একজন সিরিয়াল কিলার এবং বিশ্ব টিবি দিবস

DSC00298একজন সিরিয়াল কিলার ঘুরে বেড়াচ্ছে আপনার শহরে । সকল সন্দেহের বাইরে সে । তার দু’চোখ রক্ত লাল নয় । শরীরের প্রতি ইঞ্চি তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও কোন মারণাস্ত্র পাবে না পুলিশ । আগামী এক বছরে অন্তত ১০ জন খুন হবে । কোটি মানুষের এই শহরে অন্তত কয়েক হাজার নারী-শিশু-সংসারের উপার্জনক্ষম এক মাত্র পুরুষ আছে তার হিট লিস্টে ।

মনে করি খুনি পেশায় একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক । বেশ কিছুদিন ধরেই তার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না । দেশের সেরা চিকিৎসককে দেখালেন, দেশের সেরা ফাইভ স্টার বেসরকারী হাসপাতালে ভর্তি থাকলেন । ডাক্তাররা একটু বেশি বেশি বলেই সব সময়-ছয় মাস ওষুধ খেতে বলেছিল, পূর্ণ বিশ্রাম নূন্যতম দুই সপ্তাহ । ডাক্তারের সব কথা শুনলে জীবন চলে না, ছয়-সাত দিন এন্টিবায়োটিক খেয়েই একটু ভালো বোধ করায় অধ্যাপক সাহেব ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দিলেন । প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির চাকরি । প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীদের সেমিস্টার শেষের দিকে, পাওনা Casual Leave ও শেষ । ২১ দিনের বেশি ছুটি কাটালে বেতন কাটা যাবে ।
“Is there another Life? Shall I awake and find all this a dream? There must be we cannot be created for this sort of suffering”.

প্রিয় বন্ধু চার্লস ব্রাউনকে লেখা জন কিটসের শেষ চিঠি । “মারিয়া ক্রাউদার” জাহাজে কিটসের শেষ সমুদ্র যাত্রায় রক্ত বমি-কাশির অসহ্য যন্ত্রণা রফিক স্যারের চোখে মুখে ফুটে উঠেছে । ইংলিশ লিটারেচারের অধ্যাপক রফিক স্যারের কন্ঠে গমগম করছে জন কিটসের মাত্র ২৬ বছর বয়সে-অসময়ে মৃত্যুর দুঃখ । পিন পতন নীরবতা-ক্লাস ভর্তি ছেলে মেয়ে মন্ত্র মুগ্ধ অথবা স্যারকে ইমোশনাল হতে দেখে হতবাক । এদেরই একজন রফিক স্যারের শিকার হবে আজ । ৪৫ মিনিটের ক্লাসে স্যার ১৮ বার কাশি দিয়ে সরি বলেছে-বদ টাইপের এক ছেলে সহপাঠীর দিকে একটা কাগজে এ লাইনটা লিখে এগিয়ে দিয়ে মজা করলো । জ্বর-দূর্বলতা কেটে গেলেও রফিক স্যারের খুসখুসে কাশিটা রয়ে গেছে । এটা নিয়েই তিনি গত কয়েক মাস ক্লাস চালিয়ে যাচ্ছেন । ১৯ নম্বর বার কাশির পর স্যার টেবিলের সামনে থেকে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসে পড়লেন । কিটসের মত তাঁরও কাশির সাথে রক্ত গেল এবার । গল্প নয় কিছু দিন আগে টিউবারকুলোসিস প্রোগ্রামের ট্রেনিং সেশনে এমনই একজন সত্যি অধ্যাপকের কথা শুনে এসেছি-সে ট্রেনিং নিয়ে এ লেখা ।

রফিক সাহেবের কফ পরীক্ষা করে MDR TB ( Multi Drug Resistant Tuberculosis) পাওয়া গেল । এর মানে টিবির জন্য সাধারণ প্রচলিত ওষুধে এই যক্ষ্মা ভালো হবে না । কলেরা-জন্ডিস-টাইফয়েড না হয় দূষিত পানি, রাস্তার খাবারের মাধ্যমে ছড়ায়, ওগুলো না খেলেই আমরা নিরাপদ থাকবো । কিন্তু টিবি ছড়ায় বাতাসে এবং নিঃশ্বাস নেয়া বন্ধ করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় । রফিক সাহেব যতদিন ক্লাস ভর্তি ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে হেঁটে হেঁটে ক্লাস নিয়েছেন ততদিন মরণ ব্যাধির জীবাণু ছড়িয়ে দিয়েছেন বাতাসে । রফিক সাহেবের মত এ মুহুর্তে বাংলাদেশে ৪৭০০ জন ঘুরে বেড়াচ্ছেন আপনার আশেপাশে and we are sharing the same air । তবে আসল সিরিয়াল কিলার রফিক সাহেব নন, কারণ MDR TB হলে তাও ব্যয়বহুল চিকিৎসার (৫-৬ লাখ টাকা এবং রোগীর জন্য ও কষ্টদায়ক অন্তত ২ মাস ইঞ্জেকশন নিতে হয় টানা) মাধ্যমে ভালো হওয়া সম্ভব । কিন্তু যারা ভালো হবেন না তাঁদের বলা হয় XDR (EXTENSIVE DRUG RESISTANT TB) । বাংলাদেশে চিহ্নিত XDR TB রোগী ছিল ১০ জন, মারা গেছেন বা চিকিৎসা নিচ্ছেন এরকম রোগী সরকারের হিসেবে ৯ জন । দশম জন লাপাত্তা-মানে একজন XDR TB ১৭-১৮ কোটির এই বাংলাদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে । একজন MDR টিবি প্রতি বছর দশ জন সুস্থ্ মানুষকে আক্রান্ত করে, আর একজন XDR TB কী ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে আল্লাহ জানেন ।

এইডস এর পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মানুষ যে ইনফেকশনে মারা যায় সেটা হচ্ছে যক্ষ্মা । পৃথিবীর প্রাচীনতম অসুখ ৭০,০০০ বছর আগে যার উৎপত্তি, ৫০০০ বছর আগে প্রাগৈতিহাসিক মানুষের শরীরে, মিশরের মমির গায়েও যক্ষ্মা চিহ্ন রেখে গেছে । অবাক হবেন না, আমার আপনার বাংলাদেশের প্রতি তিন জনের দুই জনের গায়ে এই মুহুর্তেই যক্ষ্মার জীবাণু ঘুমন্ত অবস্থায় আছে । সে দৈত্য কখনো যদি জাগে সেটাকে গুরুত্বের সাথে যেন বশ করেন সে জন্যেই এ লেখা , টেকনিক্যাল দিকগুলো হয়ত অন্য কোন লেখায় লিখবো ।

বাংলাদেশে মোট রোগী ৬ লক্ষ ৩০ হাজার, প্রতি লাখে ৪০২ জন, বছরে মারা যায় ৮০,০০০ জন । বাংলাদেশে সর্ব প্রথম যক্ষ্মা নিয়ে কাজ শুরু হয় ১৯৬৫ সালে, এরপর উপজেলা ভিত্তিতে সেবা প্রদান শুরু হয় ১৯৮০ সালের পর, ১৯৯৩ সালে ডটস স্ট্র্যাটেজি শুরু হয়, MDG Goal-6 এ চিকিৎসা সফলতার হার ৮৫% অর্জিত হয় ন্যাশনাল টিউবারকুলোসিস কন্ট্রোল প্রোগ্রামের আওতায় ২০০৩ সালেই, গ্লোবাল ফান্ড বৈদেশিক সাহায্যের আওতায় বিনামূল্যে যক্ষ্মার পরীক্ষা এবং ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে । যক্ষ্মা নিয়ে আইসিডিডিআর,বি, ব্র্যাক, ডেমিয়েন ফাউন্ডেশন সহ অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান কাজ করছে এর মাঝে ডেমিয়েন ফাউন্ডেশন একটা গবেষণা করছে যেখানে MDR TB এর ২৪ মাসের চিকিৎসা ৯ মাসে দেয়া, পৃথিবী ব্যাপী এটা বাংলাদেশ রেজিমেন নামে পরিচিত হবে যদি WHO অনুমোদন দেয় । বিএসএমএমইউ, মেডিকেল কলেজ, জেলা সদর-উপজেলা হাসপাতালসহ জেলখানা, তৈরি পোশাক শিল্প কারখানা সর্বত্র ডটস সেন্টার চালু আছে । এসব কিছু সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে যদি আমরা সচেতন না হই-তিন সপ্তাহের বেশি কাশি, কাশির সাথে রক্ত যাওয়া, বাচ্চাদের ওজন না বাড়া, এবং অবশ্যই অবশ্যই টিবি ধরা পড়লে ঠিক যত দিন যে নিয়মে ওষুধ খেতে বলেছে সেভাবে না খেলে বলা যায় না পরবর্তি সিরিয়াল কিলার হয়ত আপনি-আমি, আমাদেরই কাছের কেউ হয়ে যাবে । আপনি যত বড় ভিআইপি হোন না কেন সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রে অন্তত টিবির পরীক্ষানিরীক্ষা এবং চিকিৎসা করুন ।

পৃথিবী ব্যাপি ১১ মিলিয়ন রোগী, যুদ্ধ নয় বছরে ১ মিলিয়ন শিশু এতিম হচ্ছে যে রোগের কারণে, পৃথিবীর মানুষ মঙ্গল গ্রহে পা রাখার প্রস্তুতি নিচ্ছে যেখানে সেখান টিবি রোগের সর্বশেষ কার্যকর ওষুধটিও আবিষ্কার হয়েছে তিরিশ বছর আগে, পাইপ লাইনে নতুন ওষুধ, হাতে গোণা, এমন একদিন আসবে TB MAY BECOME INCURABLE DISEASE একটা ওষুধ ও কাজ করবে না-আমরা যদি সচেতন না হই । এই তথ্যগুলো ততক্ষণই তথ্য হিসেবেই মূল্যহীন থাকবে যতক্ষণ কাশিটা অন্যের গায়ে থাকছে , নিজের গায়ে চলে আসলে সেটা হবে ট্র্যাজেডি, অভিশাপ । আর জানেনই তো টিবি রোগীর সব চেয়ে কাছে কে বা কারা যায়? আমরা ডাক্তাররাই । ডাক্তারের সামনে আসলে রোগী সবার আগে ডাক্তারের উপরই কাশিটা দেয়-আপনার চেম্বারের কাশতে কাশতে যে রোগীটা একটু আগে বের হয়ে গেল সেও তো সেই একজন নিখোঁজ হয়ে যাওয়া XDR TB রোগী হতে পারে, হতে পারে একজন সিরিয়াল কিলার ।
(ইংরেজি সাহিত্যের রোমান্টিকতম কবি জন কিটস টিবি অসুখে মারা গিয়েছিল, আমাকে আমার মনি ডঃ লুৎফর রহমান বলে খ্যাপায় কারণ আমি নাকি বোরিং এবং কঠিন করে লিখি তাই বোরিং একটা লেখায় একটু থ্রিলার ভাব আনার বৃথা চেষ্টা করেছি বুড়িকে শায়েস্তা করতে) ।

(২৪ মার্চ বিশ্ব টিবি দিবস উপলক্ষে এ লেখা)

ডাঃ মোহিব নীরব

ডক্টরস ডেস্ক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

এবার দুই চিকিৎসকের ওপর হামলা

Tue Mar 24 , 2015
ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শনিবার সকালে চিকিৎসাধীন রোগীর অভিভাবকের হামলায় দুই চিকিৎসক আহত হয়েছেন। জানা গেছে, সকাল ১০ টার দিকে রোগীদের ওয়ার্ড পরিশর্দনের সময় চিকিৎসকরা বহিরাগতদের ওয়ার্ড থেকে বাহির হতে অনুরোধ জানান। এ কথা শুনে মহিলা ওয়ার্ডের ৪ নং বিছানায় ভর্তিকৃত রোগী সুমির শ্বশুর দিউ গ্রামের রুস্তম আলী উত্তেজিত […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo