লক-ডাউন, মুভমেন্ট পাস এবং চিকিৎসক নিগ্রহ

শুক্রবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২১

১. ‘লক-ডাউন’ নামের কোন শব্দের অস্তিত্ব বাংলাদেশের আইনি কাঠামোর কোথাও নেই। তারপরেও ভিনদেশি শব্দটি অধুনা করোনাকালে আমাদের আইনি অধিকারের পরিধিতে ঢুকে পড়েছে এবং বহুল ব্যবহৃত হচ্ছে। আইনের পরিভাষায় বলা যায়- এটি একটি ‘misnomer’।

২. ‘লক- ডাউন’ শব্দের আইনি অস্তিত্ব না থাকলেও সরকারের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গণজমায়েত বা গণচলাচল নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা একটি সাংবিধানিক এখতিয়ার এবং বিভিন্ন আইনে সেটি অনুমোদিত। কিন্তু করোনা মহামারীকালীন ‘চলাচলে নিষেধাজ্ঞা’ যা বর্তমানে ‘লক-ডাউন’ নামে বহুল পরিচিত সেটি ঘোষণার আইনগত কর্তৃত্ব আসলে সরকারের কোন কর্তৃপক্ষের?

৩. বর্তমান যে ‘লক-ডাউন’ বা ‘চলাচল নিষেধাজ্ঞা’ চলছে সেটির ভিত্তি হচ্ছে কোভিড-১৯ এর বিস্তার রোধকল্পে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এর মাঠপ্রশাসন সমন্বয় অধিশাখা কর্তৃক জারিকৃত বিভিন্ন নির্দেশনা সম্বলিত প্রজ্ঞাপন। এই লক-ডাউন এর বাস্তবায়ন ও কার্যকরের দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছে আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর কাছে- প্রজ্ঞাপনের অনুলিপিমতে বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক হয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। লক-ডাউন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হচ্ছে ‘মোবাইল কোর্ট’- সেটির নেতৃত্বেও নির্বাহী বিভাগ। কিন্তু কোন্ আইন বা কর্তৃত্ববলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার লক- ডাউনের এই প্রজ্ঞাপন জারি করলো?

৪. চলাচল নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার প্রয়োজন পড়েছে কোভিড সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য। কোভিড কী? কোভিড একটি সংক্রামক রোগ। জেনে রাখি, সংক্রামক রোগের নিয়ন্ত্রণে কীভাবে সরকার কাজ করবে সেটির জন্য দেশে সুনির্দিষ্ট একটি আইন আছে। ব্রিটিশ আমলের কোন আইন নয়, বর্তমান সরকারই এই আইন প্রণয়ন করেছে, নাম- সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮।

৫. সংক্রামক রোগ আইন ২০১৮ তে চলাচলে নিষেধাজ্ঞাসহ বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপের ক্ষমতা সরকারকে দেওয়া হয়েছে। তবে এ আইন অনুযায়ী, এ ধরনের বিধিনিষেধ আরোপের কর্তৃত্ব মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নয়; স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের।

এই আইনের ধারা ৫(ণ) অনুযায়ী, স্বাস্থ্যের ডিজি (মহাপরিচালক) সংক্রামক রোগের বিস্তার রোধে কোনো বাজার, গণজমায়েত, স্টেশন, বিমানবন্দর, নৌ ও স্থলবন্দরগুলি সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করতে পারবে।

একই আইনের ধারা ৫(ত) অনুসারে, সংক্রামক রোগের বিস্তার রোধে উড়োজাহাজ, জাহাজ, জলযান, বাস, ট্রেন ও অন্যান্য যানবাহন দেশে আগমন, নির্গমন বা দেশের অভ্যন্তরে এক স্থান হতে অন্য স্থানে চলাচল নিষিদ্ধ করতে পারবে।

এছাড়াও, সংক্রামক রোগ ২০১৮ আইনের ১১ ধারায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক- কে যে কোন এলাকাকে সংক্রমিত এলাকা ঘোষণা করে সেখানে প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে।

৬. আশ্চর্যের ব্যাপার- মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের চলাচল নিষেধাজ্ঞার প্রজ্ঞাপনের কোথাও উল্লেখ নেই কোন আইনের প্রয়োগকল্পে এই প্রজ্ঞাপন জারি হচ্ছে! কেন নেই সেটি সহজেই অনুমেয়- সংক্রামক রোগ আইনের উল্লেখ করলে চলাচল নিষেধাজ্ঞা বা লক- ডাউনের যাবতীয় কর্তৃত্ব স্বাস্থ্য অধিদফতরের কাছে চলে আসতে আইনত বাধ্য।

৭. আইনানুযায়ী, করোনাকালীন লক-ডাউন বা চলাচল নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করার জন্য পরিচালিত মোবাইল কোর্ট-কে সময়ে সময়ে এখতিয়ার প্রদান করার কথা স্বাস্থ্য অধিদফতরের। সবকিছুর নিয়ন্ত্রণে থাকবে স্বাস্থ্য অধিদফতর। বর্তমানে লক- ডাউন অমান্যে সাজা দেওয়া হচ্ছে সংক্রামক রোগ আইনে কিন্তু মোবাইল কোর্ট কার্যক্রমের কোথাও স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংশ্লিষ্টতা দৃশ্যমান নেই, যথারীতি নির্বাহী বিভাগের তত্ত্বাবধান। অথচ এই আইনের ধারা- ৩০ অনুসারে আইন কার্যকরের জন্য ‘দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা’ বলতে বুঝানো হয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তাদের, নির্বাহী কর্মকর্তাদের নয়!

৮. আইন অনুসারে, পুলিশের কাজ সংক্রামক রোগ আইন ২০১৮ প্রয়োগে স্বাস্থ্য অধিদফতর-কে সহায়তা করা। স্বাস্থ্য কর্তৃত্ব হারিয়েছে, প্রটাগনিস্টের ভূমিকায় হাজির আমলাতন্ত্র। এই সুযোগে পুলিশও কিছু দৃশ্যমান ভূমিকা রাখতে চায়ঃ ‘মুভমেন্ট পাস’ – সেই আকুলতার ফলাফল।

৯. লক-ডাউন বা চলাচল নিষেধাজ্ঞায় আমলাতান্ত্রিক প্রজ্ঞাপনের মতো পুলিশের ‘মুভমেন্ট পাস’ এরও কোন আইনি ভিত্তি নেই। স্বয়ং আইজিপি-ই সেটি স্বীকার করেছেন। তাহলে যে বিষয়টির আইনি ভিত্তি নেই, সেটি লক-ডাউন কার্যকরে আইনত প্রয়োগ হয় কী করে? মুভমেন্ট পাস না থাকার দরুন কোন ব্যক্তি কীভাবে আইনত দণ্ডিত হতে পারে? তারপরেও মুভমেন্ট পাস আছে, কেন আছে সেটিও সহজেই অনুমেয়- ক্ষমতা, কর্তৃত্ব ও কৃতিত্বের সহজ অংশীদার হতে কে না চায়?

১০. কিন্তু আইনের শাসন কী চায়? শত বছর আগে প্রফেসর ডাইসী বলে গেছেন,

“আইনের শাসন বলতে বুঝায় যেখানে আইনের বাইরে কিছু ঘটবে না, যে যাই করুক তাঁকে আইন দেখাতে হবে, নিজেদের মর্জিমাফিক কিছু করার সুযোগ নেই; উদ্দেশ্য যতোই মহৎ হোক।”

এবং চিকিৎসক নিগ্রহ:

পুলিশ আর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক ‘লক-ডাউন’ বা চলাচল নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গের দায়ে চিকিৎসকদের অনেকেই নিগৃহীত হচ্ছেন- এমন অভিযোগ এসেছে। অথচ, আইনত, এই করোনা মহামারী মোকাবেলায়, সংক্রমণ রোগ আইন ২০১৮-র আওতায় বিধিনিষেধ ও চলাচল নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগে স্বাস্থ্য অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে ‘দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা’ হিসেবে এই চিকিৎসকদেরই থাকার কথা ছিল নায়কের ভূমিকায়। কিন্তু বেহাত বিপ্লব। চিকিৎসকদের এই দুর্দশার দায় কি কিছু তাদের নিজস্ব নয়? স্বাস্থ্য অধিদফতরের নয়? পুলিশ- নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক চিকিৎসক নিগ্রহ তাই রোগের উপসর্গ মাত্র, প্রতিবাদের কাঁথা দিয়ে ঢেকে এই জটিল রোগের সংক্রমণ ঠেকানো যাবে না।

সাঈদ আহসান খালিদ
সহকারী অধ্যাপক
আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

অংকন বনিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

করোনায় আক্রান্ত হয়ে না ফেরার দেশে NILMRC এর বর্তমান পরিচালক

Sat Apr 24 , 2021
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৪ এপ্রিল, শনিবার, ২০২১   করোনা মহামারীতে এবার শহীদ হলেন দেশে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধের অন্যতম যোদ্ধা, একজন মহীরুহ, জনস্বাস্থ্যের একজন নক্ষত্র, ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন এন্ড রেফারেল সেন্টার ( NILMRC) এর সম্মানিত পরিচালক, সিডিসি’র এবং আইইডিসিআর এর সাবেক পরিচালক, অণুজীববিদ, অধ্যাপক ডা. এ কে এম শামছুজ্জামান।(ইন্নালিল্লাহি ওয়া […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo