়িয়ে ধরে, কিস করে, আবেগে কান্না করে। কয়েকদিন সরকারি ছুটি ঘোষিত হয়। সারাদিন সারারাত জন্মোৎসব। বড় বড় লর্ড আর লেডিরা মুগ্ধ চোখে সদ্যোজাত শিশু দেখেন। অন্যদিকে বস্তিতে আরেক শিশুর জন্ম হয়। নাম টম ক্যান্টি। বাবা পাঁড়মাতাল চোর, দিদিমা ভিক্ষুক। মা ভয়ংকর ভাবে অশিক্ষিত। জমজ দুই বোন ভিক্ষুক। সে পৃথিবীতে আসুক- কেউ চায় নি, কিন্তু সে এসে পড়ে। সংসারে আরেকটি পেট বাড়ায়। গাদাগাদি করে তারা এক ঘরে শোয়। টমের বাবা মা একপাশে ছোট বিছানায় ঘুমায়, আর তারা বড় মেঝেতে হাত পা ছড়িয়ে ঘুমায়।

যতদিন ঢাকায় ছিলাম এ গল্পটি খুব মনে পড়তো। রাস্তায় আমাদের আটকে দিত, সাঁই সাঁই করে ভিআইপি গাড়ি পাস হতো। একটি দুইটি তিনটি পনেরোটি বিশটি- অসংখ্য। উল্টো দিকে চেয়ে থাকতে হয় নইলে পুলিশ দুর্ব্যবহার করে। গাদাগাদি করে আমরা ঢাকাবাসী সাইরেন শুনি আর ঘড়ি দেখি। আস্তে আস্তে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি। ভয় হয় দীর্ঘশ্বাসের শব্দ জোরে হলে যদি পুলিশ বকে! তখন কারো অফিসের দেরী হয়ে যাচ্ছে, কারো বাসায় ছোট মেয়েটা সকাল থেকে ফেরার অপেক্ষা করছে, কারো আরো দশমিনিট বাকি আছে পরীক্ষার। আমরা আরেকটি কাজ করতাম নীরবে। সম্মিলিতভাবে অভিশাপ দিতাম, যেন ভিআইপিদের মৃত্যু আমাদের মতো হয়! তারপর ঈশ্বর করোনা পাঠিয়ে দিলেন!

এখন আমরা সবাই সমান। জল জমা ভাঙ্গা রাস্তা যারা উড়ে উড়ে পার হতো তারা পারছেন না উড়তে; যে মধ্যবিত্ত ইট ফেলে লাফিয়ে লাফিয়ে পার হতো তারাও পারছেন না লাফাতে। আমজনতা আগেও লুঙ্গি হাটুর উপর তুলতো, ময়লা মেখে পার হতো- এখনো তাই করছে। তাই উপজেলায় সংখ্যাগরিষ্ঠের নতুন দুশ্চিন্তা নেই। এখানে বহুকাল ধরে রোগে ভুগে রোগের নাম জেনে মরাই পরম আরাধ্য ব্যাপার! রোগটা সে টিবি হোক বা পিইউডি বা করোনা!

প্রতিদিন নতুন নতুন ভিআইপি আক্রান্ত হয়, সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘হা হা’ রিএকশনের বান ছুটে। এটিই বুঝি পৈশাচিক আনন্দ, হায়েনার হাসি। দেখে খারাপ লাগে। কারন জন্মগত ভাবে আমার অবস্থান হয়তো গোধুলি বা ঊষা লগ্নে। এই পক্ষে কিছু আছি, ওই পক্ষেও কিছু আছি। শিকদার সাহেবরা বাঁচুক যেমন চাই, অশিকদাররা বাঁচুক তাও চাই। ‘দি টু পোপস’ সিনেমায় নতুন আর্জেন্টাইন পোপ পুরনো জার্মান পোপকে বলেন- ‘দ্যাট ট্রুথ মে বি ভাইটাল বাট উইদাউট লাভ, ইট ইজ আনবেয়ারেবল’।

এখন আমরা আলোচনা করি। ডাক্তার, বন্ধু, বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী। করোনা পজিটিভ হয়ে যাওয়াই ভাল কি না? যদিও এটি নিশ্চিত না- এর এন্টিবডি দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়া থেকে সুরক্ষা দিবে কিনা। সে চিকেন পক্সের মতো- ছোটবেলায় হয়ে গেলেই ভাল। জীবনে একবারই হবে, দ্বিতীয়বার নয়। এখন যে অবস্থা পালিয়ে বাঁচা প্রায় অসম্ভব। উভয় ভাইরাস থেকে এবং পরিস্থিতি থেকে। সবাই ভাইরাসের চেয়ে পরিস্থিতিকেই বেশি ভয় পাচ্ছে। কোথায় টেস্ট হবে, কতক্ষণ লাইনে দাঁড়াতে হবে, কবে রিপোর্ট দিবে, লাগলে কোথায় ভর্তি করাবে, আইসিইউ সাপোর্ট পাবে কিনা।

আজ একজন ফোন দিলো- তার শ্বাশুড়ির চারদিন ধরে জ্বর। বললাম স্ট্রিক্ট আইসোলেশন মেন্টেন করুন। বললো হাঁটতে পারে না- ধরে ধরে হাঁটাতে হয়। ওয়াশরুম একটি। বাড়িতে ছোট বাচ্চা আছে, অসুস্থ শ্বশুর আছে। যিনি ফোন দিয়েছেন তার নিজের ডায়েবেটিস এজমা হাইপারটেনশন। যখন কিছুই করার নেই তখন চুপচাপ প্রার্থনা করা উত্তম। তাই করতে বললাম! মাদার টেরেসা বলেছেন- ‘গড ইজ দ্যা ফ্রেন্ড অফ সাইলেন্স..!’

সত্যিই সামটাইমস ইটস বেটার টু জাস্ট রিমেইন সাইলেন্ট।

Platform

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

গর্ভকালীন পরীক্ষা সংক্রান্ত পরামর্শঃ রোগীকে কীভাবে বোঝাবেন?

Tue Jun 9 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৯ জুন, ২০২০, মঙ্গলবার ডা. তানিয়া হাফিজ জেড. এইচ. সিকদার উইমেন্স মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতাল সেশনঃ ২০০৩-০৪ চেম্বারে আমি যেসব গর্ভবতী মায়েদের চেকআপ করি তারা বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকেন। কেউ আছেন প্রেগনেন্সি প্রোফাইল টেস্ট দিলে আমার প্র‍্যাকটিসিং চেম্বারে করতে না চাইলে জিজ্ঞাসা করেন, “ম্যাম টেস্ট অন্য জায়গা থেকে […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo