বুধবার, ০৭ মে, ২০২৫
এমবিবিএস-বিডিএস ডিগ্রি ব্যতীত কেউ রোগী দেখা বা চিকিৎসা অনুশীলন করতে পারবে না – মর্মে সুপারিশ করেছে স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন।
সোমবার (৫ মে) রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার কাছে তাদের প্রতিবেদন পেশ করেন কমিশনের সদস্যরা। ওই প্রতিবেদনে নানা প্রস্তাব ও সুপারিশ তুলে ধরেন তারা। এরমধ্যে স্বল্পমেয়াদি ও মধ্যমেয়াদি ৩২টি মুখ্য সুপারিশ করেন।
সুপারিশের ‘নেতৃত্ব, সুশাসন ও কর্মসংস্কৃতি’ শিরোনামের ৪র্থ পরিচ্ছেদের হাসপাতাল ভিত্তিক সেবায় সুশাসন অংশে বলা হয়েছে–
“ক. উপজেলা পর্যায়ে সেকেন্ডারি স্বাস্থ্যসেবা জোরদার করে জনগণের সেবা গ্রহণ সহজলভ্য করতে হবে। জেলা হাসপাতালগুলোতে বিশেষায়িত (টারশিয়ারি স্তরের) চিকিৎসাসেবা চালু করতে হবে, যাতে সেবার বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত হয়, মেডিকেল কলেজ ও জাতীয় ইনস্টিটিউটগুলোর ওপর রোগীর চাপ কমানো যায়, এবং ভৌগোলিক কারণে কেউ বিশেষায়িত চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত না হয়। সেবা মান বজায় রাখার জন্য সরকারি হাসপাতালগুলো-তে অতিরিক্ত রোগী ভর্তি করা যাবে না।যদি কোনও সরকারি হাসপাতালে রোগী সেবা প্রদান সম্ভব না হয়, তাহলে রোগীকে নিকটস্থ পরবর্তী সরকারি হাসপাতালে পাঠানো হবে, অথবা যদি সেখানে কোনো ব্যবস্থা না থাকে, তাহলে চুক্তিবদ্ধ বেসরকারি হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা থাকবে। এতে রোগীদের সেবা কোনওভাবেই ব্যাহত হবে না এবং দ্রুত চিকিৎসা পাওয়া যাবে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোর সাথে চুক্তি করার মাধ্যমে, নির্ধারিত চিকিৎসা খরচে (ন্যায্য মূল্য) রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হবে। যদি কোনো সরকারি হাসপাতালে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা না থাকে, তাহলে সরকারি স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রতে রোগীকে পাঠানো হবে। যদি ওই সরকারি হাসপাতালেও না থাকলে সরকারি চুক্তিবদ্ধ বেসরকারি হাসপাতাল থেকে নির্ধারিত মূল্যে পরিক্ষা ও চিকিৎসা সেবা নিতে পারেন। প্রয়োজনে সরকারি হাসপাতালগুলোর তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিসহ সকল স্তরের সেবাপ্রদানকারী কর্মচারীদের বিধি অনুযায়ী বদলি করা যাবে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কার্যক্রম সবকিছু স্বশাসিত জেলা ও উপজেলা স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ অধীনে পরিচালিত হবে, যা নিয়ন্ত্রণ করবে বিভাগীয় পর্যায়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিস।
খ. প্রতিটি বিভাগে অন্তত একটি পূর্ণাঙ্গ, সর্বাধুনিক সুবিধাসম্পন্ন ও বিশ্ব মানের টারশিয়ারি সেবা হাসপাতালের প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করতে হবে-যা জটিল ও বিশেষায়িত চিকিৎসার জন্য একটি আঞ্চলিক রেফারেল কেন্দ্র হিসেবে কাজ করবে। যা নতুনভাবে গড়ে তোলা যেতে পারে, অথবা বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানসমূহকে ধাপে ধাপে উন্নীত করে করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ ও বিদেশি যৌথ বিনিয়োগ সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। বার্ধক্যজনিত স্বাস্থ্য সমস্যা সংশ্লিষ্ট সেবা (Geriatric Care)- কে অগ্রাধিকার দিতে হবে। স্বাস্থ্যের অবস্থা, স্বাস্থ্য সমস্যার অবস্থা ও রোগতাত্ত্বিক প্রয়োজনের আলোকে উপজেলা-ওয়ারি বাজেট ও পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করতে হবে। বিভাগীয় পর্যায়ে কার্যক্রম স্বশাসিত আঞ্চলিক স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ পরিচালিত করবে, যা নিয়ন্ত্রণ করবে বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিস।
গ. যে ব্যক্তি স্বীকৃত এমবিবিএস বা বিডিএস ডিগ্রি প্রাপ্ত নন, তিনি যদি চিকিৎসা অনুশীলন করেন, তবে তা আইনত বেআইনি কার্যক্রম হিসেবে গণ্য হবে। এমবিবিএস বা বিডিএস ডিগ্রি ব্যতীত কেউ নিজেকে ‘চিকিৎসক’ পরিচয়ে রোগী দেখতে পারবেন না। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিবে।
ঘ. একজন রোগী একটি রোগের চিকিৎসার জন্য একজন চিকিৎসকেকেই দেখাবে একাধিক চিকিৎসক বা বিশেষজ্ঞকে নয় কারণ তা সার্ভিস এর ডুপ্লিকেশন হয়। একজন রোগী ও ডাক্তার উভয়রেই সময় ক্ষেপন হয়। রোগীর চিকিৎসাজনিত জটিলতা বা প্রয়োজন বিবেচনায়, প্রয়োজনে মেডিকেল বোর্ড গঠন করে সমন্বিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে এবং চিকিৎসক রোগীকে উন্নততর চিকিৎসার জন্য উপযুক্ত বিশেষায়িত কেন্দ্রে প্রেরণ করবেন। এটা সরকারি ও বেসরকারী সকল ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে। সরকারি আধা সরকারি হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসক সে হাসপাতাল থেকে কোন রোগী ঐ চিকিৎসকের প্রাইভেট চেম্বারে যেতে পারবে না। হাসপাতালের কোন কর্মচারী চিকিৎসকের প্রাইভেট চেম্বারে রোগী প্রেরণ করলে তা শাস্তি যোগ্য অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হবে। চিকিৎসকের ওপর অতিরিক্ত চাপ না দেওয়া এবং প্রতিটি রোগীর জন্য মানসম্মত সময় ও যত্ন নিশ্চিত করার জন্য একজন চিকিৎসক সর্বোচ্চ দৈনিক ৫০ জন রোগী দেখতে পারবেন। প্রতি রোগীর জন্য অন্তত ১০ মিনিটের পরামর্শ সময় নিশ্চিত করতে হবে, এজন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক সেবা প্রদান কারীর উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে এবং সাপ্তাহিকভাবে প্রেসক্রিপশন নমুনা যাচাই পদ্ধতি চালু করা হবে।
৩. কোনো বিদেশি চিকিৎসক যদি বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলর অনুমতি ব্যতিরেকে বাংলাদেশে চিকিৎসা অনুশীলন করেন, তবে তা অননুমোদিত ও বেআইনি কার্যক্রম হিসেবে গণ্য হবে। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল কারও ডিগ্রির স্বীকৃতি ও পেশাগত যোগ্যতা যাচাই না করা পর্যন্ত কাউকে চিকিৎসা প্রদানের অনুমতি দিবে না।
চ. প্রতিটি হাসপাতালে নিরাপদ ও কার্যকর ওষুধ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে ক্লিনিক্যাল ফার্মাসিস্ট পদ সৃষ্টি করা অত্যন্ত জরুরি। এ লক্ষ্যে, প্রতিটি সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রে ক্লিনিক্যাল ফার্মাসিস্ট পদের সুযোগ ও পদোন্নতির সুনির্দিষ্ট কাঠামো তৈরি করতে হবে। এতে ওষুধের সঠিক ব্যবহার, রুগীর প্রতিক্রিযা মূল্যাযন, ড্রাগ ইন্টারঅ্যাকশনের ঝুঁকি কমানো এবং মাল্টিডিসিপ্লিনারি চিকিৎসা সেবায় ফার্মাসিস্টদের ভূমিকা সুসংহত হবে। এই পদ সৃষ্টি করলে চিকিৎসা সেবার গুণগত মান বৃদ্ধি পাবে এবং রোগীর নিরাপত্তা আরও নিশ্চিত হবে।”