নভেম্বর মাস, প্রফের মাস

১ নভেম্বর ২০১৯:

নভেম্বর মাস প্রফের মাস। আজ থেকেই শুরু হল নভেম্বর৷ সব পেশাগত পরীক্ষার্থীদের জন্যে অন্তস্থল থেকে শুভকামনা।

প্রফ মানে একটা চরমমাত্রার বিভীষিকা। প্রফের ২-৩ মাস জীবনের ওপর দিয়ে কী ঝড়ো বাতাস বইতে থাকে, তা কেবল ভুক্তভোগী ছাড়া কেউই বোঝে না, কেউই না। এমনকি নিজের মা-বাবাও না। প্রফ আসলে স্ট্রেসের পরীক্ষা। কে কতোটা স্ট্রেস নিতে পেরে নার্ভ ধরে রাখতে পারে তারই পরীক্ষা হয় মূলত। পড়াশোনা তো সবাই করে কম-বেশি; কিন্তু পরীক্ষার হলে গিয়ে নিজের মেডিকেলের আর বাইরের মেডিকেলের বাঘা-বাঘা টিচারদের দিয়ে গঠিত এতোগুলো বোর্ডে ঠাণ্ডা মাথায় উত্তর করতে আসলে সবাই পারে না। পাশ-ফেইলটা এখানেই হয়। তবে সারা বছরের পার্ফরম্যান্সেরও একটা ব্যাপার থাকে। আমাদের এনাটমির ম্যাডাম বলতেন, “দেখো, কতো সময়ই তো আমরা পোলাও রান্না করি, ভালোও হয়। কিন্তু দেখা গেলো যেদিন মেহমান বাসায় এলো সেদিনই পোলাওটা খারাপ হলো। তার মানে কি আমি পোলাও খারাপ রাঁধি? ঠিক তেমনই তোমাদের মধ্যে অনেকে সারা বছর অনেক ভালো করো, কিন্তু প্রফের টেবিলে ঠিক মতো মুখ খুলতে পারো না, থট ব্লক হয়ে যায়, তাদের ব্যাপারটা আমরা দেখব।” তাই যারা সারা বছর ভালো পড়াশোনা করেছো তারা আত্নবিশ্বাস রাখো।

কী একটা গান আছে না, ঘর-বাড়ির ঠিকানা নাই, দিনরাত্রি জানা নাই, চলার সীমানা সঠিক নাই, জানি শুধু লড়তে হবে, এ তরী বাইতে হবে… প্রফের মধ্যে আসলে অবস্থাটা এরকমই হয়ে যায়। কখন খাওয়া, কখন গোসল, কখন ঘুম কোনোকিছুর ঠিক নেই। একেকজন যেন বদ্ধ উন্মাদ। স্লিপ ডিজঅর্ডারে ভোগেনি প্রফের সময় এমন স্টুডেন্টের সংখ্যা কম। কারও একেবারে ঘুমই হয় না আবার কারও কারও প্রচুর ঘুম বেড়ে যায়। ফাইনাল প্রফের সময় অতিমাত্রায় স্ট্রেস আর পরিশ্রমের কারণে আমার প্রচুর ঘুম পেয়ে যেতো। আমি বন্ধুদেরকে বলতাম, আমি যে পরিমাণ তেতো/কড়া কফি খাই, যে কফি আবিষ্কার করেছে সেও মনে হয় কখনও খায়নি এমনটা। দিনে-রাতে মিলিয়ে কতো কাপ যে খেতাম তার ইয়ত্তা নেই। এর উপরেই আমি চলেছি ৩ মাস। মাঝেমাঝে এতো ক্লান্ত লাগতো, মনে হতো যদি ইন্ট্রাভেনাস (শিরায়) ক্যাফেইন নেয়া যেতো! আর প্রচুর ওষুধ খেতে হতো আমার। দেখা যেতো জ্বর-ঠাণ্ডা কিছু না কিছু একটা লেগেই থাকতো। এছাড়া ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশান, হাইপারথাইরয়েডিজম, হাইপোথাইরয়েডিজম, এংজাইটি ডিজঅর্ডার, ডিপ্রেশান–মনে হতো সব রোগই আছে আমার! পরীক্ষার আগের দিন আর পরীক্ষার দিন ইণ্ডিভার (প্রোপ্রানলল) খেয়েটেয়ে হার্ট রেইট কমিয়ে রাখতে হতো।

টিচাররা একটা কথা বলেন যে, প্রফ পাশ করার চাইতে প্রফের প্রিপারেশান নেয়াটাই বেশি কঠিন। কথাটা আসলেই সত্যি। পরীক্ষা দেওয়ার পর মনে হতো এতো পরিশ্রম এতো স্ট্রেস না নিলেও তো পারতাম, এতোকিছু না পড়লেও তো হতো, সব তো ধরে না। যদি মোটামুটি মানের প্রিপারেশানও নিয়ে যাওয়া যায়, কমন কমন টপিকগুলো ভালো করে পড়ে যাওয়া যায়, বেসিক/গ্রস কোনো ভুল না করা যায় তাহলে পাশ করা তেমন কঠিন কিছু হবে না। আর রিটেনে অধিকাংশেরই পাশ হয়ে যায়, ভাইভাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাশ-ফেইলের আসল ব্যাপারটা এখানেই। কারণ প্রতি পরীক্ষায় ৪/৬ জন টিচারের কাছে দফায়-দফায় পরীক্ষা দেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। তবে তুমি যদি বোঝাতে পারো যে পড়াশোনা করে এসেছো তাহলে আর ভয়ের কিছু নেই।

বাইরের মেডিকেলের অচেনা টিচারদের সামনে পরীক্ষা। টেনশান অনেক বেশি থাকে এটাই স্বাভাবিক। তবে ঠাণ্ডা মাথায় চোখ-কান খোলা রেখে শুধু পরীক্ষা দিয়ো – এটাই আমার সাজেশান। যদিও স্ট্রেস না নিয়ে থাকা কঠিন, তবুও বলব যতোটা স্ট্রেস ফ্রি থাকা যায় সেই চেষ্টা কোরো। অনেকেই এ সময় সিগারেট খাওয়ার পরিমাণ অনেক অনেক বাড়িয়ে দেয় টেনশানে, এটা কেউ কোরো না প্লিজ। অনেকে ইয়াবা, গাঁজা, ফেন্সিডিল খাওয়া শুরু করে, প্লিজ এগুলো কোরো না কেউ। হয়তো পাশ করে যাবে ডাক্তার হিসেবে কিন্তু মানুষ হিসেবে পাশ মার্ক পাবে না। অনেকে অতিরিক্ত ভয়ে-আতঙ্কে হোস্টেল থেকে পালিয়ে যায়, পরীক্ষার হলে যায় না। এটা জীবনের অন্যতম ভুল সিদ্ধান্ত। বুকে সাহস নিয়ে ফেইস করো পরীক্ষা। যা হবার হবে। সর্বোচ্চ কী করবে? ফেইলই না হয় করাবে। ফাঁসি তো দেবে না? জেলে তো ঢোকাবে না? পরীক্ষায় যদি অংশগ্রহণ করো তাহলে হয় পাশ হবে নাহয় ফেইল। ফিফটি ফিফটি সম্ভাবনা। আর যদি না-ই দাও পরীক্ষা ভয়ে তাহলে তো ফেইলই হয়ে গেলো, পাশ করার আর কোনো সম্ভাবনাই থাকলো না। আর বেশি রাত জেগো না। এরচেয়ে ভালো হয় সকালে উঠে পড়াশোনা করলে। অন্তত ৫/৬ ঘণ্টা ঘুমাতে চেষ্টা কোরো। নইলে পরীক্ষার দিন সকালে অনেকটা এলোমেলো লাগে, নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। আর ভালো করে সাহারি করে যেয়ো। মেডিকেলের টিচাররা তো জানোই এটিচিউড, ড্রেস-আপ এসবের দিকে অনেক গুরুত্ব দেয়। নতুন এপ্রোনটা পরে যেয়ো, শ্যু পরে যেয়ো।

আর এটা স্বাভাবিক যে অনেকেরই পড়াশোনা করতে ইচ্ছে করে না, হাল ছেড়ে দিতে ইচ্ছে হয় বিশাল সমুদ্রে হাবুডুবু খেতে খেতে। তুমি শুধু তোমার মা-বাবার মুখটা মনে কোরো, তারা কী অধীর উৎসাহে তোমার ডাক্তার হবার অপেক্ষায় আছেন। কল্পনা করো তুমি তোমার মা-কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলছো, মা আমি ডাক্তার হয়ে গেছি! আর ডাক্তার হবার এটা তো অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা ধাপ!

অল দ্যা বেস্ট উইশেস, ফিউচার ডক্টর!

ডা. মারুফ রায়হান খান

Platform

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

প্ল্যাটফর্মের উদ্যোগে পোশাকশ্রমিকদের মাঝে ব্রেস্ট ক্যান্সার সচেতনতা প্রোগ্রাম

Fri Nov 1 , 2019
১ নভেম্বর ২০১৯: প্ল্যাটফর্ম মেডিকেল কলেজ ফর উইমেন ইউনিটের উদ্যোগে গতকাল ৩১ অক্টোবর ২০১৯ বৃহস্পতিবার গাজীপুরে পোশাকশ্রমিকদের মাঝে পালিত হল ব্রেস্ট ক্যান্সার সচেতনতা প্রোগ্রাম। অক্টোবর হল ব্রেস্ট ক্যান্সার সচেতনতা মাস। একে PINK OCTOBERও বলা হয়। এ মাসে ব্রেস্ট ক্যান্সার সম্পর্কে সচেতনতা, শিক্ষা এবং গবেষণার গুরুত্ব তুলে ধরার লক্ষ্যে হাজার হাজার […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo