লাইফ ইন লকডাউন, ডে হান্ড্রেড এইটি ওয়ান

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৫ অক্টোবর ২০২০, সোমবার
ডা. শুভদীপ চন্দ

শহরে এক পাগল আছে। একটু পরপর বলে ‘মাকে নিয়া আসমু, বড় হাসপাতালে চিকিৎসা করমু’। সে কবে সে ভাল ছিল, টাকা রোজগার করতো আর মনে মনে প্ল্যান করতো গ্রাম থেকে বিধবা মাকে নিয়ে এসে চিকিৎসা করাবে। পাগলদেরও একটি অতীত থাকে। এখন সে পাগল, সবকিছু ভুলে গেছে শুধু ও কথাটি ভুলে নি। মা তো মরে গেছে সে কবেই!

পাগলদের দেখে অদ্ভুত লাগে। একটু ভয়ও লাগে। তাদের মনের ভিতরে কী চলছে বাইরের বিশ্ব জানে না। মন ও বিশ্ব- একে অপরের অস্তিত্ব নাকচ করে দেয়। আসলে কার মনের খোঁজ কে জানে! শরীরে মনের অংশই বা কতটুকু? বোর যখন পরমাণুর মডেল দেন বলেছিলেন- এক ফুটবল মাঠ যদি পরমাণু হয়, আপনি যে মোটর ভাজার ঠোঙ্গা নিয়ে মাঠে গেছেন সেখানে এক মটর দানা হচ্ছে তার নিউক্লিয়াস। যে পুরো পরমাণুর ভর ধারণ করে বসে আছে। শরীরে মনও সম্ভবত এরকম কিছু। তিলমাত্র জায়গা কিন্তু বড় ভারী।

ছবি – প্রতীকী

এ পৃথিবীতে রোবট মানবরাই সবচেয়ে সুখী মানুষ। তাদের অত ভাববার কিছু নেই। জাস্ট ফলো করে যাও। মানুষ দুই ধরনের হয়। একদল অর্ডার করে, আরেকদল ফলো করে। বস হলেই যে অর্ডার করবে এমন না, সে অধস্তন হলেও সে ঠিক করে দেয়। বলে ‘এভাবে করলেই হয়তো ভাল হবে’, বস মেনে নেয়। যাকে আমরা ‘আস্থা’ বলি।

ঢাকায় এসেছি। মন খুব অশান্ত হয়ে আছে। ভেবেছিলাম প্রায় একশো আশি দিন ধরে কোভিড উনিশ নিয়ে লিখছি, ঢাকার কথা তো আসেই নি। কোথায় কী, ঘরবন্দী হয়ে বসে আছি গত দুইদিন। সংসারে এমন এক বন্ধু প্রয়োজন যার সাথে মন খুলে সব বলা যায়। সেরকম কাউকে না পেলে পাতিয়ে নিতে হয়। ঈশ্বরের করুণার আশায় এখন কৃষকও বসে থাকে না!

ইংরেজিতে একটি শব্দ আছে cynical, মানে যারা ভাবে অন্যের দুঃখ কষ্টে উদ্বিগ্ন হয়ে নিজে কষ্ট পাওয়ার কোনো মানে নেই। cynicism একটি দর্শন। প্রাচীন গ্রীসে সিনিকসরা ছিলেন। একবার এক দোকানে সক্রেটিস গেলেন যেখানে সব পাওয়া যায়। তিনি সেখানে বলেছিলেন ‘কত কিছু আছে, অথচ আমার কিছুরই প্রয়োজন নেই!’ তাঁর এক কথাতেই এক মতবাদ তৈরি হয়ে গেল। সিনিকসরা বিশ্বাস করতো বাহ্যিক কিছু লাগে না সুখী হতে, সুখ সবার নাগালের মধ্যে। একবার সুখী হলে সুখ হারায় না। এ শহরের মানুষগুলো আধুনিক সিনিকস, প্রাচীন গ্রীসের সিনিকস নয়। আসার সময় মহাখালী কাঁচাবাজারে এক বৃদ্ধকে বাস থেকে নামতে গিয়ে পড়ে যেতে দেখলাম। কারো কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। কেউ বললো বৃদ্ধের দোষ, কেউ বললো ড্রাইভারের। বেশিরভাগ চুপ থাকলো। বাস দাঁড়ালো না। বাস সহ মানুষ। (আজকের নির্যাতিত গৃহবধূর প্রসঙ্গ আর না টানি।)

সারাদিন কয়েকবার পত্রিকা পড়ি। রাজনীতির খবর ছাড়া দৈনিক পত্রিকা হয়? গত কয়েকমাস ধরে তাই হচ্ছে। শুধু ক্রাইমের খবর দিয়ে একেকটি পেপার। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অসুস্থ। তিনি প্রথম বড় কোনো নেতা যার মধ্যে ভন্ডামি ছিল না। যা মুখে আসতো তাই বলে দিতেন। রাজনীতি যে কোনো পোশাক নয় সে পৃথিবীবাসী প্রায় ভুলতেই বসেছিল। সম্ভবত এবারের নির্বাচনে তিনি হারবেন। ১১, ১২ ক্লাসে বাঙলার সিলেবাস দিয়েছে। ১২ টি করে গল্প, কবিতা। অসাধারণ সিলেকশন। তবে এত কম কেন? মস্তিষ্ক পেশির মতো। ব্যায়াম না করলে বাড়ে না। আমরা আমাদের মস্তিষ্ক ছোট করে ফেলছি। ফেসবুকে আসলেই দেখা যায় পাখির মতো ব্রেন নিয়ে আমরা উড়ে বেড়াচ্ছি!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান বললেন মাত্র ১২ টাকায় নাকি পড়াশোনা করা যাচ্ছে। হয়তো যাচ্ছে, কিন্তু তাকে কী পড়াশোনা বলে? শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিনামূল্য মর্যাদা মানের মর্যাদাকে হটিয়ে রাখছে- এ সমস্যা আমাদের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির ভার্সিটি গোটিনজেন- পুরো মানব ইতিহাসের গতিপথই বদলে দিয়েছিলো। হিটলার যদি ইহুদি প্রফেসরদের বের না করে দিতেন আমেরিকার ম্যানহাটন প্রজেক্ট করে বোমা বানানো হয় না। রাশিয়ারও হয় না, ইংল্যান্ড ফ্রান্সেরও হয় না। তখন গোটিনজেন ভার্সিটির ক্যান্টিনে কোনো লেখা কখনো মোছা হতো না। কারন চা কফি সিংগারা খেতে খেতে শিক্ষক ছাত্ররা তাদের চিন্তার সূত্র ধরে অঙ্ক কষা শুরু করতেন। হয়তো অর্ধসমাপ্ত থাকতো। পরেরদিন ওখান থেকেই অন্যকেউ শুরু করতো। সেজন্য কড়া নির্দেশ ছিল অনুমতি না নিয়ে ম্যানেজার টেবিলের কোনো আঁক মুছতে পারবে না। আর আমাদের গর্ব আমাদের ভার্সিটিতে দশ টাকায় উন্নত মানের নাস্তা পাওয়া যায়!

অবশ্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও বিএসএমএমইউ ক্যান্টিনকে আমার একদম তুচ্ছ মনেহয় না। কেউ চোখ কান খোলা রাখলে অনেক কিছু শিখতে পারে। একমাত্র মেডিকেল প্রফেশনে আমাদের মস্তিষ্ক ভাল খরচ হচ্ছে। মেডিকেল প্রফেশন নষ্ট হচ্ছে পরে গিয়ে। পাশ করার পর। অর্জুন কর্ণরা মহারথী স্বীকৃতি পাবার পর সাধারণ তীরন্দাজে পরিণত হচ্ছেন।

এবার পূর্নিমায় ব্রীজে গিয়েছিলাম জ্যোছনা দেখতে। গ্রামের মধ্যে ছোট নদী, ছোট ব্রীজ। মাঝ রাত। ডিঙ্গি নৌকায় জেলেরা নিঃশব্দে মাছ ধরছে। দূরে বাড়িঘরের আলো সারিসারি দোকানের কুপিবাতির মতো দেখাচ্ছে। রাস্তায় রাস্তায় নির্ভয়ে শিয়াল ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোথাও কোথাও কুকুর। যারা টহল দেন- বেঞ্চিতে বসে মোবাইলে লুডু খেলছেন। তিন চার বল্লম পাশে রাখা। ফলা গুলো চকচকে।

অন্ধকার থেকে অন্ধকার সরিয়ে অন্ধকার দূর করা যায় না। প্রয়োজন আলোর উপস্থিতির। তা সে যত অল্প আলো-ই হোক। এ জনপদে শিক্ষা দরকার। পরীক্ষা পাশের শিক্ষা না, আরেকটু মানবিক হবার শিক্ষা।

Platform

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

ধর্ষণের বিরুদ্ধে তায়রুন্নেসা মেমোরিয়াল মেডিকেলে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ

Mon Oct 5 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৫ অক্টোবর, ২০২০, সোমবার আজ রোজ সোমবার নোয়াখালীসহ সারা বাংলাদেশে ধর্ষণের প্রতিবাদে এবং দোষীদের সব্বোর্চ শাস্তি প্রদানের দাবিতে তায়রুন্নেসা মেমোরিয়াল মেডিকেল কলেজ গাজীপুরের তারগাছ এলাকায় মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে। দেশে গত ৯ মাসে ধর্ষণ এবং গণধর্ষণের স্বীকার হয়েছেন ১০৮৩ জন নারী। বিচারহীনতা এবং ক্ষমতার দাপটের কারণে […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo