“আমরা তোমাদের ভুলবো না”

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২০, সোমবার

ছবিঃ শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলীম চৌধুরী।

২৯ নম্বর পুরানা পল্টনের দোতলায় থাকতেন মিটফোর্ড হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. এ এফ এম আবদুল আলীম চৌধুরী। তাঁর নীচের তলায় থাকতেন মওলানা আব্দুল মান্নান, নীচের তলায় আগে ডা. আলীমের ক্লিনিক ছিল। কিন্তু মাওলানা সাহেব একবার বিপদে পড়ে প্রাক্তন স্পীকার এ, টি, এম, মতিনকে ধরে বসেন আশ্রয়ের জন্যে।

মতিন সাহেব আলীম সাহেবকে বললেন, “ডাক্তার চৌধুরী, ক্লিনিক উঠিয়ে মওলানাকে আশ্রয় দিন।”

১৫ ডিসেম্বর ঢাকায় তখন ভারতীয় বিমান হরোদমে বোমা বর্ষণ করছে। কার্ফুও চলছে। শুধু সকাল আটটা থেকে দুপুর বারোটা পর্যন্ত কার্ফু উঠানো হল।

আলীম চৌধুরী ভাবছিলেন, এ ফাঁকে একবার অন্য কোন জায়গায় আশ্রয় নেয়া যায় কিনা দেখে আসবেন এবং একবার হাসপাতালটা ঘুরে আসবেন।
তাঁর স্ত্রীর ইচ্ছা ছিলনা তখন তিনি বের হন। আলীম চৌধুরী বেরুবেনই।

ছবিঃ শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলীম চৌধুরী এবং তাঁর পরিবার।

 

স্ত্রীকে বললেন, “আমাকে তো একবার হাসপাতালে যেতেই হবে। ডাক্তার মানুষ, আমি যদি না যাই তো কে যাবে?”

তারপর বললেন, “আমি যতো তাড়াতাড়ি পারি ফিরবো। তুমি তৈরী থেকো। আমি ফিরলে সবাইকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবো।”

আলীম চৌধুরীর স্ত্রী বললেন, “তুমি ঠিক মতো ফিরবে- তাহলেই হয়েছে। তুমিও কার্ফুর সময় পার করে দিয়ে আসবে আর আমাদেরও যাওয়া হবে।”

আলীম চৌধুরী স্ত্রীকে বারবার কথা দিলেন যে কার্ফুর অনেক আগেই তিনি ফিরবেন। তারপর কেরোসিনের একটি টিন নিয়ে গাড়ীতে গিয়ে উঠলেন। বাসায় তখন কেরোসিনের অভাব।
গাড়ী করে হাসপাতালে গেলেন ডা. চৌধুরী। হাসপাতালে তাঁর সহকর্মীরা তো তাঁকে দেখে অবাক। এই দুর্যোগ আর উনি কিনা এসেছেন হাসপাতালে।

তারা বললেন, “ডাক্তার সাহেব, আপনি যখন এসেই পড়েছেন তখন আর বাড়ী ফিরতে পারবেন না। এখানেই থেকে যান।”

ডাক্তার আলীম বললেন, “না, না, বাসায় সবাইকে রেখে এসেছি। বাড়ী ফিরে ওদেরকে নিয়ে আবার বেরুতে হবে।”

এরপর ডা. চৌধুরী গেলেন মিটফোর্ড হাসপাতালের প্রিন্সিপাল ডাক্তার লতিফের সাথে দেখা করতে। উদ্দেশ্য তিনি যদি একটা সাময়িক আশ্রয়ের বন্দোবস্ত করে দেন, কারণ তখন অনেক ডাক্তার সপরিবারে হাসপাতালের কেবিনগুলোতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তখন ডা. চৌধুরীও সেরকম একটা আশ্রয় চাচ্ছিলেন। কিন্তু ডা. লতিফ আলীম চৌধুরীকে সেরকম কোনো আশ্রয় দিতে সম্মত হলেন না।

অতঃপর ডা. চৌধুরী বিমর্ষ মনে হাসপাতাল ছেড়ে বেরুলেন। ভাইপোর বাসায় যাবেন কেরোসিন আনতে। কেরোসিন নিলেন। ভাইপোকে তেলের দাম দিলেন। ভাইপো তো হেসে অস্থির।

ডা. চৌধুরী তখন বললেন, “দেখ, মানুষের মরার কথা তো বলা যায় না। এই এখন আমাকে দেখছিস কিন্তু কিছুক্ষণ পর আমি তো নাও বেঁচে থাকতে পারি।”

ডা. চৌধুরী বাড়ী ফেরার জন্য গাড়ীতে উঠবেন ঠিক এই সময় কার্ফুর সাইরেন বেজে উঠলো। ভাইপো তাঁর হাত ধরে তাঁকে থেকে যেতে অনুরোধ করলেন। কিন্তু তিনি বাসায় যাবেনই।

তাকে বললেন, “আমার গাড়ীতে রেডক্রস চিহ্ন আছে। কিছু ভেবোনা। আমি ঠিক ঠিক বাসায় পৌঁছে যাবো।”

বাসায় ফিরলেন।

স্ত্রী সাথে সাথে ঝংকার দিয়ে বলে উঠলেন, “কি বলেছিলাম, সেই কার্ফু পার করে দিয়েই তো ফিরলে।”

তিনি বললেন, “ঠিক আছে ঠিক আছে। কাল একেবারে সক্কালেই চলে যাবো।”

বেলা দুটো থেকে আবার বোমা বর্ষণ শুরু হলো। দোতলার বারান্দায় বসে সেই বোমা বর্ষণ দেখছিলেন ডা. চৌধুরী। বিকাল সাড়ে চার। একটা মাইক্রোবাস এসে থামলো বাসার নীচে। কয়েকজন আলবদর নামলো। ডাক্তার চৌধুরীর স্ত্রী একটু উঁকি দিয়ে দিয়ে তাদের দেখছিলেন। তখন তিনি বললেন, “অতো উঁকিঝুঁকি দিয়ো না। বোধহয় আর্মি এসেছে।” বলে তিনি বাথরুমে গেলেন। ব্যাপারটার তেমন গুরুত্ব দেননি স্বামী-স্ত্রী। কারণ মওলানা মান্নানের বাসায় হরদম এ ধরনের লোকজন আসা-যাওয়া করতো। বাথরুম থেকে তিনি বেরিয়েছেন, এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠলো। ডা. চৌধুরী হঠাৎ বিমূঢ় হয়ে গেলেন। কি করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না।

এলোমেলোভাবে বললেন, “ও, এসেছে, তা দরজা খুলে দাও।
একথা বলেই তিনি নীচে নামার উদ্যোগ নিলেন।”

ডা. চৌধুরীর মা তখন বলে উঠলেন, “আরে কোথায় যাচ্ছ?”
তিনি বললেন, “নীচে, মওলানার কাছে, কারণ মওলানা বলেছিল, এ ধরণের কোন ব্যাপার ঘটলে যেন তাকে খবর দেয়া হয়।”

নীচে নেমে তিনি মওলানার দরজা ধাক্কা দিতে লাগলেন। এমনিতে মওলানার দরজা সব সময় খোলা থাকতো কিন্তু সেদিন দরজা বন্ধ। এদিকে ডা. চৌধুরী দরজা ধাক্কাচ্ছেন, চিৎকার করে মওলানাকে দরজা খুলতে বলছেন। কিন্তু মওলানার কোন সাড়াশব্দ নেই।

খানিক পর মওলানা ভিতর থেকে বললেন, “ভয় পাবেন না। আপনি যান। আমি আছি।”

তিনি ফের উপরে ওঠার জন্য পা বাড়ালেন।

ছবিঃ শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলীম চৌধুরীর প্রদর্শিত পোশাক এবং ছবি।

এমন সময় আলবদরের আদেশ “হ্যান্ডস আপ, আমাদের সাথে এবার চলুন।”
“কি ব্যাপার কোথায় যাবো?” প্রশ্ন করলেন ডা. চৌধুরী।
“আমাদের সাথে চলুন।”
“প্যান্টটা পরে আসি।”
“কোন দরকার নেই।”
আলবদররা তাঁকে ঘিরে ধরলো। আস্তে আস্তে তিনি মাইক্রোবাসের দিকে অগ্রসর হলেন।

Reference:
-১৯৭৩ সালের জাতীয় দিবসে সাপ্তাহিক বিচিত্রার বিশেষ সংখ্যা
Photo: From Liberation War Museum

Sadia Kabir

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি উৎসর্গকৃত চিকিৎসাপদ্ধতি

Tue Dec 15 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২০, মঙ্গলবার  অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল) চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্যসচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ   আজ ১৪ তারিখ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। একাত্তরের এ দিনটিতে পাকিস্তানিদের এদেশীয় দোসররা ঘর থেকে তুলে নিয়ে রায়েরবাজারের বধ্যভূমিতে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল আমার প্রয়াত শ্বশুর ডা. […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo