দৃঢ় মনোবল, ছিল অটল প্রতিশ্রুতি, করোনাকে হারিয়ে আবার যে ফিরতে হবে কর্মস্থলে!

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৯ জুন ২০২০, মঙ্গলবার

ঘড়ির কাঁটায় রাত বারোটা বেজে এইমাত্র ঢলে পড়লো। ক্লান্ত কিন্ত সাহসী মনোবল নিয়ে নিজেই নিজের করোনা পজিটিভ রিপোর্ট সাইন করলাম। দপ্তরগুলোতে মেইল করার পর কম্পিউটার অফ করে রুমের বাতি নিভাতে গিয়ে একটু থমকে গেলাম। অফিস ছেড়ে যাচ্ছি। কবে আবার আসা হবে জানি না। অল্প সংখ্যক সহকর্মী ঘিরে ছিলো। আবার অফিসের চেয়ারে বসে পড়লাম একটা ছবি তুলতে বললাম। তারা তুলে দিলো। নিজেরাও সাহসের সাথে গ্রুপছবি তুলতে চাইলো। বন্ধ করে বেরিয়ে এসে বাহিরের দরজায় দাড়ালাম। সবাই ঘিরে ছিলো। আবার ছবি তুলতে চাইলো। না করিনি। অনেক পেয়েছি এখান থেকে। বিনিময়ে কিছু দিতে পেরেছি কি না জানি না। সকল সহকর্মীদের ভীষণ মিস করবো। আল্লাহ সবাইকে ভালো রাখুন।”

আইসোলেশনে যাওয়ার আগের শেষ কর্মদিবস নিয়ে ফেসবুকে একটি আবেগঘন স্ট্যাটাস দেন অধ্যাপক ডা. শাকিল আহমেদ, চট্টগ্রামের বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ট্রপিকাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেসের (বিআইটিআইডি) ল্যাবরেটরি ইনচার্জ।

যার হাত দিয়ে চট্টগ্রামে করোনার নমুনা পরীক্ষা কার্যক্রম শুরু হয় এবং যার সাক্ষরেই করোনা পজিটিভ না নেগেটিভ তা চূড়ান্ত হচ্ছে, অবশেষে তিনিও দুর্ভাগ্যবশত করোনায় আক্রান্ত হন। নিয়তির কি নির্মম পরিহাস! নিজের কোভিড-১৯ পজিটিভ রিপোর্ট নিজেকেই সাক্ষর করতে হয়।

তবে যুদ্ধের একজন সেনাপতিকে যে ভয় পেলে চলবে না। এই অদৃশ্য ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অসংখ্য যোদ্ধাকে যে আলোর পথ দেখাতে হবে। অনেক দুর্গম ও দীর্ঘ পথ যে পাড়ি দিতে হবে করোনা মোকাবিলায়। বিগত তিন মাস ধরে করোনার বিরুদ্ধে অসম এক যুদ্ধে সম্মুখ সারিতে যে আছেন, সেই যুদ্ধের ময়দান মাঝপথে ছেড়ে যাবেন কি করে!

তাই ভেঙে পড়েননি ডা. শাকিল আহমেদ,কারন তিনি যে একজন বীর সেনাপতি। সাহসী মনোবল নিয়ে এবার নিজের শরীরের সাথে ভিতর থেকে যুদ্ধ করেন করোনার বিরুদ্ধে। তাঁর অটুল প্রতিশ্রুতি ছিল সুস্থ হয়ে শীঘ্রই এই লড়াইয়ে আবার যুক্ত হবেন। ফিরে আসবেন তাঁর বিরতিহীন প্রিয় কর্মস্থলে, প্রিয় সহকর্মীদের মাঝে। তিনি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেননি এবং সংগ্রামের বিভিন্ন প্রতিকূলতা কাটিয়ে অবশেষে জয়ও করেন করোনাকে।

হোম আইসোলেশনে থাকাকালীন তিনি তার করোনা নিয়ে অভিজ্ঞতা সামাজিক গণমাধ্যমে জানান। তারই একটি অংশ এখানে তুলে ধরা হলো।

“এখন সুস্থ বোধ করছি। করোনা আক্রান্তের এগারো দিনে আমার রিপোর্ট নেগেটিভ আসে। আমার বয়স সাতান্ন, বারো বছর ধরে প্রেশার আর কিছু হার্টেরও সমস্যা আছে কিন্তু ডায়াবেটিস নেই। সেই হিসেবে আমি রিস্কি গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত। সবাই জানতে আগ্রহী করোনা মোকাবেলায় কি করেছি তাই এই লেখাঃ
১) মনোবল ঠিক রাখতে হবে। প্রথম দিকে বাসাতেই একরুমে আলাদা থাকতে হবে। রাতে ঘুমানো ছাড়া সারাদিন ঘুমিয়ে বা শুয়ে থাকা যাবে না। কিছু বিশ্রাম বাদে বাকি সময় পায়চারি করে, বসে, বই পড়ে, মোবাইল টিপে বা নামায কালামে ব্যস্ত থাকতাম।
২) হালকা ব্যায়ামঃ উঠবস করে, কোমর বাকিয়ে ও হাত প্রসারিত করে দুবেলা ব্যায়াম করতাম।
৩) ফুসফুসের ব্যায়ামঃ করোনা শ্বাসযন্ত্রের অসুখ হওয়ায় এই ব্যায়াম জরুরী। সোজা দাড়িয়ে লম্বা শ্বাস নিয়ে কিছুক্ষন ধরে রেখে ছেড়ে দিতাম। ৫/৬ বার করে একটু থেমে আরেকবার রিপিট করতাম। একবার বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে বুকে বালিশ রেখে পিঠের দিকটা ফুলিয়ে জোরে শ্বাস নিয়ে ছাড়তাম তিনবার। বন্ধ হয়ে থাকা এলভিওলাই গুলো সচল করতে এটা খুব উপকারী।
৪) শ্বাসনালী পরিস্কার রাখাঃ পানি ফুটিয়ে বাস্প লম্বা শ্বাস টেনে গ্রহন করতাম দিনে ২/৩ বার। নাক বন্ধ থাকলে মেন্থল বা কিছু মসলা দিতে পারেন। আমি কিছুই দেই নাই।
৪) গলা পরিষ্কার রাখাঃ বাস্প নেওয়া শেষ হলে সেই পানিতেই একটু লবন মিশিয়ে গরগরা করতাম ৩ বার।
৫) পানীয়ঃ গরম আদা চা ৩/৪ বার খেতাম। প্রচুর পানি (গরম নয়) খেতাম, লেবু চিপে চিনি লবন দিয়ে শরবত খেতাম। মালটার রস খেয়েছি।
৬) খাবারঃ কিছু বেছে খাইনি। প্রচুর প্রোটিন খেয়েছি। সকালে দুটো ডিম, দুপুরে ও রাতে মাংশ, মুরগী বা বড় মাছ। ফাঁকে সবধরনের ফল খেয়েছি।
৭) চিকিৎসাঃ করোনার কোন নিদৃষ্ট চিকিৎসা নাই। লক্ষন অনুযায়ী ওষুধ খেতে হয়। আমার সর্দি আর গায়ে ব্যাথা ছিলো যার জন্য কোন ওষুধ নেই নাই। প্রেশারের ওষুধ আর এসপিরিন ছাড়া নিয়মিত কিছু খাই নি। ওষুধের ব্যাপারে আমার পরামর্শ হলো ডাক্রারের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ খাবেন আমি কোন ওষুধই রিকমেন্ড করবো না।
৮) সতর্কতাঃ সবচেয়ে জরুরী বিষয় হলো ওয়ার্নিং সাইন বুঝা। পালস অক্সিমিটার সাথে রাখবেন ও চারবার চেক করবেন। অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে গেলে বা শ্বাসকষ্ট শুরু হলে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। বয়স কম হলে বাসায় অক্সিজেনের ব্যাবস্থা রাখতে পারেন। কিন্তু ৬০ এর বেশি বয়স বা অন্যান্য রোগ থাকলে অবশ্যই হাসপাতালে নিবেন কারন যে কোন সময় ভেন্টিলেটর লাগতে পারে। রিস্ক গ্রুপের অন্তর্ভুক্তরা ডাক্তারের পরামর্শে কিছু বেজলাইন পরীক্ষা করিয়ে রাখতে পারেন।
আমি সেরে উঠছি, ইনশাআল্লাহ আপনারাও সুস্থ হয়ে যাবেন। মনে রাখবেন করোনা আক্রান্ত ৯৭% মানুষই সুস্থ হয়ে যান যাদের ৮০% এরই তেমন কোন চিকিৎসা লাগে না।
তাই ভয় নয় সাহস দিয়ে করোনাকে জয় করুন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে এই মহামারি থেকে রক্ষা করুন।”

ডা. শাকিলের মানবিক দৃঢ়তার মাধ্যমে অচেনা, অদেখা, এই মরণঘাতী ভাইরাসকে জয় করার গল্প অনুপ্রাণিত করবে করোনা যুদ্ধরত বহু যোদ্ধাকে।

Ruhana Auroni

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

কোভিড-১৯: আরো ৪৫ জনের মৃত্যু, নতুন শনাক্ত ৩১৭১ জন

Tue Jun 9 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, মঙ্গলবার, ৯ জুন, ২০২০ গত ২৪ ঘন্টায় বাংলাদেশে কোভিড-১৯ এ নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন ৩১৭১ জন, মৃত্যুবরণ করেছেন আরো ৪৫ জন ও আরোগ্য লাভ করেছেন ৭৭৭ জন। এ নিয়ে দেশে মোট শনাক্ত রোগী ৭১,৬৭৫ জন, মোট মৃতের সংখ্যা ৯৭৫ জন এবং সুস্থ হয়েছেন মোট ১৫,৩৩৬ জন। দুপুর ০২.৩০ […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo