করোনার দিনগুলোয়-৯ ।। ঝড়ের রাতে আমরা

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, বুধবার, ২০ মে, ২০২০

আমি রুমে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। ইফতারের পর পর কার না ক্লান্তি লাগে? আমিও সীমাহীন ক্লান্তি নিয়ে শুয়ে ছিলাম। খুব আনন্দিত ছিলাম যে করোনা আক্রান্ত রোগীদের এই উপজেলাতে রেখেই সুস্থ করেছি। ভালো লাগছিলো এই ভেবে যে এই উপজেলাটি করোনা মুক্ত। এই সুখ স্বপ্ন কতদিন থাকবে তা নিয়ে ভাবছিলাম। এমন সময় ফোন আমাদের দরিকান্দি ইউনিয়নের স্বপন চেয়ারম্যানের। তিনি আমার খুব কাছের একজন। খুব দায়িত্ববান। স্কুলে একবছরের সিনিয়র ছিলেন।প্রাইমারী এবং সেকেন্ডারি দুজায়গাতেই। সেজন্য সম্পর্কটা বড় ভাই ছোট ভাইয়ের মতোই। তিনি জানালেন তার গ্রামে রীতিমতো করোনা আক্রান্ত রোগী এসে উপস্থিত। সে এসেছে গাজীপুর থেকে। রিপোর্ট এসেছে অল্পকিছুক্ষন আগে, ইফতারের পরপরই। যদি ও তার কোয়ারেন্টাইনেই থাকার কথা ছিলো তবু ও সে কেন চলে আসলো তার সদুত্তর দিতে পারেনি।

এই রাতে বের হওয়া খুবই রিস্কি ব্যাপার। একে তো ৭ নম্বর সতর্ক সংকেত তার উপর ঝড়ো আবহাওয়া। করোনা এবং ঘূর্ণি ঝড় আম্ফান একই সাথে। আল্লাহতায়ালা যে কত পরীক্ষা নিবে আমাদের! মনটা এমনিতেই ভারাক্রান্ত। রমজানের এই রাতে সবাই যখন সুখনিদ্রা যাপন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন আমরা প্রস্ততি নিচ্ছি করোনা আক্রান্তকে দেখতে যাওয়ার। কেননা মানুষ খুবই আতংকিত হয়ে পড়ে। রোগী হয়তো করোনা আক্রান্ত কিন্তু মারা যেতে পারে ভয়ে হার্টএটাকে। তাই এই ছেলেটিকে সাপোর্ট দিতে আমরা রওয়ানা হলাম দরিকান্দি গ্রামে। এটি আমার নিজের ইউনিয়নও।

নিজের অসুখ বিসুখ, আনন্দকে বিসর্জন দিতে হয় প্রায়ই আমাদের। আমরা সেটা করিও। কিছু মানুষ এর মধ্যেই এমন সব কাজ করে যেন মনে হয় আমরা মানুষ না। আমরা যারা এই করোনা যুদ্ধে সামিল হয়েছি তারা বেঁচে থাকছি পুরোটাই আল্লাহর ইচ্ছায়। যখন রোগী এটেন্ড করি তখন যে কোন মূহুর্তে আক্রান্ত হতে পারি। আমাদের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা দিয়ে যথাসম্ভব সেফটি মেইনটেইন করি। এর পরেও ডাক্তারগণ আক্রান্ত হচ্ছেন মারাও যাচ্ছেন। কেননা আক্রান্ত ব্যক্তির নিশ্বাস ফেলার সাথে বের হয়ে আসে লক্ষ লক্ষ ভাইরাস। যেটি বাতাসে উড়ে কোন না কোনভাবে আক্রান্ত করতে পারে। তাইতো বিদেশে ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মীরা পাচ্ছে বীরের মর্যাদা। কেননা এটি যে এক ভয়ংকর যুদ্ধ। বায়োলজিক্যাল ওয়ার যার নাম “হোয়াইট কোট ওয়ার” বা কোভিড ওয়ার। সেজন্যই তাদেরকে সামাজিক মর্যাদা থেকে শুরু করে ফাইভ স্টার হোটেল,  সুপারশপ সব জায়গায় স্পেশাল সুবিধা দিচ্ছে।
সারা পৃথিবীই বীরদের সম্মান দিচ্ছে। তাদের খুশি করতে বিভিন্নভাবে মানুষ সহায়তা করছে। আমাদের দেশেও ফাইভস্টার হোটেলে ডাক্তারদের রাখছে। যাতায়াত ব্যবস্থাও করছেন। এটি মানুষের প্রতি আত্মত্যাগের স্পৃহার জন্য ছোট্ট একটি সম্মান মাত্র। এটি নিয়মের বাইরেই দেয়া হচ্ছে। যোদ্ধারা কিছু অতিরিক্ত সুবিধা পেতেই পারেন। এসব সামান্য সুবিধারও সমালোচক আছে। এই সমালোচকদের মানুষ রাজাকার বলে গালি দেয়।

রোগীকে দেখার আগেই দেখা হয়ে গেলো এই গ্রামের যুবলীগ নেতা খোকন এর সাথে। সে আমাদের অপেক্ষায় ছিলো। সেই পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো আমাদের। খোকনের সব কথা শুনে আনন্দিত হলাম। কেননা রোগীর জটিল সমস্যা নেই এখন আর এবং তিনি সংশ্নিষ্ট সবাইকে কোয়ারেন্টাইন দিয়ে দিয়েছেন। রোগীর ট্রেসিং সম্পূর্ণ করেছেন খোকন এবং তার বন্ধুরা। এটি আসলে চমৎকার একটি ব্যাপার। চিকিৎসার অর্ধেক কাজ সেরে ফেলেছে গ্রামবাসী নিজেরাই। সংশ্লিষ্ট সবাই কোয়ারেন্টাইনে। রোগীর সাথে যারা একই অটোতে ছিলো তারা সবাই কোয়ারেন্টাইনে। ড্রাইভার কে খুঁজে বের করে তাকেও কোয়ারেন্টাইনে দিয়েছে। রোগী আলাদা ঘরে সেলফ আইসোলেশনে। তার সবকিছু এমনকি আলাদা বাথরুমও ব্যবস্থা হয়ে গেছে। এতো চমৎকার ব্যবস্থা ভাবা যায়? কেউ বলেনি যে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান অথবা ঢাকা পাঠিয়ে দিন।

এটি আসলে গত দুইমাস ধরে আমাদের পরিশ্রমের ফসল। আমরা সকল গ্রাম ঘুরেছি। এমনকি শিবপুর, ঝুনার চর, চরলহনিয়ার মতো রিমোট গ্রামেও গিয়েছি। মেম্বার, চেয়ারম্যানগণের সাথে মতবিনিময় করেছি। ভলান্টিয়ার তৈরী করেছি দুই মাস আগেই। সাথে আমাদের ছিলো সোশ্যাল মিডিয়া এবং স্থানীয় সাংবাদিক ভাইয়েরা। ছোট বড় সকল পত্রিকা এবং অনলাইন পোর্টালগুলোও সহযোগিতা করেছে। তার ফল এখন আমরা পাচ্ছি। আমাদের কাজ অনেকাংশ করে দিচ্ছে কমিউনিটির লোকজনই।
আমরা তার চিকিৎসা এবং সাপোর্ট কাউন্সেলিং করে বিদায় নিলাম। ছেলেটিকে দেখে মনে হলো সে চমৎকার আশ্বস্ত হয়েছে। আপাতত তার কোন সমস্যাই নেই। প্রথম থেকেই কমিউনিটিকে অংশগ্রহন করানো ছিলো আমাদের একটি সেরা কাজ। আমরা মার্চের ভিতরেই ভলান্টিয়ার তৈরী শেষ করে ফেলেছিলাম। এখন ওরাসহ কমিউনিটির সকলেই স্বেচ্ছায় কাজ করছে, কি করতে হবে বুঝে গেছে। করোনা আক্রান্তকে ঘরে রেখে চিকিৎসা দলকে জানাচ্ছে। আমরা শুধু চিকিৎসাটুকু করছি।
আমাদের পরামর্শ হলো করোনা রোগীকে বাইরে ঠেলে দেয়া নয়, ঘরে আলাদা করুন। কেননা বাইরে গেলেই সে ছড়াতে থাকবে। ঘরে আইসোলেশনে মানে সম্পূর্ণ আলাদা ঘরে থাকলে এবং নিয়ম কানুন মেনে চললে সে আর ছড়াতে পারবে না।চিকিৎসা চলবে নিয়ম অনুসারে। প্রতি ১০০ জনের ৯০ জনই ঘরে চিকিৎসায় ভালো হবেন। আপনারা সহযোগিতা করলে আমরা সফল হবোই।

আমার এই উপজেলার জনগনের অংশগ্রহন খুবই আনন্দদায়ক। অন্য উপজেলায় যেখানে করোনা রোগীকে রাস্তা দিয়ে গাড়িতে যেতে দেয়না সেখানে এখানকার জনগন চমৎকারভাবে রোগীর সেবা করছে। বাড়ির বাজার করে দিচ্ছে। মানুষ সচেতন থাকলে কোন রোগই কোন সমস্যা না। আমরা করোনায় আতঙ্কিত না হয়ে বুদ্ধি দিয়ে নিয়মকানুন মেনে জয় করছি।

জয় হোক বাঞ্ছারামপুরবাসীদের। আমি এ উপজেলার সন্তান হিসেবে গর্বিত। আশা করছি এ উপজেলাকে করোনা মোকাবেলায় এদেশের একটি মডেল উপজেলা হিসেবে দাঁড় করাতে পারবো।

ডা. মোহাম্মদ আল-মামুন
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা
বাঞ্ছারামপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

জামিল সিদ্দিকী

A dreamer who want to bring positive changes in health sector in Bangladesh.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

চিকিৎসকদের রক্তের ঋণ শোধ করা সম্ভব কি?

Wed May 20 , 2020
বুধবার, ২০ মে, ২০২০ গত ২৭ এপ্রিল থেকে কোভিড রোগীদের জন্য প্লাজমা সংগ্রহের কাজ শুরু করেছিলাম। দিয়েছিলেন ডা. রাকিন। এরপর কতজন দিয়েছেন সেটা উল্লেখ করবোনা, হয়ত উল্লেখ করলে ভালো হত। আজ সকালে একজন মহিলা চিকিৎসক আসলেন, গতকাল উনি যোগাযোগ করেছিলেন প্ল্যাটফর্মের সূত্রধরে। আজ আসলেন প্লাজমা দান করতে, ইচ্ছা ছিল যতটুকু […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo