করোনার দিনগুলোয় ১২ || ক্লাস্টার হোম লক এবং স্বেচ্ছাসেবক

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৩০ জুন ২০২০, মঙ্গলবার

ডা. মোহাম্মদ আল-মামুন
এমবিবিএস, বিসিএস (স্বাস্থ্য)
এফসিপিএস (সার্জারি)
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, বাঞ্ছারামপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

হোমার এর গল্প যখন পড়ছিলাম তখন মনে হচ্ছিল প্রাচীন পৃথিবীর লোকজন কত বুদ্ধিমান ছিলো! প্রাচীন গ্রীসের লোকজন দশ বছরেও ট্রয় নগরীকে হারাতে না পেরে, বিশাল এক কাঠের ঘোড়া তৈরী করে এর পেটের ভিতর সৈনিক ঢুকিয়ে দেয় এবং  দূর্ভেদ্য ট্রয় নগরীর দেয়ালের সামনে রেখে যায়, যার নাম ছিলো ট্রোজান হর্স। ট্রয়ের অধিবাসীরা মনে করেছিলো গ্রীকরা পরাজিত হয়ে এটি রেখে গেছে উপহার হিসেবে। ট্রোজানরা ঘোড়াটিকে তাদের চারিদিকে সুরক্ষিত দেয়ালের ভিতরে নিয়ে যায়, যার মাধ্যমে গ্রীক/স্পার্টান সৈনিকরা নগরীতে  ঢুকে পরে। অতপর সৈনিকরা রাতের বেলায় ঘোড়ার পেট থেকে  বের হয়ে বিভিন্ন জায়গায় আগুন লাগিয়ে প্রধান ফটক খুলে দেয় গ্রীক সৈন্যদেরকে ভিতরে ঢুকানোর জন্য। বাকিটা ইতিহাস। ট্রয় নগরী ধ্বংস করে দেয় স্পার্টান আর মাইসিনরা।

বর্তমান কোভিড ওয়ারও একই কৌশলে ঢুকে পরে বিভিন্ন দেশে। এক্ষেত্রে বাহন হলো মানুষ, যারা নিজেরাও জানেনা কিভাবে শত্রুকে দেশে ঢুকতে দিচ্ছে, ঘরের ভিতর আশ্রয় দিচ্ছে, কিভাবে নিজেরা মরছে অন্যদেরকে মারছে। যারা এর আবিষ্কারক ছিলো, তারা নিশ্চয়ই হোমার এর বইয়ের থিম ধার নিয়েছিলো। অন্যকে বাহন করে কিভাবে রোগটিকে ছড়িয়ে দেয়া যায়, তার হিসেব নিশ্চয় করেছিলো তারা। তা না হলে এতো ভয়ংকরভাবে ছড়িয়ে পরতে পারতো না এটি। এখনতো নিয়ন্ত্রণ করাই কঠিন হয়ে গেলো।

বিভিন্ন প্রয়োজনে সরকার সকল জেলা থেকেই লকডাউন উঠিয়ে নিয়েছে। কিন্তু করোনা দেশ থেকে উঠেও যাবেনা, সহসা বিদায়ও হবে না। তাই এমন কিছু কাজ করতে হবে, যেন করোনাকালেও আমাদের মানুষগুলো বাঁচানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে পারি। আমরা যদি আমাদের মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টা না করি, তবে অন্য দেশের মানুষ বাঁচাতে আসবে না। আমাদের মানুষকে ভালোবাসা দিয়েই এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে হবে। আপনি যাই চিন্তা করেন না কেন এদেশের অশিক্ষিত, অল্পশিক্ষিত মানুষগুলোই আমাদের বড় সম্পদ। শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ওরাই এই মাটি আকড়ে পরে থাকে। ওরা কোটি টাকার মালিক হলেও বিদেশের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যায় না। ওরাই এদেশের সংস্কৃতির ধারক এবং বাহক। ওরা ভুল করে সত্যি, তবে ওরা না থাকলে আমাদের অবস্থাও ভালো থাকবে না। কারন অর্থনীতির খাবার যোগান তাঁরাই  দিচ্ছেন।

আমরা জাতিগতভাবে বিভিন্নভাবে সবসময়ই নির্যাতিত। সেই সুলতানি আমল থেকে শুরু করে মোগল আমল, ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তানি আমল কোনটাই বাদ যায়নি। সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ছিল হাবসি ক্রিতদাসের শাসনামল। আফ্রিকান ক্রিতদাসরাও আমাদের শাসন করে গেছে আর স্বাক্ষী রেখে গেছে সীমাহীন বর্বরতার। মুক্তিযুদ্ধের পর স্বজাতি শাসিত আমলেও আমরা প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ পাইনি কখনো। অথচ জাতিগতভাবে আমরা খুবই শান্তিপ্রিয়। দাঙ্গা ফ্যাসাদ আমরা পছন্দ করিনা। প্রাচীনকালেও আমাদের পূর্বপুরুষরা যুদ্ধ মারামারি এসব পছন্দ করতেন না। এই সুযোগটা নিয়েছে বেনিয়ারা সবসময়। অস্ত্রের জোরে দখল করেছে, শাসন করেছে বাংলার নিরীহ মানুষকে।তাইতো এই আমরা সর্বংসহা জাতি। সব ধরনের অত্যাচার জেনেটিক্যালি সহ্য হয়ে গেছে আমাদের।শত অত্যাচারেও কেউ প্রতিবাদ করে না। শুধুমাত্র মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের তৃণমূল লেভেলেও কাজ করেছিলো, যার ফলশ্রুতিতে মহান স্বাধীনতা পাই আমরা।

এখনকার সময়গুলোতে আমরা আছি সবচেয়ে বিপদে। একদিকে আমাদের অর্ধশিক্ষিত অদক্ষ জনগোষ্ঠী, প্রচুর কর্মহীন মানুষ, বিদেশ থেকে ফেরত আসা প্রচুর শ্রমিক সব মিলিয়ে আমাদের অবস্থা সত্যিই সঙ্গীন। এ অবস্থায় লকডাউন প্রলম্বিত করে জাতীয় অর্থনীতি জনবান্ধব রাখা মারাত্নক কঠিন।এমতাবস্থায় তৃণমূল লেভেল কাজে লাগানো খুব জরুরী।

এ অবস্থায় যারা ভাবে আমার এ ছোট্ট দেশটাই পৃথিবীর স্বর্গ, তাদের নিয়েই আমরা পথ চলতে চাই। তাদেরকে দিয়েই আমরা চাই মহামারী কন্ট্রোল করতে। এই তৃণমূল লেভেলের মানুষগুলোই  আমাদের দেশের মানুষকে বাচাঁতে পারে মুক্তিযুদ্ধের মতো। আমরা বিভিন্ন পরামর্শ, চিকিৎসাসহ সব সহযোগিতা করবো।তারা শুধু আমাদের পরামর্শ মতো কিছু কাজ করবে, তবেই সাফল্য আসবে।

“ক্লাস্টার হোম লক সিস্টেম”

সার্জারিতে একটি শব্দ আছে যার নাম “ড্যামেজ কন্ট্রোল সার্জারী”। এটি সামুদ্রিক জাহাজের মেরামত কৌশল থেকে নেয়া। যুদ্ধের সময় কোন যুদ্ধজাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হলে এর শুধুমাত্র ক্ষতিগ্রস্ত অংশটুকু অব্যবহৃত রেখে এটি আলাদা করে দিয়ে বাকি অংশ কিছুটা মেরামত করে যুদ্ধউপযোগী করা হয়। আমাদের মানুষজনকে বাঁচাতে পারে এই পদ্ধতি। যার নামকরন করা যায় “ক্লাস্টার হোম লক পদ্ধতি”। অর্থাৎ যে ঘরে/বাসায় কোভিড কিংবা সাসপেক্টেড কোভিড পাবেন, সেখানেই ব্লক দেবেন। তাদেরকে আলাদা করে রেখে দিবেন। বাকিরা সবাই স্বাভাবিক কাজকর্ম করবে। পুরোগ্রাম, কিংবা পুরো উপজেলা, জেলা গনহারে লকডাউন দিয়ে এদেশে কোন লাভ নেই, কারন জনগন অসচেতন এবং লকডাউন মানতে চায় না। যে ঘরে রোগী পাবেন সে ঘরই টার্গেট  থাকবে। রোগী সেলফ আইসোলেশনে থাকবেন।বাকিরা কোয়ারেন্টাইনে থাকবেন। ট্রেসিং করে এর সাথে সংশ্লিষ্ট  বাকিদের ও কোয়ারেন্টাইনে  নেয়া হয়। আমরা এই পদ্ধতিই চালাচ্ছি প্রথম থেকে। তাই এতোদিন সবকিছু আমাদের কন্ট্রোলেই ছিলো। এখন ভজঘট পাকাচ্ছে ঈদের সময় বেড়াতে আসা মানুষজন। তাদেরকে কোয়ারেন্টাইন দেয়ার পরে ও এটি ভঙ্গ করে ছড়িয়ে দিয়ে গেছে এই উপজেলার আনাচে কানাচে।ছোট ছোট গাড়িগুলোতে ওরা চলাচল করায় এর মাধ্যমে ও ছড়িয়েছে। পৌরসভার ভিতরে এটি হয়েছে সবচেয়ে বেশী। এরা নিয়ম না মানার প্রতিযোগিতা করেছে। নিয়ম মানলে নিজে নেতা হলো কেন! এমন একটা ভাব ছিলো এদের। এমনকি আক্রান্ত সদস্যের পরিবারের স্যাম্পল নিতে গিয়ে ও আমাদের  বিব্রত করেছে যেখানে অন্যরা স্বেচ্ছায়  ফোন দিচ্ছে আমরা কখন স্যাম্পল নিবো তাদের। এই ছোট্ট অসহযোগিতাটুকু  বাদ দিলে বলা যায় আমরা পুরো উপজেলার সহযোগিতা পাচ্ছি এবং পেয়েছি।

“প্রতি ওয়ার্ডে স্বেচ্ছাসেবক ১০জন”

আমাদের” ক্লাস্টার হোম লক” সিস্টেম শুধু মাত্র আমরা কতিপয় ডাক্তার এবং স্বাস্থ্য কর্মী দিয়ে মেইনটেইন করা যাবে না। এক্ষেত্রে আমরা  নির্দেশ দিয়েছি ১০ জন করে ভলান্টিয়ার প্রতি ওয়ার্ডে  তৈরী করার জন্য যার পৃষ্ঠপোষক থাকবেন চেয়ারম্যানগন। মেম্বারদের সার্বিক পরামর্শে “ক্লাস্টার হোম লক “মেইনটেইন করা হবে পুরো উপজেলা জুড়ে।এতোদিন প্রতি ইউনিয়নে ছিলো ৩০ জন করে ভলান্টিয়ার যারা স্বাস্থ্য কর্মীদের কোয়ারেন্টাইনসহ সকল কাজেই সহযোগিতা করেছেন। এখন সেই স্বেচ্ছাসেবকদের সংখ্যা বেড়ে হচ্ছে ৯০ জন করে প্রতি ইউনিয়নে।স্বেচ্ছাসেবকদের বিরাট অংশই কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়া যুবকরা।

স্বেচ্ছাসেবকদের এখনকার কাজের স্পেকট্রাম বেড়ে গেছে।তাদের কাজগুলো নির্ধারন করেছি….

১। উপজেলার বাইরে থেকে কেউ এলে স্বাস্থ্য কর্মীকে জানানো এবং কোয়ারেন্টাইন দেওয়া।

২। কেউ কোয়ারেন্টাইন না মানলে তা আমাদেরকে জানানো, ওয়ার্ডের মেম্বার চেয়ারম্যানকে জানানো।

৩। মানুষজনকে মাস্ক পড়ার ব্যাপারে উদ্ধুদ্ধ করা এবং আগামী কয়েকদিন পর্যন্ত সকল মসজিদে প্রতি ওয়াক্তে মাইকে প্রচার করা মাস্ক পরা সম্পর্কিত সরকারী আইনটি নিয়ে। মাস্ক ছাড়া কাউকে বাড়ির বাইরে যেতে দেয়া যাবে না। কোন গাড়িতে মাস্ক ছাড়া উঠলে নামিয়ে দেয়া হবে। বাইরে কিংবা বাজারে দেখলে জরিমানা করা হবে আইন মোতাবেক। এটি আমরা করবো।

৪। সকল গাড়িতে ব্লিচিং পাউডার স্প্রে রাখার ব্যাপারে উদ্ধুদ্ধ করা এবং এই তথ্যটি মসজিদের মাইকে আগামী কয়েকদিন প্রতি ওয়াক্তের আজানের সময় প্রচার করা।যাত্রী উঠানোর আগে তারা স্প্রে করে জীবানু পরিষ্কার করে নিবে।আবার যাত্রী নামানোর পরে ও ব্লিচিং পাউডার দিয়ে ড্রাইভারগন পরিষ্কার করে নিবেন।ড্রাইভার সঠিকভাবে মাস্ক না পড়লে, নিয়ম না মানলে তার গাড়ি থানায় নিয়ে আসা হবে।রাস্তায় রাস্তায় ভলান্টিয়ারগন এটি চেক করবেন।

৫। বাড়ি বাড়ি সাসপেক্টেড কোভিড সার্চ করা হবে।যারা সর্দিকাশি বা জ্বর এ ভুগবেন তারা স্বেচ্ছায় আইসোলেসনে যাবেন।না গেলে আমাদের স্বাস্থ্য কর্মী স্বেচ্ছাসেবক,মেম্বারসহ আইসোলেশনে পাঠাবেন কাউন্সেলিং করে।এ কাজটি ও আমাদের স্বেচ্ছাসেবকরা সুচারুভাবে করবেন।

ও হ্যাঁ আমরা কি করবো তা নিয়ে নিশ্চয়ই ভাবছেন!

আমরা করোনা সন্দেহজনক রোগীকে মোবাইল টিমের মাধ্যমে চিকিৎসা দিচ্ছি।করোনা রোগীকে বাড়িতে রেখেই চিকিৎসা দিচ্ছি।সব কিছু মনিটর করছি,তাদেরকে মানসিক সাপোর্ট দিচ্ছি।ফোনে সার্বক্ষনিক খোঁজ খবর রাখছি।আমাদের স্বাস্থ্যকর্মীরা ও তাদের খোঁজ রাখছেন।সবকিছু মিলিয়ে এই উপজেলার রোগীদের আমরা চিকিৎসার সাথে  প্রচন্ড মানসিক সাপোর্ট দিচ্ছি।আর আক্রান্ত রোগী বাড়িতে আইসোলেশনে থাকলে তার পছন্দসই খাবার পাচ্ছে, গরম পানি খাবার সুযোগ পাচ্ছে,নাকমুখে পানির বাষ্প টানার সুযোগ পাচ্ছে।তারা এই সুবিধাটুকু পেলে তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠছে।যারা শারীরিক সমস্যা বেশী মনে করছেন তাদেরকে হাসপাতালে ভর্তি করে নিচ্ছি।

এখনকার যারা স্বেচ্ছাসেবক,  তারা আমার কাছে গেরিলা যোদ্ধার মতো।তাদের সহযোগিতাই আমাদেরকে এই যুদ্ধে জয়ী হতে সাহায্য করবে।তাদের মাধ্যমে আমরা একদম তৃণমূল লেভেলের সকল খবরাখবর পাই এবং সমস্যাগুলো ও সমাধান করা সহজ হয়।তাদের

Sarif Sahriar

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

৩৮ তম বিসিএসের ফলাফল প্রকাশিত, সুপারিশপ্রাপ্ত হলেন ২২০৪ জন

Wed Jul 1 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, বুধবার, ১ জুলাই, ২০২০ ৩৮ তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল গতকাল মঙ্গলবার (৩০ জুন) বিকালে প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ সরকারী কর্ম কমিশন (PSC)। উক্ত বিসিএসে ২,২০৪ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করেছে পিএসসি। সুপারিশ পাওয়া ক্যাডারের মধ্যে সাধারণ ক্যাডারে ৬১৩ জন, সহকারী সার্জন ২২০ জন, ডেন্টাল সার্জন ৭১ জন, বিভিন্ন টেকনিক্যাল ক্যাডারে […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo