“একজন বাবার গল্প”

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৪ এপ্রিল, ২০২১, শনিবার

লেখাঃ ডা. টি এইচ এম এনায়েত উল্লাহ খান

আমার ছবি তোলার আগ্রহ খুবই কম। প্রায় এক বছর এমন একজন মানুষের সান্নিধ্যে থাকার পরও কখনো মনে হয়নি তাঁর সঙ্গে একটা ছবি তুলি। চাকুরিজীবনের শেষদিনে যখন প্ল্যাটফর্মের পক্ষ থেকে আমার সহকর্মী আরাফাত তান্নুম আর আমি স্যারের জন্য ফুল নিয়ে যাই সেটা খুব বিনীতভাবেই প্রত্যাখ্যান করেন তিনি। সেদিনই প্রথম স্যারকে অনুরোধ করি তাঁর সাথে ছবি তোলার জন্য। উত্তরে তিনি বলেন, “ওকে আমি আমার মেয়ে মনে করি। আর তোমাকে আমার ছেলে মনে করি। যত খুশি ছবি তুলতে পারবা কিন্তু আজকে না।” কখনো ভাবিনি সেদিনের এই কথাগুলোই হবে স্যারের মুখে শোনা শেষ কথা। স্যারের সাথে শেষ দেখা।

ছবিঃ অধ্যাপক ডা. এ কে এম শামছুজ্জামান তোষার

গত এক বছরে একটা প্রজেক্টে কাজ করার সুবাদে স্যারের রুমে বসার সৌভাগ্য হয়েছিল। এই সময়ে খুব কাছ থেকে দেখেছি একজন মানুষ নিজের সবকিছু উপেক্ষা করে কিভাবে সর্বোচ্চটা দিতে পারেন। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, হার্ট ও কিডনী সংক্রান্ত জটিলতাসহ আরও অনেক রকম অসুস্থতা নিয়েও কখনো স্যারকে একটি দিন ছুটি নিতে দেখিনি। সেটা হোক ঈদের দিন অথবা অন্য কোনো উপলক্ষ। জানিয়েছিলেন, গত কয়েকমাস যাবৎ গলার ইনফেকশনটা বেশ ভোগাচ্ছিল। চিকিৎসকের পরামর্শে স্টেরয়েড সেবন করার ফলে কিছুতেই ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছিলো না। যার কারণে ভ্যাক্সিনও নিতে পারছিলেন না। শুধুমাত্র এই একটা ব্যপারেই স্যারকে কিছুটা আক্ষেপ করতে দেখেছি।

স্যারের দক্ষতা, একাগ্রতার একটা ছোট্ট নমুনা হলো একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে NILMRC এর ৭ লক্ষেরও অধিক করোনা নমুনা পরীক্ষা করা। কাগজে কলমের এ হিসেবগুলো হয়তো কমবেশি মানুষ জানবে, তবে জানবে না এর পিছনের গল্পগুলো কিংবা এসবের বাইরেও মানুষের উপকারের কথাগুলো। স্যারের কাছে কেউ কোনো অনুরোধ নিয়ে আসলে তিনি কাউকে না করতে পারতেন না।

আমার মত নগন্য এক মানুষ যখনই কোনো কিছু আবদার করেছি, কখনো না করেননি। বরং কিভাবে তা আরও সুন্দরভাবে করা যায় সেটাই দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। শুধুমাত্র আমার একবার করা অনুরোধে ঢাকার অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজগুলোতে একাধিকবার পেশাগত পরীক্ষার্থীদের করোনা নমুনা পরীক্ষা করা ও দ্রুততম সময়ে তাদের নমুনা পরীক্ষার ফলাফল দেবার ব্যবস্থা করেন। প্ল্যাটফর্ম এর উদ্যোগে গত বছর যখন চিকিৎসকদের বাসা থেকে করোনা নমুনা সংগ্রহ করা হয়, বিনা দ্বিধায় তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠানে নমুনা পরীক্ষার অনুমতি দেন। পরিবহন সংক্রান্ত জটিলতা জানার পর নিজেই একটি গাড়ির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। এবছর যখন আবার সেই উদ্যোগ নিতে চেয়ে স্যারকে জানাই, অত্যন্ত উৎসাহের সাথে তিনি রাজী হন। কিন্তু সেটা শুরু করার আগেই কখনো ভাবতে পারিনি এমন একটা লেখা লিখতে হবে।

ছবিঃ অধ্যাপক ডা. এ কে এম শামছুজ্জামান

স্যারকে যতদিন দেখেছি, নিজের জন্য কখনো কোনো সুপারিশ বা সুবিধার কথা কাউকে বলেননি। অথচ তাঁর প্রতিষ্ঠানে কর্মরত পঞ্চান্ন স্বেচ্ছাসেবী মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের জন্য কোনো পদক্ষেপ নিতে পিছপা হননি তিনি।

করোনায় আক্রান্ত হয়ে শহীদ চিকিৎসকদের সঠিক তথ্য খুঁজছিলেন জানতে পেরে স্যারকে সেই তালিকাটা যখন দেই তখন সেটা দেখে বলেছিলেন, “আমি প্ল্যাটফর্মের রেফারেন্স দিয়ে এই তালিকাটা ব্যবহার করব। যদি তাদের জন্য অন্য কিছু নাও করতে পারি অন্তত আমার প্রতিষ্ঠানের বাইরে তাদের নামগুলো লিখে রাখব যেন মানুষ তাঁদের কথা জানতে পারে।”

স্যারকে খুব বলতে ইচ্ছে করছে, এরকম তালিকায় আপনার নামটা না থাকলে কি খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যেত? গত বছরের তুলনায় এবার তো করোনার প্রকোপ আরও বেশি। তাহলে আপনি কেন আমাদের একা করে যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে চলে গেলেন?

ছবিঃ অধ্যাপক ডা. এ কে এম শামছুজ্জামানের লেখা শেষ চিঠি

এর আগে স্যারের যেসব লেখা প্ল্যাটফর্মের ব্যানারে প্রকাশিত হয়েছে, প্রতিটা লেখা স্যার নিজে দেখে সংশোধন করে দিয়েছেন। এবারের যে অগোছালো লেখাটা আপনাকে নিয়ে লিখছি, এটার সংশোধন কিভাবে করব সে প্রশ্নের উত্তরটাও জানতে ইচ্ছে করছে। সবসময় মানুষকে বাবা হারাতে দেখেছি। একটা প্রতিষ্ঠান যে বাবা হারা হতে পারে আজ সেটা উপলব্ধি করতে পারলাম।

হৃদিতা রোশনী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

"অধ্যাপক ডা. এ. কে. এম. শামছুজ্জামান স্যারকে যেমন দেখেছি"

Sat Apr 24 , 2021
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৪ এপ্রিল, শনিবার, ২০২১ লেখাঃ আরাফাত তান্নুম বাংলাদেশে কোভিড-১৯ এর শুরুর দিক। করোনা কন্ট্রোল রুমে প্ল্যাটফর্মের হয়ে ভলান্টারি ওয়ার্ক করছি। প্রচুর মানুষের করোনা পরীক্ষা হচ্ছে, রেজাল্ট কিভাবে দ্রুত পৌঁছানো যায়, কী করে ডেটাগুলো সংরক্ষণ ও প্রেরণ করা যায়, সে কাজ ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ ল্যাবরেটরি মেডিসিন ও রেফারেল সেন্টারে […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo