জয়ার মৃত্যু জয়

মঙ্গলবার, ৯ জুন, ২০২০

ডা. সেলিনা সুলতানা স্মৃতি
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

নাইট ডিউটিতে আসলেই মনে হয়, সনি টিভির হরর ফিল্মে ঢুকে পড়লাম। জীবনের সত‍্যিকার হরর ফিল্মগুলো নাটকের চেয়েও হয় নাটকীয়। নাটকের কুশীলবদের মত দক্ষ অভিনেত্রী  হতে পারিনি বলে মাঝেমাঝে নিজেকে বেগুণ মনে হয়।

ট্রলির শব্দে একের পর এক রোগী আসতেই থাকে। লেবার টেবিল, ওটি রুম গিজগিজ করে, আমার অধিক রোগী ভাগ‍্যে। (সবাই বলে আমার রোগী ভাগ‍্য নাকি খুব ভালো)। রাপচার ইউটেরাস, রাপচার একটোপিক প্রেগনেন্সি সবগুলো আমার নাইটে কেমনে জড়ো হয় জানিনা। এ বলে আমায় দেখো, ও বলে দেখো না আমায়!

এখন বাজে রাত ২ টা। ট্রলিতে শুয়ে আছে অসম্ভব রুপবতী মেয়েটা। নাম জয়া(ছদ্মনাম)। চোখমুখ সাদা। পালস্ ক্ষীণ। বিপি খুব কম। জয়ার ট্রলি ভেসে যাচ্ছে রক্তে। ওর চোখের পাপড়িগুলো বাচ্চা মেয়েদের মত বড় বড়। কে বলবে ৪৮ ঘন্টা আগে এই মেয়েটি একটা বাচ্চার মা হয়েছে?

চারপাশে অনেক লোক জমে গেছে। মোটামুটি বিরাট বাহিনী নিয়ে জয়ার প্রবেশ। বাহিনীর প্রধান একজন ডাক্তার। যিনি জয়ার অপারেশন করেছেন, প্রায় ৪৮ ঘন্টা আগে। পেটের মধ‍্যে এবং পার-ভ‍্যাজাইনাল দু’জায়গাতেই অনবরত ব্লিডিং হচ্ছে। পেট ক্রমশ প্রস্থে বাড়ছে। প‍্যারাসেনটেসিস করে ফ্রেশ ব্লাড পাচ্ছি। ওর হাত পা ধীরে ধীরে  ঠান্ডা হয়ে আসছে।

আমার হাত-পা ঠান্ডা হওয়া শুরু করল, যখন জয়ার সাথে আসা ভীত ডাক্তার সাহেবের মুখে শুনলাম ওর ভাই মেডিকেলে পড়ার সময় দুটো মানুষ খুন করেছে। আমার একটু এদিক ওদিক ট্রিটমেন্টে আমিও ঔ দলে পড়ব কিনা, বুঝে উঠতে পারছি না।

জয়ার অবস্থা এখন আমার সামনে আরো খারাপ হওয়া শুরু করেছে। এখনই ওকে ওটিতে নিতে হবে। জয়া আর আমার হাতে সময় খুবই কম।

জয়া বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করেছে। এটাই ওর প্রথম বাচ্চা। ওর দীঘল চুল ও ভেসে যাচ্ছে রক্তে। চোখের কোনে বাসি কান্নার দাগ। ওর বৃদ্ধ মা-বাবা আর স্বামীর আহাজারির মুখে আমি নিরুপায় আর নিরুত্তর ডাক্তার। কারন জানিনা ওটিতে কি অপেক্ষা করছে ওর জন‍্য।

এত রাতে সারা রাজশাহী শহরে কোথাও আলট্রাসাউন্ড করাতে পারবে না। মেডিকেলেও চট করে দেখে সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। কারন সনো মেশিন নষ্ট। অনেক ব‍্যাগ রক্ত আর্জেন্ট দরকার।  রক্তের বিনিময়ে রক্ত আর ইমিডিয়েট অপারেশনই ওকে আল্লাহর রহমতে বাঁচাতে পারে। আমার ক্লিনিকাল ডায়াগনোসিস ওদেরকে ব‍্যাখা করলাম।

এখনই জরুরি ভিত্তিতে অপারেশন করে ইনটারনাল ব্লিডিং বন্ধ করতে হবে। নাহলে ওর বাচ্চাটা হয়ত মা হারা হয়ে যাবে সকালের রোদ উঠতে না উঠতেই। ওর চারপাশের মানুষগুলোর উদ্বিগ্নতা আমার ভিতর জমতে শুরু করলো। এত রাতে মাত্র ২৩ বছর বয়সী একটা মায়াবতী মেয়ের মায়া আমাকে পিছু টানতে লাগল।

কিন্তু অপারেশন টেবিলে আমি স্তম্ভিত হয়ে দেখলাম জয়ার সারা পেট ভর্তি চাপচাপ রক্ত। আমরা জরায়ু বাচাতে ব্লিডিং বন্ধ করতে অনেক সময় বি-লিঞ্চ সেলাই( B- Lynch suture) দিই। এখানে আমি সবসময় ইউটেরাসের ফান্ডাসে প্রিক করে সেলাইটা ফিক্স করে নিই। কিন্তু দূর্ভাগ‍্যজনকভাবে এখানে ফান্ডাস ফিক্স করা হয়নি। এটোনিক ইউটেরাসে (Atonic Uterus) রক্ত জমতে জমতে এত বড় হয়ে গেছে যে সেলাইটা স্লিপ খেয়ে টিউব, ওভারী সব কেটে নীচে নেমে গেছে। অনেক ভেসেলস কাটা পড়ায় পুরো জরায়ু প্রায় নীল হয়ে গেছে।

এতক্ষণ রক্ত না পাওয়ায় জরায়ু প্রায় প্রায় জায়গায় নেক্রোসিস হয়ে গেছে। ওর আত্মীয় আর সাথে আসা ডাক্তার সাহেবকে ওটি রুমে ডাকলাম। কারন এত কম বয়সী মেয়ের এমন প্রায় পচনশীল জরায়ু রাখা সম্ভবপর হচ্ছে না। এটি আমিই মন থেকে মেনে নিতে পারছিনা। হয়ত আরো আগে আসলে জরায়ুটা বাঁচাতে পারতাম। কিন্তু এমন অবস্থায় আমার হাত আর চোখ অসহায়ের মত থমকে গেছে। এই হাতে কত মরনাপন্ন জরায়ু বাচানোর অপারেশন করেছি। আর আজ এই ফুটফুটে মেয়েটার জরায়ুর অবস্থা দেখে নিজেরই এই মাঝরাতে গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। অবশেষে মন শক্ত করে জয়াকে বাঁচানোর জন‍্য ওর জরায়ুটা আমাকে ফেলে (Hysterectomy) দিতে বাধ‍্য হতে হলো।

ওটি শেষে প্রায় সবসময় সফল হয়েছি। মনটা আনন্দে ভরে গেছে। অথচ আজ জয়ার জরায়ুর জন‍্য আমার বুকের চিনচিনে কষ্টটা থামাতে পারছিনা। ওকে ক্লিনিকে না রেখে ওটির জটিলতা হওয়ার সাথেসাথে মেডিকেলে আনলে হয়ত এই পরিণতি হত না।

আমার খচখচে মন নিয়ে পরদিন রাউন্ডে যেয়ে দেখি জয়ার টলটলে হাসিমুখ। ওর মা বিছানার পাশে। উনি যতটা কৃতজ্ঞ হয়ে উনার মেয়েকে বাঁচানোর জন‍্য আমাকে ধন‍্যবাদ দিচ্ছেন, আমি ততটাই অশ্রুসজল চোখে ওদেরকে দেখছি। জয়ার কোলের তুলতুলে পুতুলকে কোলে নিয়ে মনে হল, না থাকুক জরায়ু, তবুও ওর মা টা ওকে কোলে নেবার জন‍্য বেঁচে আছে, এটাই বা কিসের কম পাওনা?

বাইরের ঝলমলে রোদ এসে পড়ছে জয়ার বিছানায়। ওকে আজ আরো রুপবতী লাগছে। ওর উজ্জ্বল হাসি আর বেঁচে থাকার আয়োজন আমার বিষণ্নতা কাটিয়ে দিচ্ছে ক্রমশ। কোন কোন সময় অনেক কিছু হারিয়েও মানুষ শুধু বেচে থাকার আনন্দটুকু নিয়েই বাঁচে। জয়ার খুনী ভাইয়ের কথা মনে পড়েও আজকে জয়াকে নিজের বোনের মতই লাগছে। ওর অমলিন হাসিটুকু আমি রেখে দিলাম আমার বুকের গভীরে।

(বি.দ্র: অপারেশনের আগে খোঁজ নিন, আপনার ডাক্তার কতখানি দক্ষতার সাথে আপনার ইমার্জেন্সী অবস্থা মেনেজ করার সক্ষমতা রাখেন। ব‍্যাঙের ছাতার মত মানহীন ক্লিনিক আর ডাক্তার এড়িয়ে চলুন। আপনার ক্ষতির দায় আপনাকেই বইতে হবে। তবে কেন নয় সচেতনতা?)

Sarif Sahriar

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

দৃঢ় মনোবল, ছিল অটল প্রতিশ্রুতি, করোনাকে হারিয়ে আবার যে ফিরতে হবে কর্মস্থলে!

Tue Jun 9 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৯ জুন ২০২০, মঙ্গলবার “ঘড়ির কাঁটায় রাত বারোটা বেজে এইমাত্র ঢলে পড়লো। ক্লান্ত কিন্ত সাহসী মনোবল নিয়ে নিজেই নিজের করোনা পজিটিভ রিপোর্ট সাইন করলাম। দপ্তরগুলোতে মেইল করার পর কম্পিউটার অফ করে রুমের বাতি নিভাতে গিয়ে একটু থমকে গেলাম। অফিস ছেড়ে যাচ্ছি। কবে আবার আসা হবে জানি না। অল্প […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo