মুক্তিযোদ্ধা ও করোনাযোদ্ধা

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ১৪ মে ২০২০, বৃহস্পতিবার:

অনেকক্ষণ দাড়িয়ে আছি। রিক্সা, সিএনজি কিচ্ছু পাচ্ছিনা। একটু আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে। এখনো পড়ছে গুড়ি গুড়ি। লকডাউনে সব লকলক করে উঠেছে গাছের পাতা, ফুল আর লতা-গুল্ম। যেন ওদের লেগেছে নবজন্মের উৎসব।

সাদা এপ্রোনটা মনে হচ্ছে সফেদ জমিন। ক’দিন আগেও অচেনা কাউকে ডাক্তার পরিচয় দিতাম না। আজকাল আইডেনটিটির জন‍্য হলেও পরা লাগে। পুলিশ বা আর্মি কারো প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়না।

একদিন নাইট ডিউটিতে আসার সময় জটলা পাকা জনগনের মধ‍্যে একজন বলে উঠলো, “দেখ, কত কষ্ট করে একা একা ডাক্তার আপাটা ডিউটি করতে যাইতেছে।” ওদের সামান‍্য এই কথাটা আমার মনের ভিতর গেথে গেল। ওদের এই উপলব্ধি আমার আরো কৃতজ্ঞতার দায় বাড়িয়ে দিলো।

হাঁটতে আমার মন্দ লাগছে না। এই শহরটাকে এই শহরের ফুটপাতকে যারা ভালোবাসতে পারে, তারা খুব সহজে সুখী হতে পারে। কারণ তাদের চাহিদা খুব সীমিত। বড়জোর ফুল পাখীর গান শুনতে শুনতেই তারা মুগ্ধ হয়ে বাঁচতে শিখে যায়।

এসব এলোমেলো চিন্তার ছেদ ঘটলো যখন একজন রিকশাওয়ালা পিছন থেকে বলল, “ডাক্তার মা কই যাবেন?”

আমি ‘মিরপুর’ বলতেই রিকশায় উঠিয়ে নিল। ভাড়া বলল মাত্র ১০০ টাকা। চারপাশে আর কোন রিকশা না থাকায় এত কম ভাড়া শুনেও বিস্ময় লুকাতে লুকাতে রিকশায় উঠলাম। ভাগ‍্য ভালো আমার মাস্ক আর চশমার আড়ালে বিস্ময়টা পড়তে পারলেন না উনি।

আমি রিকশায় উঠলে বকবক করতে থাকি। যথারীতি আজও ব‍্যতিক্রম হলো না। জানতে পারলাম রিকশাওয়ালা চাচা একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এখন রিকশা চালাচ্ছেন জীবনের প্রয়োজনে। এত যত্ন নিয়ে চালালেন যে, আজ উঁচু-নীচু রাস্তাটা হয়ে গেল মোলায়েম কার্পেট মোড়ানো রাস্তা।

আমার বুকটা ভারী হয়ে গেল।

এক সময় ওনারা যুদ্ধ করে আমাদের স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছেন। আর এখন বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন আরেক যোদ্ধাকে।

যুদ্ধ হয়ত বদলায়। শুধু বদলায় না আমাদের ভাগ‍্যটা। যুদ্ধটাই কেবল অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়।

কখন পৌঁছে গেছি বাসায় গল্পে গল্পে টেরই পাইনি। ডাবল ভাড়া দিতে চাইলাম। উনি বিনয়ের সাথে সেটা প্রত‍্যাখান করলেন। বললেন,”মা আপনি একা একা হেঁটে ফিরছিলেন, তাই আমি ইচ্ছা করেই আপনাকে কম ভাড়া বলেছি। আপনারা আপনাদের জীবন বাজি রেখেছেন আমাদের জন‍্য। আর আমি একটু কম ভাড়া নিতে পারবো না?”

আমার চোখের কোনার জল বৃষ্টির সাথে ধুয়ে ধুয়ে যাচ্ছে। আমি সেটা লুকানোর চেষ্টা করিনা। ওটা ঝরার আজ বিশেষ প্রয়োজন।

(ডাক্তার পিটানো কিংবা ঘর ছাড়াতে বাধ‍্য করা বাড়ীওয়ালা কিংবা করোনার চিকিৎসা দিয়ে নিজেই আক্রান্ত মানুষের ছোড়া ইট পাটকেলে এমন চিকিৎসকের জীবনে, এদের মত মহামানবের সাথে দেখা হয়না। আজ কেমন করে ভুল করে আমার দেখা হয়ে গেল।

একটুখানি অমলিন শ্রদ্ধাঞ্জলি রেখে গেলাম উনার জন‍্য। জীবন রক্ষার সরঞ্জাম পাইনি ঠিকমতো। কিন্তু উনাদের মত মহৎ কিছু মানুষ আমাদের চারপাশ থেকে রক্ষা-কবচ দিয়ে ঘিরে রেখেছেন।

সবাই যদি আমাদের নিয়ে এমন করে ভাবতেন, তবে একটুও কষ্ট থাকত না।)

লিখেছেন:
ডা. সেলিনা সুলতানা স্মৃতি
বিএসএমএমইউ

Abdullah Al Maruf

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

সুনামগঞ্জে করোনায় আক্রান্ত হওয়া প্রথম চিকিৎসক এখন সুস্থ

Thu May 14 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, বৃহস্পতিবার, ১৪ মে, ২০২০ দেশে চলমান করোনা মহামারীতে দিনদিন আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। শনাক্তকৃত করোনা রোগীর সংখ্যা আঠারো হাজার ছাড়িয়েছে। তবে ইতিমধ্যে অনেকে আরোগ্যও লাভ করেছেন। এখন পর্যন্ত দেশে করোনা থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৩০০০ জনের অধিক। এবার করোনাকে জয় করলেন সুনামগঞ্জে করোনায় (কোভিড-১৯) আক্রান্ত হওয়া প্রথম […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo