কিডনি প্রতিস্থাপনের সম্ভাবনাময় দিকসমূহ

মঙ্গলবার, ১৩ অক্টোবর, ২০২০

যদিও বিষয়টা অনেকটা কাকতালীয় তথাপি “ক্রনিক রেনাল ডিজিজ” এর রোগীরা বিভিন্ন ধরনের প্রেজেন্টেশন নিয়ে আসেন। এমনই একজন রোগীর অভিজ্ঞতা আজ আপনার সাথে শেয়ার করছি। তবে সেটা স্বদেশে নয় বিদেশের মাটিতে।

আমার একজন কাজিন সেই ১৯৯১ সনে লন্ডন চলে যায়। সেখানে সে আন্ডার গ্রাজ্যুয়েশন কমপ্লিট করে এবং বর্তমানে সে লন্ডনে সফট্ ওয়ার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে জব করছে। আমার সাথে একটা সময় খুব ঘনিষ্ঠ থাকলেও পরবর্তীতে ও বিদেশে চলে যাওয়ায় এবং চাকুরীর শুরুর দিকে আমিও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পোস্টেট থাকায় এবং পরবর্তীতে আমিও প্রবাসে পাড়ি জমানোর জন্য আমাদের মাঝে অনেক দিনের কমিউনিকেশন গ্যাপ হয়ে যায়।

যা হোক, গতকাল আমি ওর বড় ভাইয়ের কাছে জানতে পারলাম, কিছুদিন আগে অর্থাৎ গত বছর অক্টোবর মাসে ছোট ভাইয়ের কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা হয়েছে। হঠাৎ করে এ রকম একটা খবর শুনবো আশা করিনি। ও আরো বললো, আব্বুর যেমন কিডনির সমস্যা ছিলো, ওরও একই সমস্যা ধরা পড়েছিলো। আমার তখন মনে পড়লো, আমার এই কাকার পলিসিস্টিক কিডনি ডিজিজ ছিলো।
পলিসিস্টক কিডনী ডিজিজ। একটি জেনেটিক ডিজিজ (AD) আর সেই কারণে আমার কাজিনও এফেক্টেড।

এ জন্য একটা সময় উনি খুব সাফার করেছেন। আমার কাজিনরা ছোটো ছোটো। কাকাই সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। আর সংসারের কর্তাব্যক্তিটি যদি অসুস্থ হয়ে পড়েন তা হলে সংসারের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। আমার তখন মনে পড়লো, ১৯৮৩ সনের দিকে কাকার কিডনির সমস্যা ধরা পড়ে। কাকা তখন প্রফেসর হারুন উর রশীদ স্যারের আন্ডারে শাহবাগস্থ তদানিন্তন পিজি হাসপাতালে ভর্তি হন। প্রথম দিকে ওনার পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস করা হতো। পরে এনআইসিভিডি যেয়ে ওনার হাতে এভি সান্ট করা হয়। এরপর ওনি যতোদিন বেঁচে ছিলেন তৎকালীন পিজি হাসপাতালে নিয়মিত হিমো-ডায়ালাইসিস করাতেন।

যা হোক, সন্ধ্যায় লন্ডনস্থ আমার কাজিনের সাথে (কিডনীর রোগী) কথা বলে জানতে পারলাম। ও গত কিছুদিন যাবৎ কিডনি সমস্যায় ভুগছিলো। ওরও Polycystic kidney disease ধরা পড়ে। তখন ওর থ্রু ইনভেস্টিগেশন করার পর কিডনি ট্রান্সপ্লানটেশন এর পরামর্শ দিয়েছে। সেই সাথে, ওর সমস্ত ইনফরমেশন ন্যাশনাল মেডিক্যাল ডাটা বেস এ সংরক্ষণ করে রাখা হয়। ওকে সাপোর্টিভ ট্রিটম্যান দেয়া হয় এবং হাসপাতাল হতে জানানো হয় যে, ডোনার পেলে আমরা আপনাকে কল করলো।

গত বছর অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে মধ্য রাতে হাসপাতাল হতে কল আসে।পরদিন সকালে ওর একটি প্রেজেন্টেশন থাকায় ঐ রাতে ও মোবাইল সাইলেন্ট করে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। হাসপাতাল হতে ওকে মোবাইলে না পেয়ে ওর ওয়াইফকে কল করে। ভাবী টেলিফোন রিসিভ করলে ওনাকে জানানো হয় যে, ওনারা হাসপাতাল থেকে কল করেছেন। আপনার স্বামীর সাথে কথা বলতে চাই। এরপর হাসপাতালের কন্সালটেন্ট জানান যে, একটি কিডনি পাওয়া গিয়েছে, ডোনারের সাথে আপনার কিডনির ম্যাচিং হয়েছে। সুতরাং আপনি দ্রুত হাসপাতালে চলে আসুন।

এ ধরণের একটা নিউজের জন্য সে মূহুর্তেও মানসিক ভাবে প্রস্তুতও ছিলো না। আবার শরীরটাও গত কিছুদিন যাবৎ ভালো যাচ্ছিলো না। চিকিৎসকরা অলরেডি জানিয়ে দিয়েছেন, বেঁচে থাকতে হলে অপারেশনের কোনো বিকল্পও নেই। সম্পূর্ণ বিষয়টা অনেকটা মেঘ না চাইতে বৃষ্টির মতো। অনেক আশা আর নিরাশার দোলায় মনটা দুলতে লাগলো। এক ঘন্টার মধ্যে সংশ্লিষ্ট কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট সেন্টারে যেয়ে পৌছালো। ওখানে পৌঁছানো মাত্র সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকগণ ওকে অপারেশন এর ইন্ডিকেশন, প্রসিডিওর, কমপ্লিকেশন ইত্যাদি বিষয়ে ব্রিফিং করেন। এবং ঐ রাতেই আনুমানিক ৪ঃ৩০ মিঃ এএম-এ অপারেশন শুরু হয়। দীর্ঘ ৬ থেকে সাড়ে ৬ ঘন্টা পর অপারেশন শেষ হয়। প্রসংগত উল্লেখ্য ও ইতিমধ্যে ওখানকার সিটিজেনশিপ পেয়ে যাওয়ায় NHS ওর চিকিৎসার যাবতীয় ব্যয় ভার বহন করে। আলহামদুলিল্লাহ, কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করার পর গত একবছর যাবৎ ওখানে ফলো আপ এ আছে এবং স্রষ্টার কৃপায় ভালো আছে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আলোচ্য ঘটনার মাধ্যমে আসলে আমি যে বিষয়টায় এটেনশন ড্র/ উল্লেখ করতে চাচ্ছি তা হলোঃ

১) আমাদের দেশেও যদি এ জাতীয় “ক্রনিক রেনাল ডিজিজ”-এর পেসেন্টদের জন্য একটা “ন্যাশনাল ডাটা বেইজ” থাকতো, তা হলে আমাদের দেশের রোগীরাও অনেক দ্রুত সেবা পেতো।

২) রোড ট্রাফিক এক্সিডেন্টে মৃত ব্যক্তির শরীর হতে অংগ সংগ্রহ করে এ জাতীয় “ক্রনিক রেনাল ডিজিজ” এর রোগীদের শরীরে প্রতিস্থাপন করতঃ চিকিৎসার জন্য আমাদের দেশেও আইন প্রণয়ন প্রয়োজন। (আমি জানি না “অংগ প্রতিস্থাপন সংক্রান্ত বিধিবিধান” কি অবস্থায় আছে)?
৩) এ ধরণের রেনাল ট্রান্সপ্লান্টেশনের মাধ্যমে আমাদের দেশের শত শত ক্রনিক রেনাল ডিজিজ এর রোগীদের নব জীবন দান করা সম্ভব।

এর জন্য আরো যা প্রয়োজন তা হলো, বাংলাদেশের রোগীদের বহির্গমনমুখিতা রোধ করা, সে জন্য প্রয়োজন পুরো হেলথ সিস্টেমের খোলনলচে বদলাতে হবে। রোগীর আস্থা অর্জনের জন্য চিকিৎসক এবং সহযোগী স্টাফদের আচরণে পরিবর্তন আনতে হবে, লজিস্টিক সাপ্লাই বাড়াতে হবে, স্পেশালাইজড সেন্টার সমূহে লোকবল বৃদ্ধি করতে হবে, দক্ষ জনবল তৈরী করতে হবে।
তাছাড়া ঢাকার বাহিরে কিডনী রোগীদের চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে প্রতিটি বিভাগীয় শহরে একটি করে কিডনী সেন্টার স্থাপনের উদ্যোগ নিতে হবে। আর রোগীদের সেবা দ্রুত করার লক্ষ্যে ন্যাশনাল কিডনি ফাউন্ডেশন এ জাতীয় রিসিপিয়েন্ট রোগীদের জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে একটি ন্যাশনাল পুল করতে পারেন এবং এ জন্য অংগ প্রতিস্থাপনের জন্য যদি আর কোনো প্রয়োজনীয় আইনী সংস্কারের প্রয়োজন হয় সে জন্য সরকারের উচ্চ মহলে প্রস্তাবনা রাখতে পারেন।

ডা. আজাদ হাসান
সিওমেক
ব্যাচ ২১

অংকন বনিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

কোভিড-১৯: আরো ৩১ জনের মৃত্যু, নতুন শনাক্ত ১৪৭২ জন

Tue Oct 13 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, সোমবার, ১২ অক্টোবর, ২০২০ গত ২৪ ঘণ্টায় বাংলাদেশে কোভিড-১৯ এ নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন ১,৪৭২ জন, মৃত্যুবরণ করেছেন আরো ৩১ জন এবং আরোগ্য লাভ করেছেন ১,৪৯৫ জন। এ নিয়ে দেশে মোট শনাক্ত রোগী ৩,৭৯,৭৩৮ জন, মোট মৃতের সংখ্যা ৫,৫৫৫ জন এবং সুস্থ হয়েছেন মোট ২,৯৪,৩৯১ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo