শিশু স্বাস্থ্য ও রোগ প্রতিরোধে মাতৃদুগ্ধ

 

শিশুর জন্মের পর থেকে ছয় মাস বয়স পর্যন্ত পুষ্টি মেটাবার জন্য আদর্শ সুষম খাদ্য হচ্ছে তার মায়ের বুকের দুধ । এ বিষয়ে আজ আর কোন সন্দেহ নেই । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপ অনুযায়ী আজ আমরা একথা জানতে পেরেছি । যেসব শিশু বোতলে করে গরুর দুধ ,গুড়ো দুধ, বা অন্যান্য খাবার খায়,তাদের তুলনায় যেসব শিশু বুকের দুধ খায় তারা রোগব্যধি ও অপুষ্টিতে কম ভোগে । ছয় মাস বয়স পর্যন্ত সকল শিশুকে কেবলমাত্র বুকের দুধ খাওয়ালে প্রতিবছর সারা পৃথিবীতে ১০ লাখেরও বেশী শিশুকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব ।( সূত্র: স্বাস্থ্য তথ্য । পৃষ্ঠা -১৭ ।)হয়ত মনে সন্দেহ জাগতে পারে যে শুধুমাত্র মায়ের বুকের দুধে কিভাবে একটি শিশুর শরীরের সম্পূর্ণভাবে পুষ্টিসাধন হতে পারে । জবাবে বলা যায়,মায়ের দুধ শিশুর জন্যই তৈরী । সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় প্রাকৃতিক নিয়মে শিশুর দেহের পুষ্টি ও বৃদ্ধির জন্য যে খাদ্যউপাদান যতোটা দরকার ,মায়ের দুধে ঠিক ক ততোটাই আছে । শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও স্বাস্থের জন্য অন্য কোন খাবারের চেয়ে মায়ের দুধই সর্বোৎকৃষ্ট ।কারণ মায়ের দুধের শতকরা একশভাগই শিশুর শরীরের কাজে লাগে । যা কিনা কৌটাজাত দুধ বা অন্যান্য খাবারের বেলায় হয়না । ঐসব খাবারে শিশুর শরীরের প্রয়োজন নেই এবং সহজে সহজপাচ্য নয় এমন সব উপাদানে সমৃদ্ধ থাকে গরম ও শুকনো আবহাওয়াতেও মায়ের দুধে শিশুর শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় যথেষ্ট পানি থাকে । তাই পিপাসায় মেটাবার জন্য শিশুকে পানি অথবা কোনরকম শরবৎ খওয়ানোর দরকার হয়না । বরং এগুলো শিশুর ক্ষতি করতে পারে পানি অথবা শরবত দেওয়া হলে শিশুর ডায়রিয়া ও অন্যান্য রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায় ।অপরদিকে মায়ের দুধ বিশুদ্ধ ও নিরাপদ । মায়ের দুধ পান করে শিশু পূর্ণ তৃপ্তি লাভ করে ও প্রফুল্ল থাকে । এছাড়া মায়ের দুধ পান করার সময় মা ও শিশুর মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে । মায়ের দুধ সহজলভ্য এবং অন্যান্য শিশুখাদ্যের মত টাকা দিয়ে কিনতে হয়না । অবশ্য ছয় মাস পূর্ণ হওয়ার পর শিশুর বাড়তি খাবার ও পানীয় দরকার হয় । যদি ওজন নিয়ে দেখা যায় যে শিশু ঠিকমতত বাড়ছেনা,তবে তাকে আরও ঘন ঘন বুকের দুধ খাওয়াতে হবে ।।। । ঘন ঘন বুকের দুধ খাওয়ানো সত্বেও যদি শিশুর ওজন ঠিকমতত না বাড়ে তবে তাকে স্বাস্থ্যকর্মী বা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে । এছাড়া একবছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত অন্যান্য খাবার দেওয়ার আগে প্রতিবার শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে হবে ।এবং দুই বছর বয়স পর্যন্ত এবং সম্ভব হলে এরপরও শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো চালিয়ে যেতে হবে ।
শিশুদের রোগ প্রতিরোধে মায়ের দুধ বিশেষ ভুমিকা পালন করে ।শিশুর জন্মের পর মায়ের বুক থেকে প্রথম যে ঘন ও হালকা হলুদ বর্ণের দুধ নিঃসৃত হয়,তাকে শালদুধ বলে ।একটু হলুদ বর্ণের ও আঠাল ধরনের বলে আগে ,অনেকেই খারাপ দুধ মনে করে ফেলে দিতেন ।বর্তমানে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমের কারণে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং মায়েরা এর উপকারিতা বুঝতে পেরেছে । সত্যি কথা বলতে এই শালদুধ শিশুর প্রথম টিকাা ।এবং বুকের দুধ খাওয়ালে শিশুর ডায়রিয়া,সর্দিকাশী সহ অন্যান্য সাধারণ রোগব্যাধি হয়না ।বুকের দুধের পরিবর্তে শিশুকে বোতলে করে গুড়ো দুধ বা অন্যান্য খাবার যেমন চালের গুড়ো ,সুজী ইত্যাদি খাওয়ালে শিশুর ঘন ঘন ডায়রিয়া হওয়ার আশঙ্কা থাকে ।এবং যত ঘন ঘন শিশু অসুস্থ হবে ততো বেশী সে দুর্বল হবে এবং তার মৃত্যুর ঝুকিও বেড়ে যাবে । অর্থাৎ এক কথায় বলা যায় – মায়ের দুধের বিকল্প নেই ।কারণ মায়ের দুধ পাঁচ মাস বয়স পর্যন্ত শিশুর পরিপূর্ণ পুষ্টি ও সেইসাথে রোগ প্রতিরোধক সাহায্য করে ।
অনেক মা মনে করেন তাদের বুকে যথেষ্ট দুধ নেই এজন্য ছয় মাস বয়স না হতেই তারা শিশুকে অন্যান্য খাবার খেতে দেন ।আর অন্য খাবার পেলে শিশু আর ঘন ঘন স্তন চোষেনা । এতে করে মায়ের বুকে দুধ কমে যায় ।এই ধরনের ঘটনা রোধ করার জন্য মাকে বোঝাতে হবে যে শুধুমাত্র বুকের দুধই শিশুর জন্য যথেষ্ট । এ ব্যাপারে বাড়ীর সদস্যগন যেমন ,স্বামী , মা , শাশুড়ী ,পাড়াপড়শী ,বন্ধুবান্ধব,স্বাস্থ্যকর্মী ও বিভিন্ন মহিলা সংগঠনের কর্মীরা মাকে সাহায্য সহযোগীতা দিতে পারেন ।আর একটি কথা মনে রাখতে হবে শিশুকে ঘন ঘন স্তন চুষতে দিলে মায়ের বুকে যথেষ্ট দুধ তৈরী হয় । জন্মের পর থেকেই,শিশু যখনই চাইবে তখনই তাকে স্তন চুষতে দিতে হবে ।আবার ঘন ঘন চুষতে দিলে স্তন ফুলে ভারী হয়না ।এবং স্তনের ব্যাথাও সেরে যায় ।
এছাড়া ছয় মাস পূর্ণ হওয়ার আগে বাড়তি খাবার হিসাবে শিশুর ,গুড়ো দুধ,শিশুর ফর্মুলা,পানি বা শরবতের প্রয়োজন নেই । শিশুকে বাড়তি খাবার খাওয়ালে সে বুকের দুধ কম খাবে । আবার বোতলে করে অন্য খাবার খাওয়ালে সে বুকের দুধ কম খাবে । এবং তাতে মায়ের বুকের দুধ কমে যাবে । আবার বোতলে করে অন্য খাবার খাওয়ালে শিশু মায়ের দুধ খাওয়া একেবারেই বন্ধ করে দিতে পারে । কারণ বোতল ও স্তন চোষার পার্থক্য আছে । বোতল চোষা এবং স্তন চোষা নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়লে শিশু মায়ের দুধ কম খেতে পারে । ফলে মায়ের দুধ কমে যেতে পারে । এসব বিষয়গুলো একজন মাকে মনে রাখতে হবে ।অর্থাৎ একজন মা ‘কে তার শিশুর সঠিক পরিচর্যা,স্বাস্থ্য ও রোগ প্রতিরোধের কথা ভেবে যথেষ্ট ধৈর্য্যর পরিচয় দিতে হবে । এবং এই ব্যাপারে পরিবারের সকলকে মাকে সাহায্য করতে হরে । কারণ যে মা তার বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ান তার স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে প্রচুর খাবার ও বিশ্রাম দরকার ।স্বামীসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে করে মা প্রয়োজনমত খাবার এবং বিশ্রাম পান । এবং মাকে বেশী পরিশ্রমের কাজ থেকে রেহাই দিতে হবে । শিশুকে দুধ খাওয়ানোর সময় মা অনেকটা বিশ্রামের সুযোগ পান । এছাড়া স্তন্যদাত্রী মায়েদের খাবারের দিকেও একটু বিশেষ নজর দিতে হবে । শুধুমাত্র পরিমাণে বেশী হলে চলবেনা । খাবারের পুষ্টিমানের কথাও ভাবতে হবে এবং খাবার হতে হবে সুষম খাদ্য । মাকে প্রচুর পরিমানে দুধ পান করতে হবে । এছাড়া শরীরের চাহিদা অনুযায়ী খাবারের তালিকায় ভাত ,মাছ, মাংস,ডিম , শাকসবজী ফলমুল,চিনি ,গুড় ,তেল ইত্যাদি সঠিক পরিমানে থাকতে হবে ।আবার মায়ের বুকের দুধ যেমন শিশুর জন্য উপকারী ,তেমনি শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ালে মায়ের স্তনে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে । এবং শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ালে প্রসবের পর ছয় মাস পর্যন্ত মোটামুটিভাবে মায়ের গর্ভধারণের সম্ভাবনা একেবারেই থাকেনা । মা শিশুকে যতবেশী বুকের দুধ খাওয়াবেন ,ততো দেরীতে তার মাসিক ফিরে আসবে ।অর্থাৎ পুনরায় গর্ভবতী হবার সম্ভাবনা কম । আর এতে করে মায়ের স্বাস্থ্য ও পারিবারিক সুখসাচ্ছন্দ নিশ্চিত করা যায় । কারণ কম সন্তান এবং সুস্থ সবল শিশুর পরিবারই সুখী পরিবার ।
তাই আজ আমাদের একান্তভাবে উপলব্ধি করার সময় এসেছে যে শিশুকে ছয় মাস পর্যন্ত মায়ের দুধ পান করানো উচিত ।এবং এর আর কোন বিকল্প নেই । কৌটার গুড়ো দুধের প্রচার যতই আমাদের আকর্ষন করুক না কেন,তাকে বর্জন করতে হবে । আধুনিক মায়েরা যারা শিশুদের বুকের দুধ খাওয়ানোর প্রতি অনিহা বোধ করেন ,তাদের সে মানসিকতা বর্জন করতে হবে । তবে চাকুরিজীবী মহিলাদের বেলায় কিছুটা অসুবিধা দেখা যায় । তবে সে ক্ষেত্রেও সমাধান খুঁজে বের করতে হবে । যেমন অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে সরকারী চাকুরিতে মহিলারা সন্তান প্রসবের আগে ও পরে তিন মাস গর্ভকালীন ছুটি ভোগ করবার সুবিধা পান । এছাড়া কাজের ফাঁকে ফাঁকে সন্তানকে দুধ খাওয়ানোর জন্যও তাদেরকে সুযোগ দিতে হবে । কর্মস্থলে শিশু পরিচর্যা কেন্দ্র তৈরী করতে হবে । এসব বিষয়ে কর্তৃপক্ষ ও শ্রমিক ইউনিয়নকে তাদের নিজ নিজ ভুমিকা পালন করতে হবে । এরপরও যদি সমস্যা থেকেই যায় তবে ছুটি শেষে চাকরিতে যোগদান করার পর মা’কে কষ্ট স্বীকার করে চাকুরীস্থল থেকে কিছুক্ষনের জন্য ছুটি নিয়ে সন্তানকে দুধ পান করিয়ে যেতে হবে অথবা বুকের দুধ টিপে পরিষ্কার পাত্রে বাড়ীতে রেখে আসতে হবে । এই দুধ আট ঘন্টা পর্যন্ত ভাল থাকে ।
ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শিশুকে শুধু মাত্র বুকের দুধ খাওয়ালে মোটামুটিভাবে তার সাধারণ রোগব্যাধির কোন আশঙ্কাই থাকেনা । তবে ছয়টি মারাত্মক রোগ থেকে শিশুকে রক্ষা করার জন্য জন্মের পর হতে এক বৎসর বয়সের মধ্যে শিশুকে ঐ ছয়টি রোগের বিরুদ্ধে অবশ্যই টিকাা দিতে হবে । ঐ রোগগুলো হচ্ছে – ডিপথেরিয়া,পোলিওমায়লাইটিস,ধনুষ্টঙ্কার,হুপিংকাশী ,হাম ও যক্ষা । ডি পি টি ,নামের টিকাা যথাক্রমে ডিপথেরিয়া হুপিংকাশী ও ধনুষ্টাঙ্কার রোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দেওয়া হয় ।এই টিকাা ইনজেকশানের মাধ্যমে দেওয়া হয় । আর পোলিও রোগের টিকাা মুখে খাওয়ানো হয় ।এই চারটি রোগের টিকার শিশুর ছয় সপ্তাহ বয়সের সময় থেকে একইসাথে দেওয়া হয় ।আর পরবর্তী দুটি ডোজ চার সপ্তাহ পর পর দেওয়া হয় । আর নয় মাস পূর্ণ হওয়ার পর হাম রোগের টিকাা দেওয়া হয় । আর যক্ষা রোগের টিকার জন্মের পরই দেওয়া যায় ।এবং এক বছর পূর্ণ হওয়ার ভেতর শিশুকে সবগুলো টিকাা অবশ্যই দিয়ে দিতে হবে ।
তাই পরিশেষে বলা যায় -শিশু ভুমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকেই ছয় মাস পর্যন্ত তার স্বাস্থ্য রক্ষা ও রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে একমাত্র মায়ের বুকের দুধই সহায়ক ভূমিকা পালন করে ।
শেষ ।

লেখিকা:

সওকত আরা বীথি। মিনিসোটা, ইউ.এস.এ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

অনিয়মটাই_যেখানে_নিয়ম.....

Mon Aug 13 , 2018
  ♣♣ একজন কন্সাল্টেন্ট তার মামাতো ভাইকে এনেছে দেখাতে।রুগীর সাথে কথা বলছি,এই সময় দরজা ঠেলে একজন ঢুকে পরলো।এই লোক আগেও বহুবার এমন করেছে।আজকে একটু বিরক্ত হয়েই বললাম, :রুগী দেখতেছি। :আমি স্টাফ। :আমি একজন ডাক্তারের রুগী দেখতেছি।তাছাড়া রুগী তো রুগীই তার প্রাইভেসী আছে। সেই লোক মুখ বিকৃত করে বলে গেলো, : […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo