বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবসঃ জাতীয় জলাতঙ্ক গাইডলাইন

লেখকঃ Lala Shourav Das

গতবছরের জুলাইয়ের দিকের কথা। ইন্টার্নশিপের অংশ হিসাবে কেজুয়ালিটিতে ডিউটি চলছে তখন। একদিন সন্ধ্যাবেলা ডিউটিরুমে বসে আছি আমি, সাথে আরেকজন সিনিয়র ভাইয়া। পেসেন্টের চাপ না থাকায় বসে বসে টিভি দেখছি। এমন সময় ওয়ার্ডবয় এসে খবর দিলো দুইটা বাচ্চা রোগী এসেছে। কেজুয়ালিটিতে বড়দের চিকিৎসার থেকেও খারাপ হল বাচ্চাদের চিকিৎসা করা। এরা সম্ভব হলে চিৎকার করে কানের পর্দা ফাটায়। তারপরেও নিতান্ত বাধ্য হয়েই পা বাড়ালাম।

ইমারজেন্সি রুমের ভিতরে ঢুকে আমার চক্ষু চড়কগাছ। দুটো বাচ্চার গাল, পিঠ আর হাত পায়ে শুধু কামড়ের দাগ! বাচ্চাগুলো সম্ভবত শকের কারনে কান্না করতেও ভুলে গেছে। বাচ্চার সাথের লোকজনকে জিজ্ঞেস জানলাম, এরা চাঁদপুর থেকে এসেছে। ওইখানে একটা এলাকায় এক কুকুর পাগল হয়ে সবাইকে কামড়ে দিচ্ছিল। বাচ্চাদুটো খেলার মাঠে গিয়ে সেই কুকুরের সামনে পড়ে গেছে। ওয়ার্ডবয়কে সাথে ডিউটিতে থাকা সিনিয়র ভাইকে ডাকতে বলে থার্ড ইয়ারের কমিউনিটি মেডিসিনের পাতায় কোনকালে পড়া রেবিস/জলাতঙ্ক রোগের চিকিৎসা মনে করার চেষ্টা চালালাম। এর আগে কখনো এরকম কেইস দেখা হয়নি আমার। দ্রুত যা মনে পড়ে তা দিয়েই রোগীর পার্টির কাছে কিছু জিনিসপত্র আনার লিস্ট ধরিয়ে দিলাম। ভাইয়া এসে সাথে রেবিস ভ্যাক্সিনের নামটা যোগ করলেন। ওয়ার্ড বয়ের কাছ থেকে তাৎক্ষণিক ভাবে নরমাল স্যালাইন এনে কামড়ের জায়গাগুলোতে ঢালা হল। এবার বাচ্চাগুলোর কান্না শুরু হল। মায়াদয়া না দেখিয়ে বেশ নির্মমভাবেই কামড়ের জায়গাগুলো জ্বালাময়ী সব সাবান, এন্টিসেপটিক সল্যুশন দিয়ে ওয়াশ করতে হল। এদের মুখের উপরে গালের চামড়াগুলো ক্ষতবিক্ষত। রোগীর মা বারবার বলতে লাগলেন, আমার মেয়ের গালটা অন্তত সেলাই করে ঠিক করে দেন। অনেক কষ্টে শেষ পর্যন্ত বুঝানো হল রোগীর চিকিৎসার স্বার্থেই রোগীর কোন ক্ষততে তাৎক্ষণিক ভাবে সেলাই করে দেয়া যাবে না। তবুও মায়ের কান্না আর থামে না। শেষমেশ ওয়াশ আর এন্টিরেবিস ভ্যাক্সিন দেয়া শেষ হবার পড়ে গ্লাভস খুলে মোবাইলটা বের করলাম। আর কোন কিছু বাদ পড়লো কিনা জানা দরকার। আরেক সিনিয়র ভাইয়াকে ফোন দিয়ে পুরো ঘটনা খুলে বলার পর গালে আর ঘাড়ে কামড়ের কথা শুনে তিনি ক্যাটাগরি-৩ রেবিস এক্সপোজার হিসাবে পেসেন্টকে রেবিস ভেক্সিনের সাথেসাথে রেবিস ইউমিনোগ্লবিউলিন দেয়া প্রয়োজন বলে ধারনা করলেন। এরপর আরেক বিপত্তি, এটা নাকি কুমিল্লায় পাওয়া যায় না। এমনকি ঢাকার অনেক নামীদামী ফার্মেসীতেও পাওয়া যায়না। শেষমেশ তিনি খোঁজ নিয়ে জানালেন, খুব সীমিত পর্যায়ে মহাখালীর সংক্রামক রোগ হাসপাতালে এটার সরবরাহ রয়েছে। পরে প্রাথমিক চিকিৎসা আর এন্টিরেবিস ভ্যাক্সিন দেয়ার পড়ে রেবিস ইউমিনোগ্লবিউলিন দেয়ার জন্য বাচ্চা দুটোকে সেখানে রেফার করা হল। আজ ২৮ সেপ্টেম্বর বিশ্ব জলাতঙ্ক রোগ দিবস। এই রোগ এমনই ভয়ঙ্কর যে একবার রোগের লক্ষন দেখা দিলে ধরে নিতে হয় মৃত্যু একশত ভাগ নিশ্চিত। এই পর্যন্ত পৃথিবীতে শুধুমাত্র ৭ জন ব্যাক্তি এই রোগ হবার পরে জীবিত ছিল, সেটাও সাথে সাথে ভ্যাক্সিন সহ আরও অন্যান্য চিকিৎসার জোরে। কিন্তু বাকিদের ভাগ্য এতো প্রসন্ন হয় না। এদের জন্য থাকে বেদনাদায়ক মৃত্যু। অথচ এই রোগ সঠিক চিকিৎসায় ১০০% ই প্রতিরোধযোগ্য। জলাতঙ্ক বা রেবিস নিয়ে অনেক কথাবার্তা হলেও এটাকে নিয়ে জানার কিছুটা দিকে এখনো ঘাটতি রয়ে গেছে। এর কিছুটা পূরণে রেবিস নিয়ে সংক্ষেপে কিছু কথা তুলে ধরছি। রেবিস/জলাতঙ্ক রোগ কি? – এটি একটি ভাইরাস সৃষ্ট রোগ। রেবিস ভাইরাস দিয়ে আক্রান্ত কুকুর, শিয়াল, নেকড়ে, বাদুড় এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে ঘোড়া এবং গরুর দেহ থেকে এটি মানুষকে আক্রান্ত করতে পারে। তবে ৯৬% ক্ষেত্রে কুকুর থেকেই (কুকুরের কামড় অথবা লালা থেকে) এই রোগ মানবদেহে প্রবেশ করে। ভাইরাসটি আক্রান্ত স্থানের নার্ভটিস্যুতে প্রবেশ করে এবং প্রতিদিন ১২-২৪মিমি করে ব্রেইন এবং স্পাইনাল কর্ডের দিকে এগুতে থাকে। রেবিস ভাইরাস একবার ব্রেন টিস্যুতে প্রবেশ করলে মৃত্যু নিশ্চিত। কামড়/আক্রান্ত হওয়া থেকে রোগের লক্ষন প্রকাশ পাওয়ার সময়কাল কয়েকদিন থেকে শুরু করে এক বছর পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু লক্ষন প্রকাশের ১ থেকে ৭ দিনের মাঝে রোগী যতই চিকিৎসা করা হোক না কেন, শেষমেশ মারাই যায়। তাই সংক্রামক পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার পরপরই লক্ষন প্রকাশের আগেভাগেই উপযুক্ত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়াই এই রোগের হাত থেকে বাঁচার উপায়। রোগে আক্রান্ত কুকুরের লক্ষন কি? – ১) কোন কারন ছাড়াই কামড় দেয়ার প্রবনতা। ২) কারন ছাড়াই ছুটাছুটি এবং গর্জনের প্রবণতা। ৩) মুখ দিয়ে ক্রমাগত লালাক্ষরণ হতে থাকা। আক্রান্ত রোগীর লক্ষন কি? – ১) আক্রান্ত জায়গায় প্রাথমিক ভাবে ব্যাথা এবং চিনচিনে অনুভূতি। ২) পানির প্রতি ভীতি (যে কারনে রোগের নাম জলাতঙ্ক)। ৩) অস্থিরতা, অতিরিক্ত লালাক্ষরণ, খিঁচুনি এবং সবশেষে মৃত্যু। কোন কুকুরের কামড় খেলে প্রাথমিক ভাবে কি করবেন? – টেপের পানি/নরমাল স্যালাইন হাতের কাছে যাই পান তা দিয়ে অন্তত ১৫ মিনিট ক্ষতস্থান পরিষ্কার করা। সাথে সাবান ব্যবহার করে যতটুকু সম্ভব ফেনা তুলে ক্ষতস্থানটি পরিষ্কার করা। এরপর পভিডন আয়োডিন অথবা ডেটল অথবা সেভ্লন সল্যুশন ব্যবহার করে ক্ষতস্থান আবারো পরিষ্কার করা। সবকিছুর প্রথমে নিজের সেফটির জন্য গ্লাভস পরে নিবেন অবশ্যই। যত দ্রুত সম্ভব, ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন। লেখার এই অংশটা মেডিক্যাল স্টুডেন্ট / আমার মতো অজ্ঞ ডাক্তারদের জন্যঃ কি মেসেজঃ – ওয়াশ, ওয়াশ এন্ড ওয়াশ। ক্ষতস্থানে কোন সেলাই দিবেন না। একটু দেরী করে সেকেন্ডারি ক্লোজার করাই ভালো। শুধু অতিরিক্ত রক্তপাত হলে সেটি বন্ধের ব্যবস্থা নিবেন। – ভ্যাক্সিন শিডিউলঃ ১) ইসেন শিডিউল অনুসারে ৫ দিন ৫ ডোজ। ডে-০, ডে-৩, ডে-৭, ডে-১৪ এবং ডে-২৮ এ ইন্ট্রামাস্কুলার ইঞ্জেক্সন। ২) জেগরেব শিডিউল অনুসারে ৩ দিনে ৪ ডোজ। ডে-০ তে দুই হাতে দুটো ডোজ তারপর ডে-৭ আর ডে-২১ এ আরেকটা ডোজ। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে জেগরেব শিডিউলকে আদর্শ ধরা হয়ছে। এই ভ্যাক্সিনগুলো সদর হাসপাতালে বিনামূল্যে পাওয়া যায়। আবার দোকানেও কিনতে মিলে। প্রেগন্যান্ট মহিলাকেও এটি দেয়া যাবে। – ইমিউনোগ্লবিউলিনঃ ক্যাটাগরি-৩ ইঞ্জুরির (মাল্টিপল বাইট, হাতের আঙুল, মুখ, গলা যেসব অংশে নার্ভ সাপ্লাই বেশী সেই সব জায়গায় কামড়) ক্ষেত্রে ভেক্সিনের সাথে ইমিউনোগ্লবুলিন দেয়া উচিৎ। প্রথম ডোজের ভ্যাক্সিন দেয়ার সাতদিনের মাঝেই এটা দিতে হবে। এটি ক্ষতস্থানে (২০IU/Kg maximum 1500IU) ইনফিল্ট্রেট করে দেয়া হয় মূলত, আবার ডেলটয়েড মাসলের দেয়া যাবে। তবে ভ্যাক্সিন যে জায়গায় দিয়েছেন সেই জায়গায় না এবং ভ্যাক্সিন আর ইমিউনোগ্লবিউলিন দেয়ার জন্য পৃথক পৃথক সিরিঞ্জ ব্যাবহার করতে হবে। ইমিউনোগ্লবিউলিন বায়োলজিকাল প্রডাক্ট বলে রিএকশন করতে পারে, তাই সেটার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত (এড্রেনালিন, হাইড্রোকরটিসন, ফেনারগন, রেনিটিডীন ইনজেকশন) রাখতে হবে। দেশে সংক্রামক রোগের ন্যাশনাল গাইডলাইনে জলাতঙ্ক রোগের চিকিৎসার সুন্দর বর্ণনা রয়েছে। একইসাথে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের আরেকটি গাইডলাইন আছে। দুটোর পিডিএফ ফাইল হিসাবে নিচে ডাউনলোডের জন্য দিয়ে দিলাম। জলাতঙ্ক নিয়ে জাতীয় গাইডলাইন (২০১০) – http://goo.gl/75OxqE ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন গাইডলাইন – http://goo.gl/OZiQZK

ডক্টরস ডেস্ক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

গ্রেপ্তার হলেন ডাঃ শেহজাদী আফসার হন্তারক

Tue Sep 30 , 2014
লেখকঃ ডাঃ সেলিম শাহেদ শের ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজের ২৮ তম ব্যাচের ডা শেহজাদী হত্যার রোমহর্ষক ঘটনাটা নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে।স্বামীর হাতে নৃশংসভাবে নিহত হয়েছিলেন তিনি।সেদিন প্রতিবাদ হয়েছিল অন-লাইনে সেদিন প্রতিবাদ হয়েছিল বাংলাদেশের চিকিৎ্সকদের প্রানের প্রাংগন বি এস এম এম ইউর বট তলা ছাড়িয়ে শাহাবাগ অব্দি।আজ প্রায় অনেক দিন পর […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo