মৃত্যু সবসময় প্রশ্ন রেখে যায় কি? কখনো কি উত্তরও দিয়ে যায় না!

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ১২ জুলাই, ২০২০, রবিবার

ডা. মোঃ হাবিবুল্লাহ তমাল
অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ৪৭তম

কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতাল।
লম্বা, সৌম্য চেহারার ভদ্রলোক আমার কিউবিকলে ঢুকে সামনের চেয়ারে অনুমতি নিয়ে বসলেন।

– ডাক্তার সাহেব, লাইফ সাপোর্ট নিয়ে আমার একটা প্রশ্ন ছিল।
– বলুন, কি জানতে চান?
– আচ্ছা, এই যে কৃত্রিমভাবে একটা মানুষের হার্ট, ফুসফুস মেশিন দিয়ে চালানো হচ্ছে, এটা শরিয়ত বিরোধী না?
এরপর প্রায় চল্লিশ মিনিট ধরে উনাকে আর্টিফিসিয়াল রেসপিরেশনের বিভিন্ন দিক কমবেশি বুঝিয়ে বললাম। সমঝদার মানুষ, বুঝলেন।

ছবি প্রতীকী

ভদ্রলোক ষাটের কাছাকাছি বয়সী হবেন হয়তো। বুয়েট থেকে পাশ করা ইঞ্জিনিয়ার, বাকি ভাইবোনেরাও উচ্চশিক্ষিত, পুরো ফ্যামিলিই নম্র-ভদ্র, পরহেজগার কাপড়-চোপড় আচার-আচরণে। উনার মা আমার রোগী ছিলেন আইসিইউ’তে। ভদ্রমহিলার বয়স আশির উপরে, নানা ধরনের রোগ বালাই আগে থেকেই ছিল, সাথে নিউমোনিয়া হয়ে ভয়াবহ রকমের অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, সে কারনেই আইসিইউ’তে। প্রথম দফায় তাকে ভেন্টিলেটরে দেয়া হয়েছিল একবার, কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠায় ভেন্টিলেটর খোলা হয়েছিল, একদিনের মধ্যেই আবার অসুস্থ হয়ে পড়ায় দ্বিতীয়বারের মত ভেন্টিলেটরে দিতে বাধ্য হয়েছিলাম। দু’দফা মিলিয়ে প্রায় একুশ দিনের মত আইসিইউতে ভর্তি ছিলেন।

আরেক রাতের ডিউটির কথা…

রোগীর বড় ছেলে, প্রথমে যার কথা বলেছি, আমার কাছে আসলেন, অত্যন্ত বিমর্ষ। কথা বলে জানলাম তারা চাইছেন না রোগীকে আর আইসিইউ’তে রাখতে। টাকাপয়সার কোন সমস্যা নেই, কিন্তু মা’কে এভাবে কষ্টে রেখে দিনের পর দিন তেমন কোন উন্নতি না হওয়ায় উনারা হতাশ। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল তার মনের দ্বন্দ, একদিকে মা’র চিকিৎসা মাঝপথে থামিয়ে দেয়ার মনোকষ্ট, অন্যদিকে মা’কে এত কষ্টে দেখার বেদনা। কোন পথে যাবেন উনারা বুঝতে পারছিলেন না। অনেকক্ষণ কথাবার্তা বলে সিদ্ধান্ত হল, পরদিন সকালে কনসালটেন্ট স্যারের সাথে আলোচনা করে তারা ভেন্টিলেশন ডিসকন্টিনিউ করে নিয়ে যাবেন তাদের রোগীকে। বাকিটা যা হবার হবে।

পরদিন সকালে আমার মেডিকেলে ডিউটি ছিল না বলে সকালের ডাক্তার আসার পরেও আমি ওখানেই ডিউটি রুমে কিছুক্ষণ ঘুমালাম। এগারোটা নাগাদ ঘুম ভেঙে দেখলাম ভদ্রলোক আইসিইউ’তে দাঁড়ানো, এম্বুলেন্স নিয়ে এসেছেন, রোগীকে নিয়ে যাবেন তারা। মুখ ধুয়ে এসে দাঁড়াতেই শুনলাম নার্স বলে উঠছেন, ১ নাম্বার বেডের রোগী খারাপ হয়ে যাচ্ছেন। সকালের ডাক্তারের সাথে আমিও দৌড়ে গেলাম। সেই ভদ্রলোকের মা নিজের সন্তানের মনঃকষ্টের ইতি ঘটিয়ে আইসিইউ থেকে বের হবার আগেই শেষ নিঃশ্বাস নিলেন। ভদ্রলোক আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলেন।

সম্ভবত এভাবেই ভাল মনের মানুষের অন্তর্জালার অবসান ঘটে। মা’র প্রতি দায়িত্ব তার সন্তানেরা অন্তত সাধ্যানুযায়ী পালনও করলেন। অপরদিকে মা’র চিকিৎসা ডিসকন্টিনিউ করার মানসিক যন্ত্রনা থেকেও বেঁচে গেলেন সন্তানেরা।

মৃত্যু সবসময় প্রশ্ন রেখে যায় কি?? কখনো কি উত্তরও দিয়ে যায় না! আমার দেখা এই ঘটনাটাকে আমার সবসময় একটা ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপের মতো এখনো মনে হয়।

(ঘটনাটা বছর তিনেক আগের।)

Platform

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

কোভিড-১৯: ভিয়েতনামে সুস্থ হয়েছেন সবচেয়ে গুরুতর অসুস্থ ব্যক্তিটিও

Sun Jul 12 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ১২ জুলাই ২০২০, রবিবার ভিয়েতনামে কারো প্রাণ কেড়ে নিতে পারেনি কোভিড-১৯। সবচেয়ে গুরুতর রোগিটিও এখন সুস্থ। করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সফল ভিয়েতনাম এখনো মৃত্যুহীন। দেশটিতে করোনায় আক্রান্ত সবচেয়ে গুরুতর রোগীটিও সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। যুক্তরাজ্যের নাগরিক স্টেফেন ক্যামেরন পেশায় একজন পাইলট। ৪৩ বছর বয়সের ক্যামেরন গত মার্চের শুরুর দিকে […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo