করোনার দিনগুলোয় ১৪ || করোনা হতে সুস্থ হবার গল্প

৯ জুলাই ২০২০, বৃহস্পতিবার

ডা. মোহাম্মদ আল-মামুন
এমবিবিএস, বিসিএস(স্বাস্থ্য)
এফসিপিএস (সার্জারি)
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, বাঞ্ছারামপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

সুস্থ হবার গল্প থাকেনা আসলে। মৃত্যুর অনেক গল্প থাকে। কিভাবে কি হলো। তৃতীয় একজন দেখিয়ে দেয় এভাবে প্রাণ গেলো অমুকের, তমুকের।

আমরা সুস্থ হয়ে তবুও আশার গল্প শুনাই।

প্রথমদিন থেকেই চিকিৎসা নিলে ভালো হবার চান্স বেশী থাকবে। কিছু মানুষ অহেতুক মারা যায়। যথাসময়ে চিকিৎসা নিলে এটি অন্তত হবেনা।

আমি যেদিন শরীরের ব্যাথা অনুভব করলাম, সেদিনই আইসোলেশনে চলে গেলাম। সেদিন বিকেলে যারা চেম্বারে এসেছিলো, তাদেরকেও ফেরত দিলাম। রাত থেকেই সামান্য জ্বর শুরু হলো। এর পাঁচদিন আগে বেশ কয়েকজনের টাচে আসছিলাম, যারা পরে পজিটিভ ধরা পরে।

আমি খুব বাস্তববাদী  চিন্তা করি।

যেহেতু এটি মূলত রেসপিরেটরি সমস্যা বেশী করে এবং মৃত্যুর কারন হয়, তাই আমি এর চিকিৎসাকে ভাগ করি দুই ভাগে।

১)ফিজিক্যাল এজেন্ট

২) কেমিকেল এজেন্ট

ক)যারা ইমিউনিটি বুস্টিং করবে।

খ)যারা ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করবে বা করে বলে মনে করা হয়।

গ)সাধারন যে কোন লক্ষনের ব্যবস্থা নেয়া।

১। যেহেতু শ্বাসনালীতে সবচেয়ে বেশী সমস্যা করে, তাই গরম পানির বাষ্প নেয়াটা কার্যকর।

সে কাজ করবে কয়েকভাবে:

ক)বাষ্পের তাপ অনেক বেশী, তাই ফিজিক্যাল এজেন্ট হিসেবে ভাইরাল লোড কমাবে। কিছু ভাইরাস মারবে, যারা নাকের পিছনে বা ফেরিংস এ থাকবে।

খ)এটি ইডিমা বা আক্রান্ত শ্বাসনালীর ফুলে থাকা কমাবে যাতে অক্সিজেন প্রবাহ বাড়বে।ইনফেকশনের সম্ভাবনাও কমাবে।

গ)নাকের ময়লাগুলো দূর করে নাক পরিষ্কার রাখবে।

ঘ)সাইনাসগুলো পরিষ্কার রাখবে, ফলে যার মনে হবে গলাচেপে ধরছে সেটি থেকে রক্ষা পাবে।

মেনথল ব্যবহার করলে আরো ভালো হয়। দিনে বেশ কয়েকবার নিলে ভালো।

২) কেমিকেল এজেন্ট।

ক)ইমিউিনিটি বুস্টিং এজেন্ট হিসেবে ক্যালসিয়াম + জিংক ট্যাবলেট।

আমার কাছে এখনো মনে হয়, ক্যালসিয়াম হলো মূল ভাইরাল প্রতিরোধী এজেন্ট। যাদের ক্যালসিয়াম ভালো থাকে, তারা সুস্থ হচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি। ডাক্তাররা এবং অন্য অফিসিয়াল লোকজন রোদে যায়না, তাই মারাও যাচ্ছে বেশী। তাদের ক্যালসিয়াম কম প্রমানিত।

খ) এটি সবচেয়ে গোলমালপূর্ণ জায়গা। ঔষধের আদৌ কোন ভূমিকা আছে কিনা জানিনা।

আমি খেয়েছি আইভারমেকটিন ১৮ মি.গ্রা.। ৭ দিন পরে আবারো ১৮ মি.গ্রা.।

সাথে স্ট্যাটিক এজেন্ট হিসেবে পরিচিত ডক্সিসাইক্লিন + মেট্রোনিডাজল পাঁচ দিন।

সেকেন্ডারি ইনফেকশন কন্ট্রোল করার জন্য সেফুরক্সিম খেয়েছি ৫ দিন পর। অন্য এন্টিবায়োটিকও খাওয়া যায়।

ক্লোপিডেগ্রল প্রথম দিন থেকেই খেয়েছি ১৫ দিনের মতো।

এন্টাজল/রাইনোজল নাকের ড্রপ দিয়েছি ছয়ঘন্টা পরপর। বিশেষত রাতে ঘুমের আগে এটি ভালো করে দিয়েছি এবং নাক চমৎকারভাবে পরিষ্কার করে ঘুমিয়েছি। নাক বন্ধ না হলেও যাদের পোস্টন্যাসাল ড্রিপ হয়, তাদের জন্য দূর্দান্ত কার্যকরি। তাই নাকের ড্রপ দেয়া ভালো ফল দেয়। যাদের ভাইরাল লোড কম থাকে, তাদের নাকে সমস্যা বেশী দেখা দেয়।

সকল ঔষধ সব বয়সে সেইফ না। উপরোক্ত অনেক ঔষধই শিশু/গর্ভবতী মায়েদের দেয়া যায় না।

কোন এন্টিভাইরাল ফেভিপিরাভির/রেমিডিসভির, এন্টিকোয়াগুলেন্ট  রিভারক্স খাইনি।

প্রয়োজন মনে করিনি।

স্টেরয়েড খাইনি।

কোট্রিম খাইনি।

রিকনিল খাইনি।

জ্বর, ব্যাথার জন্য প্যারাসিটামল খেয়েছি।

ডায়াবেটিস আছে কিনা, কিডনি ফাংশন ঠিক আছে কিনা দেখেছি প্রথমদিন।

ফলমূল খেয়েছি। দুধ খাওয়া ভালো। প্রচুর ঘুমিয়েছি। ঘুম দরকার। প্রয়োজনে ঘুমের ঔষধ খাবেন। তাও ঘুমাবেন।

অযথা ঔষধ খেলে ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে।

সাধারন মানুষ নিজে ডাক্তারি করলে সমস্যা হয়।ডাক্তারও অসুস্থ হলে অন্যের দ্বারস্থ হওয়া ভালো। কেননা অসুস্থ অবস্থায় ব্রেইন কাজ করেনা।

ডেক্সামিথাসন মৃত্যুর কারন হতে পারে, আবার জীবন রক্ষাকারীও হতে পারে।

কোট্রিমের ক্ষেত্রেও একই কথা।

কোন ঔষধ আপনারা পন্ডিতি করে খাবেন না। আমাদের সাহায্য নিন। এইসব ঔষধ পল্লীচিকিৎসকের কাছে থেকে নেয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়।

আমার কোন মানসিক সাপোর্ট প্রয়োজন হয়নি, আমি  প্রয়োজন বোধও করিনি।

অন্যদের পরামর্শও আমি চাইনি, কারন আমার কন্ডিশন কন্ট্রোলে ছিলো। অক্সিজেন স্যাচুরেশন দেখেছি দিনে দু’বার করে। যেহেতু সমস্যা হচ্ছিলো না, কাজেই এর প্রুব হাতে নিয়ে বসে থাকিনি। সাতদিন পর পালসঅক্সিমিটার রেখে দিয়েছি।

অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়েও বসে থাকিনি।

প্যানিক হওয়ার প্রশ্নই আসে না।

ভয় পেলে যে কোন সমস্যা সমাধান করা কঠিন হয়।তাই মাথা ঠান্ডা রেখে সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়।এটি ডাক্তারগন অন্তত নিজের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারেন।

আইসোলেশনের  প্রথম দিন থেকেই কিছু কাজ করেছি….

১। যারা কোভিড-১৯  আক্রান্ত, তাদের খোঁজ খবর রেখেছি, ফোনে তাদের সাথে কথা বলেছি। মানসিক সাপোর্ট দিয়েছি।

২। যারা নতুন আক্রান্ত হয়েছে, তাদের চিকিৎসা দিয়েছি ফোনে, বিরাট অংশকে মেসেজে করে চিকিৎসা দিয়েছি এবং তাদের মানসিক সাপোর্ট দিয়েছি।

৩। যারা ফোন করে কিংবা মেসেঞ্জারে সমস্যা নিয়ে মেসেজ দিয়েছে, তাদের সবাইকেই চিকিৎসা এবং সমাধান দিয়েছি। মেসেজ দিয়ে আমার কতটাকা খরচ হলো এসব নিয়ে ভাবিনি। শতশত মেসেজ দিয়েছি।

প্রচুর চিকিৎসা দিয়েছি মেসেঞ্জারে।

সাধারন মানুষ যাদের চিকিৎসা দিচ্ছি, কোনদিন জানাইনি যে আমি কোভিড লক্ষনে ভুগছি। আমি আইসেলেশনে থেকেই শতশত রোগীকে চিকিৎসা দিয়েছি। অথচ নিজেও আক্রান্ত ছিলাম। এর জন্য কিন্তু অন্যদের চিকিৎসা বন্ধ থাকেনি। শুধু রোগী দেখা বন্ধ ছিলো। ফোন, ফেসবুক সবই সচল ছিলো। ফেসবুকে সচেতনতা মূলক পোস্টগুলোও নিয়মিতই দিয়েছি। শরীর খুব দুর্বল থাকায় শুয়ে শুয়ে চিকিৎসা দিয়েছি।

ফেসবুকে কিংবা ডক্টর গ্রুপে পোস্ট করে দোয়া চাইনি। এটি আমার পছন্দ নয়।

অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব ছাড়া জানতোই না কেউ। আইসোলেশনের চৌদ্দ দিন পার করলাম, আমাদের অফিসিয়াল কিছু লোকজনকে জানিয়ে।

যখন পজিটিভ রিপোর্ট আসলো সেটি আমার জন্য খারাপ হলো। কারন ইতিমধ্যেই আমি সুস্থ হয়ে গেছি।১৪ দিনের মাথায় রিপোর্টের  গুরুত্ব ছিলো শুধু সংখ্যায়। অবশ্য আরেকটা লাভ হলো এই যে, আমি কিছুদিন অন্তত ভালো থাকবো। ইমিউনিটি কিছুটা হলেও তৈরী হবে। আমার প্রথম রিপোর্ট নেগেটিভ ছিলো।

কাজের দিক থেকে ভালো হয়নি। সেদিনও আমি করোনা রোগী দেখছিলাম। আর দেখা সম্ভব হয়নি কারন লোকে খারাপ বলবে। তাই আবারো আইসোলেশন। সেদিনই স্যাম্পল দিলাম, যা পরে নেগেটিভ আসে। তার জন্য সাতদিন লেগে যায়।

এই সাতদিন পার করেছি সচেতনতা মূলক ফেসবুক পোস্ট দিয়ে, গিটার বাজিয়ে, বাঁশি বাজিয়ে। গল্প কবিতা পড়ে, লিখে।

আল্লাহর কাছে শুকরিয়া যে আবার কোভিড যুদ্ধে মানুষকে সাহায্য করতে আসতে পেরেছি।

ভালো থাকুন সবাই, সুস্থ ও নিরাপদে থাকুন।

Sarif Sahriar

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

করোনা হাসপাতাল থেকে | পর্ব ৮

Thu Jul 9 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৯ জুলাই ২০২০, বৃহস্পতিবার প্রফেসর ডা. মেজর (অব.) আব্দুল ওহাব মিনার একাদশ ব্যাচ, শের-ই-বাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় (শেবাচিম), বরিশাল সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল ঢাকায় আমি যখন প্রশিক্ষণ নিই তখন আমাদের আলু ভর্তার মতো চটকে তৈরি করা হতো৷ একটু পর পর সরিষার তেল, লাগলে ঘি আবার চটকানো৷ এমন পীড়নের মাধ্যমে পেশাগত […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo