জীবন কে দেখুন মৃত্যুর চোখ দিয়ে

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৯ মে ২০২০, শুক্রবার:
ডা. জোবায়ের আহমেদ
সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ
সেশন ২০০৩-০৪

আজ রাত ১.৩০ মিনিট।
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। দরজায় আমার স্টাফের করা আঘাতের শব্দে ঘুম ভাঙলো। ইমারজেন্সি রোগী আসছে। গিয়ে দেখি একজন মা, ৩০ বছর বয়স। সাথে ছোট দুইটা বাচ্চা। মা এর চেহারায় তাকিয়ে দেখি ফ্যাকাসে হয়ে গেছে মায়াবী মুখখানি। টর্চ দিয়ে চোখ দেখলাম। পিউপিল Widely dilated, fixed, non reacting to light। বিপি, পালস নাই। ইসিজি করে দেখলাম ফ্লাট লাইন।

ছবি: সংগৃহিত

বাচ্চা দুইটার দিকে তাকিয়ে আমার বুকে ব্যথা শুরু হয়ে গেলো। রোগীর সাথে আসা লোককে চেম্বারে ডাকলাম।
উনারা আমার চেহারা দেখেই বুঝে গেলেন। বাবা এসেছেন সাথে। উনি চেয়ার ছেড়ে মাথায় হাত দিয়ে চেম্বারের ফ্লোরে বসে পড়লেন।

একজন চিকিৎসক হিসেবে সবচেয়ে অসহায় ও বিব্রত হই যখন কারো মৃত্যু ঘোষণা করা লাগে। এই জীবনে অনেকবার এই কাজটা করতে হয়েছে।

২০১০ সাল।
তখন আমি সিওমেক হাসপাতাল এর ইন্টার্ন। মেডিসিন ওয়ার্ডে রাউন্ড দিচ্ছেন প্রফেসর ডা. ইসমাইল পাটোয়ারি স্যার। একটা রোগীর বেডের কাছে গিয়ে স্যার খুব শান্ত ভাবে রোগীর দিকে তাকিয়ে আমাদের দিকে ফিরে জানতে চাইলেন রোগীর স্বজনদের কাউন্সেলিং করা আছে কিনা, এই রোগী কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যাবেন।
ঠিক ১০ মিনিট পরেই রোগীর মেয়ের গগনবিদারী চিৎকারে মেডিসিন ওয়ার্ড ভারী হয়ে উঠল। আমি অবাক বিস্ময়ে স্যারের শান্ত সৌম্য চেহারার  দিকে তাকিয়ে  আছি।

একটা মানুষ পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়ে নিলেন, এই নীল আকাশ আর দেখবেন না, প্রিয়জন এর মায়াবী মুখ আর দেখবেন না, স্ত্রীর হাতের এক কাপ দুধ চা খেতে চাইবেন না, মা বলে প্রিয় মেয়েকে আর ডাক দিবেন না, জ্যোৎস্নাময়ী রাত কিংবা অস্তগামী সূর্যের রক্তিম লাল আভা দেখবেন না। কিন্ত স্যারের এতে কোন ভাবান্তর নেই। স্যার একজনের পর একজন রুগী কে দেখে যাচ্ছেন।

মেডিসিনে একা এডমিশন নাইট। কিছু রাত বিভীষিকার আরেক নাম। দুইটা ওয়ার্ড একা সামাল দিতে হতো। রাতে সিনিয়র কেউ থাকতেন না। একা একাই সব সামাল দিতে হত। পুরুষ ওয়ার্ডে নতুন পেশেন্ট রিসিভ করতে গেলে মহিলা ওয়ার্ড থেকে ফোন সিস্টারের, অমুক বেডের রোগী এক্সপায়ার করছেন। মহিলা ওয়ার্ডে এসে ডেথ সার্টিফিকেট লিখতে লিখতে পুরুষ ওয়ার্ড থেকে কল আরেক জন এক্সপায়ার করছে।

মৃত্যু সত্য। মৃত্যু আসবেই। শুধু নির্ধারিত সময়ের অপেক্ষা।
কিছু মৃত্যু মেনে নিতে আমাদের বুক ফেটে যায় কিন্ত মেনে না নিয়ে উপায় কি?

মৃত্যুর সময় অসময় বলে কিছু নেই। কখন কার মৃত্যুর সময় সেটা একমাত্র মৃত্যুর মালিকই জানেন।

তখন কার্ডিওলজিতে ইন্টার্নশীপ প্লেসমেন্ট। শুক্রবার ছিল। আমার সাথে ডিউটিতে ছিল আমার বান্ধবী কাব্যশ্রী পাল। এত নরম ও শান্ত মনের মেয়ে আমি খুব কম দেখেছি।
আমি আমার একটা পেশেন্ট যিনি Acute Myocardial Infarction নিয়ে এডমিট হয়েছিলেন, ছুটির কাগজ লিখে জুমার নামাজে গেলাম। কাব্যশ্রীর কাছে ছুটির কাগজে সিএ ভাইয়ার সিগ্নেচার রাখার দায়িত্ব দিয়ে। ২০ মিনিট পর নামাজ থেকে ফিরে দেখি রোগী লম্বা হয়ে শুয়ে আছে, সাদা বেডশীটে পুরো শরীর ঢাকা। বুকটা আঁতকে উঠল। একটু আগে যার সন্তানরা আনন্দে আত্মহারা ছিলেন প্রিয় বাবাকে নিয়ে বাড়ি ফিরবেন, নীচে গাড়ি রেডি ছিল, সেই বাবা এখন নিথর।
সেই বাবার নাম এখন লাশ।
সেই রোগীর স্বজনদের চেহারা আজো মনে পড়ে।

আমার দাদাভাই একবার খুব অসুস্থ হয়ে গেলেন। বাঁচার কোন আশা দেখা গেল না। উনাকে নিয়ে আমরা গ্রাম থেকে এপেলো হাসপাতালে রওনা দিলাম। মাইক্রো বাস ছেড়ে দিল। দাদাভাই কে বিদায় দিতে উনার চাচাতো ভাই  হাবিব উল্লাহ দাদা এক লুঙ্গির উপর আরেক লুঙ্গি পড়েই দৌঁড় দিতে দিতে গাড়ির কাছে আসলেন। বংশের মুরুব্বি বড় ভাইকে বিদায় দিতে, দোয়া নিতে ব্যাকুল ছিলেন। হাবিব দাদার আশংকা ছিল আমার দাদার সাথে এটাই হয়তো শেষ দেখা। লুঙ্গি পাল্টানোর সময় পাননি।আমার দাদাভাই এপোলো থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেন। কিন্ত সেই হাবিব উল্লাহ দাদাভাই হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। আমার দাদাভাই উনার জানাজার ইমামতি করলেন। বিষয়টা আমাকে আজো নাড়া দেয়।

যার কি না বাঁচার আশা ছিল না, তিনি বেঁচে গেলেন কিন্ত যার মৃত্যু নিয়ে আমাদের ভাবনা ছিল না তিনি যে আজরাইলের লিস্টে ছিলেন তা আমরা বুঝি নি।

কুরবারির ঈদের ছুটি কাটিয়ে আন্তঃনগর পাহাড়িকা এক্সপ্রেসে কুমিল্লা থেকে সিলেট ফিরছি। সিলেটে স্টেশন প্লাটফর্মে নেমে দেখা শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যাল(সাস্ট) এর সহযোগী অধ্যাপক ড. মো খায়রুল্লাহ এর সাথে। উনি আমার মামা শ্বশুর। হাসি মুখে কুশল জানলেন, কার্ড দিলেন, সাস্টে যেতে বললেন কিন্ত  উনাকে দেখতে সাস্টে যাওয়ার আগেই মামা চলে গেলেন চিরদিনের জন্য সাস্ট ছেড়ে। গত বছরের ৫ অক্টোবর জুমার নামাজে সুন্নত পড়ার সময় মামা ইন্তেকাল করেন। আমি ভাবছি মামার ছোট্ট পুত্র সন্তানের কথা। বাবা কি বুঝার আগেই বাবা হারিয়ে গেলেন দূরে, বহুদূরে, দূর অজানায়। কুমিল্লা থেকে আমার ওয়াইফ  যখন ফোনে জানালো এই বিষাদের খবর, তখন আমি নীরব হয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ। গত রাতে উনার হাসিমুখের ছবি গুলো দেখলাম আর ভাবলাম মায়ার এই পৃথিবীর সাথে উনি কেন এত দ্রুত মায়া ছিন্ন করলেন?
এখানে উনার ইচ্ছার কি কোন দাম আছে।
নেই তো ।

মৃত্যুর কাছে মানুষ এর ইচ্ছের কোন দাম নেই।

মৃত্যু কত কাছে?

গত ৩০ এপ্রিল বন্ধু ডা. জাবেদের সাথে রোগী দেখতে গেলাম কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের CCU তে।
একজন রোগী দেখা শেষ করার আগেই ওর তিনজন রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে গেল। আমি রোগীদের অবস্থা দেখে বুঝে গেছি মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে ফেরেশতা আমাদের আশেপাশেই আছেন। ডাক্তারদের সকল চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে ১৫ মিনিটের মধ্যে তিনজন রোগী মারা গেলেন।

কিসের এই দুনিয়া?
কিসের পিছনে ছুটে চলেছি আমরা?

দুপুরে  চেম্বারে বসে আছি একদিন। রোগী দেখছি।
হঠাৎ মসজিদ থেকে একজন মানুষ এর মৃত্যুর সংবাদ মাইকে ঘোষণা হল। সাথে সাথে রোগী দেখা বন্ধ দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ হয়ে ভাবলাম। আহারে জীবন। একদিন আমার মৃত্যুর সংবাদও মাইকে ঘোষণা হবে।

আজ আপনি কাঁদছেন, কাল আমি কাঁদবো।
আজ আমার মা কাঁদছে, কাল আপনার মা কাঁদবে।
খুব অল্প সময়, ক্ষণিকের এই জীবন।
কোন দিন কারো ক্ষতি করতে নেই।
কারো বিপদের কারণ হতে নেই।

আজ কাউকে বিপদে ফেলে আপনি হাসলেন অন্যায় ভাবে। কাল মহান প্রভু আপনাকে বিপদে ফেলে অন্যকে হাসির সুযোগ করে দিতে খুব বেশি সময় নিবেন না।

একদিন তো চলেই যাবো এই মায়ার পৃথিবী ছেড়ে। তাই অন্যের বিপদে পাশে দাঁড়ান। সে আপনার অপছন্দের হলেও। আপনার দলের না হলেও। আল্লাহ অবশ্যই আপনার পাশে দাঁড়ানোর জন্য অনেককে পাঠাবেন।

মানুষের বিপদের কারণ হবেন না অন্যায্য ভাবে। মানুষই একমাত্র প্রাণী যে জানে যে তাকে মরতে হবে। তাই মানুষ মৃত্যুর প্রস্তুতি নেয়, অন্য কোন প্রাণীর সেই প্রস্তুতি নেই। মানুষ এর আছে।

সব মৃত্যুই দুঃখের। সুখের নয় কোন মৃত্যু নেই।

আমরা জানি একদিন আমরা মরে যাব তাই পৃথিবীটা এত সুন্দর লাগে। যদি জানতাম আমাদের মৃত্যু নেই তাহলে পৃথিবীটা এত সুন্দর লাগত না।

মৃত্যু তাই অনিন্দ্য সুন্দর।

জীবন কে দেখুন মৃত্যুর চোখ দিয়ে। তাহলে জীবন হয়ে উঠবে সুন্দর ও সুখের। তবে মরার আগে মরে যাবেন না।

Life is like an ECG.
It will go up,then down, then up again.
When it is a flat line, you are just dead.
So enjoy your ups and downs in life.

Firdaus Alam

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

আজ রাতে প্ল্যাটফর্মের আয়োজনে কোভিড-১৯ গাইডলাইন বিষয়ে ওয়েবিনার

Fri May 29 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৯ মে ২০২০, শুক্রবার: কোভিড-১৯ এর আপডেটেড ম্যানেজমেন্ট এবং ন্যাশনাল গাইডলাইনের নতুন সংযোজন বা পরিবর্তন নিয়ে আজ রাত ৯টায় প্ল্যাটফর্মের আয়োজনে ওয়েবিনারে কথা বলতে আসবেন ডা. আবু সায়ীদ ফিরোজ এবং ডা. সাকিব আমান। ডা. আবু সায়ীদ ফিরোজ, এমডি, এফসিসিপি, একজন পালমোনারি, ক্রিটিকাল কেয়ার এন্ড স্লিপ স্পেশালিষ্ট। তিনি বর্তমানে […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo