রক্তদান_না_জীবনদান?

রক্তদান_না_জীবনদান? ( রোগী কথন ১০ )১.
তখন ফিফথ ইয়ারে পড়ি। মেডিসিনে হুমায়ুন স্যারের ইউনিটে প্লেসমেন্ট। স্যার শান্ত, সৌম্য, প্রশান্তির এক অসাধারণ কম্বিনেশন।
যখন স্যার পড়াতেন, আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো স্যার কে ফলো করতাম। সব রোগীর জন্যই স্যারের মমতা ছিল দেখার মতো।

একদিন এক শীর্ণকায় দরিদ্র রোগীকে দেখিয়ে বল্লেন,
এর রক্ত লাগবে। তোমরা কে ম্যানেজ করতে পারবে?

মেডিসিন ক্লাব করতাম। ব্লাড যোগার করতে পারব শুনে স্যার খুব খুশি হলেন। স্যার কিছু ঔষধ দিলেন, যা উনার কাছে স্যাম্পল হিসাবে ছিল, মেডিসিন ক্লাব থেকে এক্সচেঞ্জ করে ঐ রোগীকে দেয়ার জন্য।

এখানে প্রাসঙ্গীক ভাবে একটা কথা বলে রাখি, মেডিসিন  ক্লাব নিরাপদ রক্ত সঞ্চালন নিয়ে কাজ করে। অন্যের দান করা রক্ত একইভাবে রোগী কে দান করা হয়। রক্ত বিক্রয়যোগ্য নয়। বরং রক্ত বিক্রি দন্ডনীয় অপরাধ।, ঔষধ এক্সচেঞ্জ করে। এই অধম মেডিসিন ক্লাবের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলাম। প্রায় প্রতিটা মেডিকেল কলেজেই এর কার্যক্রম আছে। এটা সম্পূর্ন মেডিকেল স্টুডেন্টদের স্বেচ্ছা শ্রমে পরিচালিত হয়।

ঐ রোগীর কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই স্যার বল্লেন,
matted tubercular lymhadenopathy (মারাত্মক যক্ষা রোগ) খুব খারাপ অবস্থা। হয়তো কয়েকটা দিন বাঁচবে…

স্যারের কন্ঠে সেই হাড্ডিসার রোগিটার জন্য কেমন যেন একটা হাহাকার ঝরে পড়ল।

হবু ডাক্তারের স্বভাব সুলভ বিহবলতায় স্যারকে বল্লাম,
যে মরে যাবে তার জন্য এগুলো করে কি হবে স্যার?

স্যার আমার কথায় একটু ও রাগ না হয়ে স্নেহ মাখা কন্ঠে বল্লেন, হয়তো বেশিদিন নাই, তবে যে কটা দিন বাঁচে। দেখছ তো কত গরীব! রক্ত,ঔষধ কিছুই কেনার ক্ষমতা নাই। এগুলো পেয়ে যদি শেষ কটা দিন ভালো থাকে…

এই হচ্ছেন আমাদের হুমায়ুন স্যার। আমার প্রিয় শিক্ষক, আমাদের প্রিয় শিক্ষক। জীবনে অনেককে, অনেক সময় রক্ত দিয়েছি। সেগুলো তেমন মনে নেই, তবে ঐ রোগির কথা এখনো মনে আছে।

২.
ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। এনাটমির ডেমো ক্লাস চলছে। এক সিনিয়র হাজির।

নাহার ও পজিটিভ নাহ্?

হুম ভাইয়া।

তাড়াতাড়ি আসো, ইমার্জেন্সী রক্ত লাগবে, রোগী ওটিতে, প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছে…

ভাইয়া আরো কী কী যেনো বলছেন। আমি সেসব শুনছি না। আমি কেবলই রোগীর মুখটা আঁকার চেষ্টা করছি…

একটা রক্তশূন্য সাদাটে নির্জীব মুখ। তির তির করে কাঁপা ঠোঁট… আস্তে আস্তে করে…লালচে আভা ছড়িয়ে পরছে… রক্তের আভা… আমার রক্ত….একটু একটু করে খুলে যাচ্ছে বন্ধ চোখের পাতা…ঘোলাটে চোখে বেঁচে ফেরার চাপা ঔজ্বল্য…

আমি কেমন যেনো ঘোরের মধ্যে পরে গেলাম। প্রথম বার রক্ত দেয়ার ভয়, বিহ্বলতা, সব সেই রোগীর অবয়বে যেয়ে মিশে গিয়েছিল যেনো। মানুষ হয়ে জন্মাবার জন্য কৃতজ্ঞতা তখনি প্রথম জানিয়েছিলাম স্রষ্টাকে।

৩.
ইন্টার্ণের সময়। এক ইয়ারমেটের বোনের সিজারের এ্যাসিস্ট করছি। হঠাৎ রক্তের প্রয়োজন হলো। রক্ত আনতে সময় লাগবে। নিজেই ওটির পাশের রেস্ট রুমে শুয়ে পরলাম। রক্ত ড্র করলেন আমাদেরই আরেকজন। এমন কত বার! কতশত ডাক্তার একই কাজ করেন। মূলত ইন্টার্ণের সময় তো অহরহ।

এই গল্পগুলো করতে চাইনা। অহং প্রকাশ পায় বলে। কেউ যদি কিছু মনে করে? কিন্তু আজ কেন যেনো মনে হলো আপনাদের সাথে শেয়ার করি। যদি কেউ এতে উদ্বুদ্ধ হয়। রক্ত দিতে এগিয়ে আসে।

আসুন কিছু রক্তদান সম্পর্কিত তথ্য জেনে নেই-

* কে রক্ত দিতে পারবে?
একজন সুস্থ্য সবল মানুষ যার বয়স ১৫-৬০ বছর।

* কত দিন পর পর?
প্রতি তিন মাস পর পর।

* রক্ত দিলে কোন সমস্যা হয়?
না, বরং একজন মানুষের জন্য কিছু করতে পারার আনন্দে মন ভরে থাকে।

*কোন সাইড ইফেক্ট আছে কি?
না, তবে কারো কারো একটু ঝিমঝিম, হাল্কা মাথা ঘোরার মতো হতে পারে। কিছুক্ষন বালিশ ছাড়া পায়ের দিকটা উঁচু করে শুলে, এক/দুই গ্লাস পানি বা পানীয় খেলে ঠিক হয়ে যায়।

* রক্ত দিলে শরীরের রক্ত কমে যায়?
না। এই রক্ত প্রতিনিয়ত তৈরী হয় এবং ভেঙ্গে যায়। কাজেই আপনি রক্ত না দিলেও এটা ন্যাচারালি নষ্ট হয়ে যাবে।

ভাবুন তো আপনার রক্তে ধ্বনিত হচ্ছে অন্যের হৃৎপিন্ড। ব্যাপারটা কেমন, নাহ্!? আমার তো মনেহয়, কী অদ্ভূত! কী অদ্ভূত!

তাই বলছিলাম কী, রক্ত সঞ্চয় করুন। ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। এই সঞ্চয় আপনি রক্তদানের মাধ্যমে করতে পারেন। প্রতিটা সেন্টারেই রক্তদাতাকে ডোনার কার্ড দেয়। যেটা দেখিয়ে নিজের ও প্রিয়জনের প্রয়োজনে রক্ত যোগার করা যায়। অনেকে হয়তো অনেক কিছুই দান করেন। নিঃসন্দেহে রক্তদান অন্যান্য যে কোন দানের চেয়ে শ্রেয়।

ডা. ছাবিকুন নাহার
মেডিকেল অফিসার
ঢাকা মেডিকেল কলেজজ, ঢাকা।
#Lady_in_Red

ফিচার রাইটার: জামিল সিদ্দিকী
শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ,গাজীপুর
সেশন: ২০১৫-১৬

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

শিশু স্বাস্থ্য ও রোগ প্রতিরোধে মাতৃদুগ্ধ

Sun Aug 12 , 2018
  শিশুর জন্মের পর থেকে ছয় মাস বয়স পর্যন্ত পুষ্টি মেটাবার জন্য আদর্শ সুষম খাদ্য হচ্ছে তার মায়ের বুকের দুধ । এ বিষয়ে আজ আর কোন সন্দেহ নেই । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপ অনুযায়ী আজ আমরা একথা জানতে পেরেছি । যেসব শিশু বোতলে করে গরুর দুধ ,গুড়ো দুধ, বা অন্যান্য […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo