আমি তোমার মা

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ১০ মে ২০২০, রবিবার:

মা কে নিয়ে এই লিখাটা যখন শুরু করলাম, তার আগে আরো দুইবার চেষ্টা করেছি। ক্যামন যেনো সব গুলিয়ে যাচ্ছে। আরে! এইতো আমার মা আমার পাশে বসে আছেন, এতো গল্প লিখা আমি এই মানুষটাকে নিয়ে তবু লিখতে পারছিনা!

আচ্ছা আম্মা? তোমার বিয়ের বয়স কত?
-হঠাৎ এই প্রশ্ন কেনো?
আরে বলো না!
-৩৭ বছর।
আর আব্বু বিদেশ থাকে কত বছর?
-২৮ বছর।
মানে তুমি তোমার ৩৭ বছরের বিবাহিত জীবনে বাবাকে মাত্র ৯ বছরের মতন পাশে পেয়েছো!
-(মা হাসলেন) আজকে হঠাৎ কি হলো তোমার? কোথাও কোনো তথ্য লাগবে নাকি? কিছুতে অংশগ্রহণ করতেছো?

উঁহু। এমনিতেই। মা শোনো, একটা কথা।
-কি?
না কিছুনা। আসলে বলতে চাচ্ছিলাম তোমাকে ভালোবাসি মা।
– আজকে কি মা দিবস নাকি?
কিভাবে বুঝলে?
– না প্রতিবার তো তুমি এই দিনে ক্যাম্পাসে থাকো আর ফোন করে ইনিয়েবিনিয়ে বলো।

মা, তুমি সব বুঝে যাও কিভাবে?

-কারণ আমি তোমার মা, তুমি আমার মা না। বলো এবার কি দিবা?

তুমি তো অনেক অনেক লাকি আমাদের মতন চারচারটা বাচ্চাকাচ্চার মা তুমি! তোমার আর কি লাগে?
-এই যে ২৮ বছরের কথা বললা, এটা তো তোমাদের মুখের দিকে তাকিয়েই কাটায় দিলাম।

ছবিঃ মায়ের সাথে লেখিকা

মা? ও মা? মা?
– কি হলো আবার? কি চাও?
না কিছু না। এমনিতেই ডাকলাম।
– জানিতো।
ক্যামনে জানো সব?
– কারণ আমি তোমার মা। তুমি আমার মা না। আজকে সন্ধ্যায় তেলের পিঠা বানায় দিবো নে। এবার যাও গোসল করে আমাকে উদ্ধার করো। বলেই মা পাশের রুমে চলে গেলেন।

আমি ভাবতে লাগলাম, আশ্চর্য তো! এই মহিলা তো ওয়ান্ডার উইমেন। কিভাবে কিভাবে সব বুঝে যায়! মায়েরা বোধহয় সবাই এমনই।

হঠাৎ মায়ের বালিশের পাশে একটা হলুদ রঙের খাম দেখলাম। মনে পড়লো, ছোটবেলায় আম্মার একটা চিঠি লিখার খাতা ছিলো। ওটা থেকে বাবাকে চিঠি লিখার জন্য আমাদের চার ভাইবোন কে আলাদা আলাদা চারটা পৃষ্ঠা দিতেন আম্মা। নিজেও লিখতেন। আমরা সবাই যার যার মতন বাবাকে চিঠি লিখতাম। আমি মাঝেমাঝে আম্মার নামে বাবার কাছে বিচার পর্যন্ত দিতাম, যে আম্মা আজকে আমাকে এই জিনিসটা চাওয়ার পরে বকা দিয়েছেন। আমার মনে পড়ে, বাবা আমাদের প্রত্যেকের চিঠির আলাদা আলাদা উত্তর দিতো। আমরা পোস্ট মাস্টারের জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষা করতাম। মাসে একবার হয়তো, আবার কখনো কয়েক মাস পরে বাবার সাথে আমাদের ফোনালাপ হতো। ওইদিনটা আমার আবদারের দিন। আমি ওইদিন খুশীতে আত্মহারা হয়ে পরেরবার কথায় বা চিঠিতে কি চাইবো ভাবতে থাকতাম আর আম্মাকে বলতাম। অন্যদিকে লক্ষ্য করতাম সারাদিন আম্মার মুখে অন্যরকম একটা প্রশান্তি। মায়েরা বোধহয় এমনই, সন্তানের সুখই বোধহয় তাদের জীবনীশক্তি।

একদিন ভুল বশত আম্মার একটা পুরাতন চিঠি পড়ে ফেলি। সেখানে কোনো আক্ষেপ পাইনি৷ একটা কথা লিখা ছিলো, তুমি দেখে নিও তোমার চার চারটা সন্তান আমি একাই চারচারটা রত্ন বানিয়ে তোমাকে ফেরত দিবো। তুমি আমাদের কথা ভেবোনা! ছোট্ট আমি কথাটির ভার সেদিন বুঝি নাই, অবাক হয়েছিলাম আরে আম্মা দেখি বাবার কাছে কিছুই চাইলো না! একদম ভালো লাগেনি। আম্মাকে নিয়ে চিঠিটা ফেরত দিয়ে বললামঃ
নাও, পাকেরঘরে এটা পড়েছিলো। আমি পেয়েছি। দেখো কি এটা।
– তুমি পড়ো নাই?
না এসব লিখা আমি বুঝিনা। এগুলা কি লিখা মা? বুঝিনা ক্যান? তুমি বুঝো এসব?
-হুম। বুঝিতো বাবা।
কি বলছো এগুলা? এগুলা কিভাবে বুঝো? আমি তো বুঝি না।

– আমি বুঝি কারণ আমি তোমার মা। তুমি বোঝো না, কারণ তুমি আমার মা না তুমি বাচ্চা।

আমার শোবার রুম টা ঠিক মায়ের পাশেই। আমার বাতি বন্ধ করে ঘুমানোর অভ্যেস। পড়াশুনার সুবাদে আজ বছর চারেক হয় বাসার বাইরে থাকি। ক্যাম্পাস থেকে যখন বাসায় ফিরি, প্রতিরাতে আম্মা নিজে এসে বাতি বন্ধ করে দিয়ে যান আর বলেন, রুমের বাতি তো বন্ধ করলাম কিন্তু কাথার নিচে ফোনের বাতি বন্ধ না করলে এমনিতেও মানুষের ঘুম হবে না। বলে আম্মা তাহাজ্জুদ পড়তে চলে যান। প্রায়দিনই আমি মধ্যরাতে গিয়ে আম্মাকে জড়ায় ধরি। আম্মা জিজ্ঞেস করেঃ কি হইছে বাবা? খারাপ লাগতেছে কিছু নিয়ে?
আমি কিছু বলতে পারিনা। শুধু জিজ্ঞেস করি, আম্মা তুমি কিভাবে বুঝো সব?

-বুঝি কারণ আমি তোমার মা। তুমি আমার মা না।

আম্মার বয়স বাড়ছে, বেশ কয়েকটা রোগ শরীর খেয়ে নিচ্ছে। প্রায়দিন বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে না আম্মা। তবুও আমার জন্য মাঝেমাঝেই সূদুর পাবনা চলে যায় একা একা। আমার খাওয়ায় কষ্ট হয় বলে। আম্মাকে বাসায় পাঠানোর জন্য যখন বাসে তুলে দিতে যাই, তখন বলে দেই। এতো কষ্ট করে আর আসা লাগবে না। ক্যান যে আসো, আমার ভয় লাগে!

– আসি কারণ তুমি সবচাইতে ছোট, আমি তোমার মা তুমি আমার মা না।

আমি প্রায়শই লক্ষ্য করি, মায়ের হাসির আড়ালে একটা বিষন্নতার ছায়া। আমরা ভাই বোনেরা প্রশ্ন করি, মা কিভাবে পারলা সব? চার চারটা বাচ্চাকে বড় করা তাদের উচ্চশিক্ষা দেয়া? আম্মার চোখ গর্বে জ্বলজ্বল করে তার সন্তানদের সাফল্যে। কারণ দীর্ঘ ২৮ বছরের লড়াই টা তার একার। আমি এখন সেদিনকার চিঠির প্রত্যেকটা লাইনের মর্ম বুঝি। মাকে হয়তো কোনো দিনও বুঝার মতন ক্ষমতা আমার হবে না। কারণ মা মায়াবতী, আর মায়ের মায়ার কোনো সংজ্ঞা আমার কাছে নাই।

অবশ্যই আমার বাবা আমাদের জন্য নিজের জীবনের সব বিসর্জন দিয়েছেন। বাবাকে নিয়ে সম্পূর্ণ একটা বই লিখা যাবে। কিন্তু আমি বলি, বাবা তুমি তোমার জীবনে উত্তম অর্ধাঙ্গিনী পেয়েছো আমাদের মায়ের রুপে। আম্মা না থাকলে তুমি যে সন্তানদের নিয়ে গর্ব করো তাদের অস্তিত্ব থাকতো না। আসলে মায়েরা বুঝি এমনই। সাগর থেকে কুড়ানো ঝিনুক এনে দিলে তাতেও মুক্তো ফলিয়ে সবার হাতে দিয়ে আড়ালে হাসবেন মুক্তোঝরানো হাসি। আমার শব্দভাণ্ডারে মায়ের জন্য শব্দ অনেক কম। যা লিখেছি তা তার জীবন সংগ্রামের হয়তো কাটছাঁট করা কয়েকটা লাইন। মায়ের এতো ত্যাগের কাছে কৃতজ্ঞতার কি কোনো ভাষা হয়? আমার জানা নাই।

গতরাতে মাকে নিয়ে কয়েকটা লাইন লিখেছিলাম,

“যে নারী করিয়াছে তোমারে গর্ভেতে ধারণ
তাহারে ভালোবাসিতে নির্বোধ,
কেনো খুঁজিয়া বেড়াইতেছো অহেতুক কারণ!
মাতা রুপে যে তোমারে করিয়াছে লালন
নির্বোধ, স্বর্গ কোথায় খুঁজিয়া চলিয়াছো?
মর্ত্যে রাখিয়া তাহারো চরণ!”

লেখিকা:
নাজমুন নাহার মীম
৪র্থ বর্ষ, পাবনা মেডিকেল কলেজ

Abdullah Al Maruf

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

ডাক্তার মানেই কাড়ি কাড়ি টাকা না; একজন চিকিৎসকের আত্মকথা

Sun May 10 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ ১০ মে, ২০২০, রবিবার। আজকে মাসের দশ তারিখ। আমার তিন মাসের বাচ্চার গুঁড়ো দুধ শেষ হয়ে গিয়েছে চার দিন আগেই। এখনো বেতন পাইনি। হাসপাতাল থেকে বলে দিয়েছে যে, ইনকাম কম তাই বেতন দিতে দেরী হবে৷ বাবা-মাও অনেক অসুস্থ। যেখানে আমার এই মাসে উনাদের কিছু দেয়ার কথা ছিল, সেখানে […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo