লক ডাউন আর লক খোলা

১৮ মে, ২০২০, সোমবার
ডা. মাহবুব মুতানাব্বি
সহযোগী অধ্যাপক, শিশু বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

গত কিছুদিন ধরে আমাদের দেশে লক খোলা আর বন্ধ করা নিয়ে ভীষণ টানাটানি চলছে। একদল জোরে চেপে লক বন্ধ করতে চাচ্ছে।

‘ও গো আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।’

আরেক দল উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছে,

‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি, নিয়ে যাবি কে আমারে?’


আসলে লকডাউন প্রক্রিয়াটা নিয়ে আমাদের ধারণা খুব স্পষ্ট নয়। অনেকেরই ধারণা, কিছুদিন ঘরে বসে থাকলে ভাইরাস নির্মূল হয়ে যাবে। এরপর কোথায় যাবেন, কোন হোটেলের বিরিয়ানি খাবেন এমন ছকও অনেকে তৈরী করছেন। তাঁদের হয়তো জানা নেই এটি শতাব্দীপ্রাচীন একটি পদ্ধতি। ১৯১৮ সনের মহামারীতে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করার পরও দুই বছরের বেশি স্থায়ী হয়েছিল এ রোগ। সম্ভবত পাঁচ কোটি লোক এতে মারা পড়ে। কাজেই এই প্রাচীন পন্থা অবলম্বন করে ঘরে বসে কাচ্চি খাওয়ার প্ল্যান করলে করোনা চলে যাবে, এটা আমাদের পক্ষেই ভাবা সম্ভব।

প্রকৃতপক্ষে লকডাউন হচ্ছে, সময় ক্রয় করা। ‘To buy time.’ প্রক্রিয়াটাকে বলা হয় ফ্ল্যাটেনিং দ্য কার্ভ। যত দ্রুত গতিতে সংক্রমণ বা মৃত্যু হচ্ছে তা কমানো। এতে প্রকৃত মৃত্যুসংখ্যা কমবে কিনা? হ্যাঁ, কমতে পারে। এক সময়ে অনেক রোগী না হওয়ায় স্বাস্থ্যব্যবস্থার উপর চাপ কমবে। কিছুটা হলেও যথাযথ চিকিৎসা হবে, যা অতিরিক্ত চাপে সম্ভব না। মধ্যবর্তী সময়ে ঝড়ের বেগে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দক্ষতা ও ধারণক্ষমতা বাড়ানো যেতে পারে, যাতে লকডাউন পরবর্তী আকস্মিক ঊর্ধ্বস্রোত থামানো যায়। তবে টিকা হাতে না পাওয়া পর্যন্ত এ রকম লকডাউন ফাঁক দিয়ে দিয়ে অনেকবারই করা লাগতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ, চীনের কিছু প্রদেশ আবার লকডাউনে চলে গেছে। হ্যাঁ, টিকা ছাড়াও একসময় সংক্রমণ কমতে পারে। যদি জনসংখ্যার অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ আক্রান্ত হয় (আমাদের প্রায় বারো কোটি )।এক পত্রিকা হার্ড ইমিউনিটির অনুবাদ করেছে শক্ত ইমিউনিটি। আসলেই এটা অর্জন করা শক্ত। এছাড়া বিকল্প আশাবাদ হচ্ছে, অলৌকিক ভাবে ভাইরাসের কোনো জিনগত পরিবর্তনে যদি সেটা দুর্বল হয়ে যায়।

তবে কি খুব বেশি আশা নেই? আমি আশাবাদী মানুষ। একটা চূড়ান্ত প্রস্তুতি লকডাউনের মধ্যে হয়ে গেলে, ভাইরাস আক্রমণ করলেও হয়তো মৃত্যুহার সাংবাৎসরিক ইনফ্লুয়েঞ্জার মত একটা মাত্রায় রাখা যাবে। আমরা এ সুযোগ কাজে লাগালে হয়তো একটা শক্ত স্বাস্থ্য অবকাঠামো ও ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠবে। যেসব কর্তাব্যক্তিরা বিপদে পড়ে দেশে চিকিৎসা নিচ্ছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই এখন বুঝতে পারছেন স্বাস্থ্যব্যবস্থার নড়বড়ে অবস্থা। অনেক অফিস পুরো শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। আর বিপদে পড়লে আপনি যেখানে যাবেন, সেখানে তা করেন নি। কিন্তু এবার তো বিমান চলাচল বন্ধ থাকায় আপনাকেও সেখানে যেতে হল। এবার একটু ভাবুন।আপনার উসিলায় যদি হাসপাতালের উন্নতি হয়, সলিমুদ্দি -কালিমুদ্দিও সে সুবিধা পাবে।

সামনে কি হবে আমরা কেউ জানি না। লক ডাউন না লক খোলা তাও স্পষ্ট নয়। সরকারি অফিস বন্ধ। শিমুলিয়া ঘাট পুরা লক খোলা। অবশ্য আমাদের বেশির ভাগ কাজই মিশ্র। হরতাল ও করি। আবার রিকশা, গাড়িও চলে। ব্যাকডোরে দোকান ও খোলা থাকে। মানে ব্যাকডোরে হরতাল। মাস্ক পরি। আবার ফাঁকে আঙুল ঢুকিয়ে নাক চুলকাই। কারো কারো মাস্ক একদিকের কান থেকে ঝোলে। মাস্ক আছেও, আবার মাস্ক নাইও। সেরকমই লক খুলে লকডাউন।

ব্যতিক্রমী কিছু কাজ আমরা এদেশেই করি। ডাক্তার করোনা রোগী দেখে আসলে ইট মারি। একটু আগেই নেটে দেখলাম, ভারতে ডাক্তার বিজয়াদাশ ডিউটি করে বাড়ি ফেরার পর চতুর্দিকের বহুতল বিল্ডিং থেকে মুহুর্মুহু করতালি আর হর্ষধ্বনিতে তিনি বাড়ির সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কেঁদে ফেলেন।

আমরা মাদ্রাসার তালেব এলেমদের তাচ্ছিল্য করি। ইংরেজি জানে না, মুষ্টিচাল খোঁজে। লাশের জানাযা পড়ার সময় দেখি, তারাই আছে। আমি প্রগতিশীল। আড়ং থেকে পাঞ্জাবি কিনে বাসায় ফিরে স্ট্যাটাস দেই, ‘কি যে একটা নেশান? সীমিত পরিসর কথাটার অর্থই বোঝে না।’ আমরা পুলিশকে সারাক্ষণ গালাগালি করি। প্রিয়জন মারা গেলে লাশ ফেলে পালাই। পুলিশ এসে কবর দেয়। লাশ কবর দিতে গেলে মসজিদের খাট লুকিয়ে রাখি। এরা যদি অধার্মিক না হয়, তাহলে আর অধার্মিক কে? জনস্বাস্থ্যবিজ্ঞানীরা বলছেন, কয়েকঘন্টার বেশি মৃতদেহে ভাইরাস টিকতে পারে না।

সবশেষে একটা কথা, যাঁরা পত্রিকায়, মিডিয়ায় প্রচার করছেন, ম্যালেরিয়ার ওষুধ খেলে করোনা শেষ অথবা খাজলি গোটার ওষুধ দুটো খেলে করোনা চিরবিদায়। তারা কি কারো কোনো উপকার করছেন? মিডিয়ার খবর দেখলে মনে হয়, টিকা তৈরী। বাংলাদেশে আসার খালি অপেক্ষা। সরাসরি চিকিৎসা সংক্রান্ত খবর যাচাই না করে যত কম দেয়া যায়, ততোই ভালো। এতে ফলস্ সেন্স অব সিকিউরিটি বাড়বে।

Platform

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় 'আম্পান', চ্যালেঞ্জ নিতে পারবে কি বাংলাদেশ?

Mon May 18 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ ডেস্ক, ১৮ মে ২০২০, সোমবার করোনা সংকটকালীন এমন এক সময়ে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে, যখন বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষকে করোনাভাইরাস মহামারী সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার পুরো সক্ষমতাই বলতে গেলে লড়ছে মহামারি সামলাতে। ‘আম্পান’ বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১২০০ কিলোমিটার দূরে এবং উওর-পশ্চিমে এগিয়ে আসায় সমুদ্রবন্দরগুলোকে ৪ […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo