লাইফ ইন লকডাউন, ডে হান্ড্রেড সেভেনটি ফাইভ

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৪ অক্টোবর ২০২০, রবিবার
ডা. শুভদীপ চন্দ

আজ বাতাসে আলাদা কিছু ছিল। সূর্যদেব পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়েছেন। আরেকটু পরেই মেঘের পকেটে ঢুকে যাবেন। আর পরিত্রাণ পাবেন না।

আমাদের বাইক চলছিলো সাঁইসাঁই করে। ডুবন্ত সূর্যের আবির মেখে আছে জলে ডোবা ধানক্ষেত। একদম মাঝ বরাবর- মেয়েদের কপালের সিঁদুরের মতো লাগছে। অল্প একটু জায়গা কিন্তু সব ফোকাস সে-ই কেড়ে নেয়। মহাসড়কের পাশে সম্পদের ছড়াছড়ি। নদী, নদীর ধার, কাশফুল, বাড়ির উঠান, ফসলি জমি, বকেদের আড্ডা, কলাগাছের সারি। দেখে দেখে চলছিলাম।

ছবি – প্রতীকী

কখনো কখনো কাউকে খুব পরিচিত মনে হয়। ওই যে রোগা জীর্ণ মানুষটা। মাথার চুল এ কয়দিনে সব পড়ে গেছে। ধীরপায়ে হাঁটছেন। আগে পারতেন না, এখন অভাবে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এখন খিদে সহ্য হয়, রোগে ভুগা সহ্য হয়, অপমানও সহ্য হয়। তিনি অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। সকালে এসে দাঁড়িয়ে থাকেন। একমাসের প্রেশারের ঔষধ ফ্রি নেন। সাথে কয়টা গ্যাসের ঔষধ। প্যারাসিটামল ট্যাবলেট।

মাঝেমধ্যে ছেলে হারা বাপকেও দেখি। ত্রিশ বছর ধরে ঘুমাতে পারেন না। মানুষ একবার গেলে কী আর ফিরে আসে? হয় হারিয়ে যায় নয়তো মারা যায়।

চারতালা বাসার বারান্দায় এক নীল অপরাজিতা ফুল ধরেছে। আমার জানালা দিয়ে দেখা যায়। ভদ্রলোক ছাদে বাগান করেছেন, বারান্দার টবে গাছ লাগিয়েছেন। পৌরসভায় চাকরি করেন। যখনি দেখি বাসায়ই থাকেন। একটি মোটরসাইকেল সিঁড়িঘরে পড়ে থাকে। সময় গময় হীন রবীন্দ্রসংগীত শোনেন। তার স্পিকারে আমিও শুনি। জানালা দিয়ে আসা যেকোনো কিছুকেই সুস্বাগতম। রবীন্দ্রনাথের কোনটি পূজার গান কোনটি প্রেমের গান আলাদা করতে পারি না।

আমার ঘরের ঘড়িটা নষ্ট। সময় আটকে রাখার এরচেয়ে ভাল বুদ্ধি আর পাই নি। যখনি দেখি চারটা বেজে সাঁইত্রিশ মিনিট। শান্তি পাই সময়ের অপচয় করছি না! বাসায় মার সাথে এখন প্রায় প্রতিদিনই মনোমালিন্য হয়। আমার কথা তারা বুঝে না, তাদের কথা আমি। এক বন্ধু তার লেখা গল্পে ট্যাগ দেয়। তার নিজের প্রেম ইতিহাস। প্রেমের গল্প কী লেখার জিনিস? প্রেমকে হতে হবে ভোরের প্রথম সূর্য রশ্মির মতো। যে ফুলের উপর পড়বে তাকে চমৎকার দেখাবে কিন্তু সে বুঝবে না বিশ্বসংসারের কী কাজে সে আসবে। যে মেয়েকে নিয়ে লিখছে তারও তো জীবন আছে, ছেলে পেলে আছে, স্বামী আছে, নতুন পরিচয় আছে।

সারাদিন বন্ধুর মতো ঘুরেফিরে ক্লান্ত গায়ে বিহ্বল দৃষ্টি নিয়ে ঘরে ফেরায় প্রেম থাকে। সে চোখ আমি দেখেছি। তেমনি এক পক্ষের চলে যাওয়ায় বুকে জমাট শ্বাসকষ্টও দেখেছি। গতকালই ইমার্জেন্সিতে এক আঠারো বছর বয়সী মেয়েকে দেখলাম। দুইদিন ধরে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রয়েছে। মানুষের চোখ বড় অদ্ভুত জিনিস। একজন অন্ধও স্বপ্ন দেখতে পারে। কোনো পা বিহীন মানুষ কী হাঁটতে পারবে? আবার বয়স হতে হতে চোখের জল শুকোতে থাকে- এটি খুব শান্তির কথা। বিরহ অনলে পৃথিবীর বেশিরভাগ গল্প কাব্য মনেহয় লেখা হয়েছে। বিরহ মানেই অন্ধকার, নিগেটিভ কিছু। যখনই তার সাথে ‘অনল’ যোগ হয় আলোর এক উৎস পাওয়া যায়। এদিক থেকে আমার লেখক বন্ধুটিকে খুব বেশি দোষ দিতে পারি না।

আজ জেলার সিভিল সার্জন এসেছিলেন। কোভিড রোগী নেই বলে করোনা ওয়ার্ড বন্ধ করে দিতে বললেন। একগাদা র‍্যাঙ্কিং দেখালেন। আমরা প্রায় সব র‍্যাঙ্কিংয়ে পিছিয়ে আছি। ২০১৮ সালের কোন এক সময় নাকি এ উপজেলা ফার্স্ট ছিল। এ কম্পিউটারাইজড স্ট্যাটিস্টিক্স গুলোকে কেমন জানি লাগে। মনে হয় সফটওয়্যার কোন একদিন চিৎকার করে বলবে- ‘বলছি না তোরা সুখী, এতো অসুখ অসুখ করিস কেন!!’ তবে এসব র‍্যাঙ্কিং ফ্যাঙ্কিং এর দরকার আছে। কিছুটা হলেও আত্মোপলব্ধি হয়।

আমাদের সমস্যা জড়ত্বে সমস্যা। চিন্তায়, কাজে, অনুভূতিতে। আমাদের ডাক্তাররা একই রকম ডায়াগনোসিস করে, নীতি নির্ধারকরা সেবা বলতে ফ্রি ঔষধ সাপ্লাইকে বুঝে, নেতারা ক্ষমতা দেখাতে ওই চোটপাটই করে, একই রকম বক্তৃতা বিবৃতি- র‍্যাবিসের উপর প্রোগ্রাম হোক বা বিদায় অনুষ্ঠান, স্ট্যাটাসওয়ালারা এক ধরনের স্ট্যাটাস ই লিখেন। জড়ত্বের কোন ক্ষয়রোগ নেই, অবেসিটিও নেই। যতদিন না একজন মাঠে কাজ করে যাওয়া লোক ওই চেয়ারগুলোতে বসছেন ততদিন কোন উন্নতি হবে না। এক দুইজন বসেন ঠিক তারা আবার পুরোদস্তুর ‘কামলা’। কাজ করতে করতে চিন্তা করার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলেন। ফলে সে একই ‘জড়ত্ব’।

আমরা নদীপাড়ে যখন পৌঁছালাম তখন সন্ধ্যা প্রায় লাগেলাগে। সূর্যদেব ঘাটে পৌঁছে গেছেন, চাঁদের নৌকা ছেড়ে দিয়েছে। কোন পক্ষ জানি না। দুই চার দিন বাদেই হয়তো পূর্ণিমা হবে। আকাশে চাঁদ দেখেই মন খারাপ হয়। পাগলের লক্ষন কি না কে জানে! শুনেছি ল্যাটিন luna মানে চাঁদ, এ লুনা থেকেই ইংলিশ lunatic (পাগল) শব্দের উৎপত্তি। মাথাভর্তি অপ্রয়োজনীয় কথা। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ যেমন বলতেন- ‘কত মণি পড়ে আছে (আমার) চিন্তামণির নাচদুয়ারে!’

Platform

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

ডা. শুভাগত চৌধুরীর স্বাস্থ্যবার্তা: আলযাইমার আর ডিমেনশিয়া নিয়ে কিছু কথা

Sun Oct 4 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৪ অক্টোবর ২০২০, রবিবার অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী সেপ্টেম্বর মাস আলযাইমার আর ডিমেনশিয়া নিয়ে কথা বলার মাস। এই রোগের চারধারে যে রহস্যের জাল বিছানো, একে ছিন্ন করে একে নিয়ে কুসংস্কারের আঁধারকে আলোয় ভরিয়ে দেয়ার একটি মাস। ডিমেনশিয়া প্রতিরোধযোগ্য, অন্তত উপসর্গ আসা বিলম্বিত করা সম্ভব। আছে কিছু ঝুঁকি, যেগুলো […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo