দেশ-বিদেশ, ডাক্তারী ও কিছু কথা || পর্ব-৬

প্ল্যাটফর্ম প্রতিবেদন, ৮ আগষ্ট, ২০২০, শনিবার

ডা. সাদিয়া হোমায়রা সোহানা
এফ.সি.পি.এস. (পার্ট-১; গাইনী)
এম.আর.সি.ও.জি (পার্ট-১)
প্রাক্তন মেডিকেল অফিসার, সুলতান কাবুস হাসপাতাল, সালালাহ, ওমান।

ওমানের মহিলাদের প্রথম যেটা আমার চোখে পড়তো, তা হলো মুখে পুরু মেকআপ। প্রথম প্রথম দেখে ভাবতাম নিশ্চিত কোন পার্টিতে যাচ্ছে। পরে অবশ্য বুঝতে পারি, এটা তাদের প্রাত্যহিক জীবনের অংশ, যদিও ব্যতিক্রম আছে। বোরকা, নিকাব যাই পরুক না কেন, এটা তারা করবেই। সকালে কখনো রাউন্ডে গেলে দেখা যেতো রোগীর সাথের মহিলা প্রসাধন সামগ্রীর পশরা নিয়ে বসেছে। শুনেছি শুধু দিনের বেলা না, রাতেও তারা সাজে, তবে স্বামীর জন্য। আমার এক কলীগ এই উৎকট সাজ দেখে তাদের আড়ালে “ম্যারিনেটেড ওমেন” ডাকতো। সালালাহর মহিলাদের বোরখার পেছন অংশ ছিলো অনেক লম্বা, মাটিতে লুটায়। কথিত আছে, মেয়েদের পায়ের ছাপ দেখে নাকি কালো জাদু করতো পুরুষেরা, বশ করার জন্য, এজন্যই এই বোরখার পেছন অংশ লম্বা রাখা হয় যেন হাটার সময় পায়ের ছাপ মুছে ফেলে।

জেবেল সামহান, সালালাহ্ র সবচেয়ে উঁচু জায়গা, পাশে মেঘের সমুদ্র

আরেকটি ব্যাপার লক্ষ্য করার মতো, তা হলো ওদের সুগন্ধি প্রীতি। প্রতিদিন, এমনকি কাজের ফাঁকে ফাঁকেও পারফিউম ব্যবহার করা চাই। একবার এক ওয়ার্কশপে বিরতির সময় সবাই দেখি ব্যাগ থেকে পারফিউম বের করে স্প্রে করছে গায়ে। আমার পাশে বসা স্টাফ আমাকে একটু সাধলো। না করলাম, ততক্ষণে আশেপাশের ঘ্রাণেই আমার মাথা ধরে গেছে।

তবে এখানকার মহিলাদের জন্য আমার বেশ দুঃখ হতো। বিয়ে আর সন্তান জন্ম দেয়া মনে হয় এদের জীবনের প্রধান লক্ষ্য। কেউ যদি “প্রেগন্যান্সি উইথ মেডিক্যাল ডিজিস” নিয়ে কোন স্টাডি করতে চায় তার একবার মধ্যপ্রাচ্যে আসা উচিত। যে রোগই থাকুক না কেন, সন্তান তার চাই। হৃদরোগ, জটিল কিডনি রোগ, অটোইমিউন ডিজিস, ক্যান্সার সার্ভাইবার, এমন কোন রোগ নেই যা প্রেগন্যান্সির সাথে দেখিনি। কেউ যদি উপরিপর সন্তান জন্ম দিতে না পারে, স্বামীর জন্য দ্বিতীয় বিয়ের রাস্তা খুব সহজেই খুলে। এ অবস্থা ধনী গরীব, উচ্চশিক্ষিত, স্বল্প শিক্ষিত সবার মধ্যেই।

এখানে এসেই জীবনের আরেক অদ্ভুত রূপ দেখি। একদিন ডিউটির সময় আমার ডাক পড়লো এক এক্লাম্পসিয়া রোগীর জন্য, বাংলাদেশি। পুলিশ তাকে নিয়ে এসেছে, হাত-পা বাঁধা অবস্থায় রাস্তার ধারে পাওয়া গেছে। সিজারিয়ান করা হল, রোগী একটু যখন সুস্থ তখন আমাকে পাঠানো হলো প্রপার হিস্ট্রি নিতে। কিছুতেই সে বললোনা কোন কথা। তার পরে কি পরিণতি হয়েছে জানি না। আরেকবার এক বাংলাদেশী মহিলা আসলো, রেপ কেস। আমি ভেবেছি হয়তো গৃহকর্তার কাজ, পরে মহিলা বললো আসল কথা। যে ওমানী বাসায় কাজ করতো, তারা বেশ ভালো। কিন্তু অত্যধিক কাজের চাপ সহ্য করতে পারত না বলে, তাকে বাংলাদেশি দালালের কাছে ফেরত দেয়া হয়। দালাল তাকে নিজের বাসায় নিয়ে এসে ধর্ষণ করে। ওই লোক ঘুমিয়ে যাওয়ার পর সে জানালা দিয়ে পালিয়ে আসে।

এদের বেশির ভাগই দালালের মাধ্যমে জায়গা-জমি বিক্রি করে লোভনীয় চাকরীর লোভে আসে। এসে দেখে কাজের লোক হিসেবে অত্যন্ত কম বেতনের চাকরিতে আনা হয়েছে। আমার মনে প্রশ্ন জাগতো এই প্রতারণা গুলো বাংলাদেশিদের সাথেই কেন হয়? অন্য দেশীরা সরকারি ভাবে আসে, এমনকি প্লেনের টিকিটের টাকাও চাকরির ধরন অনুযায়ী চাকুরীদাতারই দেয়ার কথা। সেই জায়গায় বাংলাদেশিরা অনেক ক্ষেত্রে সব কিছু বিক্রি করে আসে আর এখানে এসে পড়ে এক দুষ্ট চক্রে। কোন প্রশিক্ষণ না নিয়ে আসায় আর ভিসা জটিলতায় অন্য কোন কাজও পায়না। না সহ্য করতে পারে, না পারে ফিরে যেতে। আমাদের সরকারি নীতিও খুব অদ্ভুত, এই চাকুরির দায়িত্ব দিয়ে দেয় তারা আদম ব্যাপারীদের কাছে। ব্যবসা ছাড়া বিন্দুমাত্র মানবতা তাদের আছে কিনা আমার জানা নাই।

যাই হোক, এভাবেই ভালো খারাপ মিলিয়ে কয়েকমাস কেটে গেল। এর মধ্যেই আরো অনেক ডাক্তার এসেছেন পরিবারসহ, ধীরে ধীরে এখানেই যেন ছোট্ট এক বাংলাদেশ হয়ে গেলো। নতুন বন্ধু হলো, নিজের এক বলয় তৈরি হলো। কাছাকাছি আমরা অনেকগুলো ডাক্তার পরিবার থাকতাম, মনেই হতো না বিদেশ। আমাদের বাচ্চাদেরও নতুন বন্ধু হলো। ডিউটির সময় শেষ হলেই শুরু হতো আমাদের ঘুরাঘুরি। সপ্তাহান্তে দল বেঁধে ঘুরতে যাওয়া, রেস্তোরায় খেতে যাওয়া আর তো আছেই দাওয়াতের পর দাওয়াত, মাঝে মাঝে বারবিকিউ পার্টি। এই চক্করে অল্প সময়ে ওজন বাড়লো তরতর করে।

আর যখনই ব্যস্ত জীবনে অস্থির হয়ে যেতাম, ছুটে যেতাম সমুদ্র তীরে, ঘন্টার পর ঘন্টা বসে ঢেউ গোনা। অথবা যেতাম পাহাড় চূড়ায়, যার পাশে মেঘ দেখলে সমুদ্র বলে ভ্রম হতো অথবা গাঢ় সবুজ উপত্যকায়। আমাদের জীবনীশক্তি যেন নতুন করে ফিরে পেতাম। ছুটির দিনগুলো সংখ্যায় একটু বেশি হলেই আরও দূরে যেতাম, দুপাশে পাহাড়ের পাথুরে রূপ আর সমুদ্র দেখতে দেখতে।

এর মধ্যে বাংলাদেশে বেড়াতে আসলাম প্রায় ৭ মাস পর। আসার পরদিনই চিঠি পেলাম, কানাডার ইমিগ্রেশনের জন্য মেডিক্যাল টেস্ট করতে হবে। দেরি দেখে এর আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম। তাই খুশি হবো কিনা তাও বুঝতে পারছিলাম না। তার মানে ওমানের দিনগুলো ফুরিয়ে আসছে।

Sarif Sahriar

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

ডা. শুভাগত চৌধুরীর স্বাস্থ্যবার্তা: কী বাড়ায় ইমুউনিটি?

Sat Aug 8 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৮ ই আগস্ট, ২০২০, শনিবার অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী করোনা ভাইরাস থেকে সুরক্ষার জন্য মাস্ক পরা, বার বার হাত ধোয়া, শারীরিক বিচ্ছিন্নতা আর সুষম খাদ্য খেয়ে শরীর সুস্থ রাখা অত্যন্ত প্রয়োজন। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ইমিউনিটি বাড়াতে ব্যায়াম করাও প্রয়োজন। কিন্তু তখনি সবাই বলবে, জিম বন্ধ, ঘরের বাহিরে খেলা বন্ধ, […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo