স্মৃতিতে অধ্যাপক ডা. এন আই খান: ডা. আবদুন নূর তুষার

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৬ জুন ২০২০, শনিবার
ডা. আবদুন নূর তুষার

আমার শিক্ষক এন আই খান। নিঃসঙ্গ মৃত্যু বেছে নিয়েছেন ঢাকা মেডিকেলের কেবিনে গতকাল, পাশে ছিল তাঁরই কয়েকজন ছাত্র। শেষ মূহুর্তে তিনি নাকি খুঁজেছেন তাঁর সার্বক্ষনিক সাহায্যকারী শ্যামলকে। আর বলেছেন, তোরা আমাকে মাফ করে দিস।
স্যার অসাধারন এক শিক্ষক ও চিকিৎসক ছিলেন। আমার সাথে তাঁর ছিল বন্ধুত্বের সম্পর্ক। ডাক দিতেন সওদাগর বলে।

ডাক্তারের পোষাক, চুল, জুতো, ব্যাগ সব নিয়ে তিনি ছিলেন কড়া এক আদর্শবাদী। লম্বাচুল পছন্দ না, শার্ট ইন করতে হবে, টিশার্ট চলবে না, জুতো পরতে হবে, কেডস চলবে না, ব্যাকপ্যাক চলবে না, হাতল ওয়ালা ব্যাগ হতে হবে। এর কারন হলো ডাক্তার অত্যন্ত সম্মানিত ও পরিপাটি মানুষ হতে হবে। সবচেয়ে গুডলুকিং ও স্মার্ট লোকটি হবে ডাক্তার।

অদ্ভুত সুরে কথা বলতেন। ইংরেজী বাংলা দুটোই। প্রিয় ছাত্র ছাত্রীকে লেকচার ক্লাসে পড়া ধরতেন। নাম ধরে ডাকতেন না, ডাকতেন জন, ম্যারি, পল এরকম অদ্ভুত নামে। এটা নাকি তাকে র‌য়্যাল কলেজের অনুভুতি দেয়। কারণ ছাড়াই মাঝে মাঝে ছাত্রছাত্রীদের নার্ভ পরীক্ষা করতেন।

আমার সাথে প্রথম পরিচয় আমি যখন সেকেন্ড ইয়ারে। কলেজের “বসা নিষেধ” লেখা ছোট্ট স্মৃতিসৌধের সামনে।

বললেন আমারে চিনো?

আমি চিনি না। কি করে চিনবো? সেকেন্ড ইয়ার মানে তো ফার্ষ্ট প্রফের চিন্তা। প্রফেসর খালি দুজন, অ্যানাটমি আর ফিজিওলজি। বলেছি চিনি না।

পাশে দিয়ে যাওয়া এক সিনিয়রকে পাকড়াও করে বললেন, এই মাওলানা ওরে চিনাও আমি কে?
তিনি ভয়ে ভয়ে বললেন উনি এন আই খান স্যার।
বলেই দৌড়।
এন আই খান স্যার আমাকে বলেন, কোন ইয়ারে?সেকেন্ড ইয়ার স্যার।

আমার নাম প্রফেসর এন আই খান, আমি তোরে থার্ড ইয়ারে পামু। পাইলে আম চিপা দিয়া সব রস বাইর কইরা দিমু। আমারে তুমি চিনো না মাওলানা আমি তো বুঝতেই পারি না, উনি এরকম করছেন কেন।

থার্ড ইয়ারে আম চিপা দেন তো নাই, বরং অনেক স্নেহ করেছেন। নিজ হাতে ধরে শিখিয়েছেন বহু কিছু। তার প্রিয় একটা দেখার বিষয় ছিল পারকাশন। নিজে অদ্ভুত ভাবে করতেন। কিন্তু ছাত্র ছাত্রীরা একদম ক্লিনিকাল মেথডের বই অনুযায়ী করে দেখাতে হবে। শব্দ তার কানে পৌঁছাতে হবে।
আমি বলেই বসলাম। স্যার আপনি তো এভাবে করেন না। উনি বললেন সওদাগর, আগে এন আই খানের মতো প্রফেসর হইয়া ল, তারপরে পা দিয়া পারকাশন করিস। আই এম নট জাস্ট এ প্রফেসর, আই অ্যাম THE এন আই খান।

একেকজনকে একেক রকম নাম দিতেন। সহকর্মীদের নিয়ে মজা করতেন। রেগে গেলে বলতেন, তুই জিনজাহানের ওয়ার্ডে যা। জিনজাহান হলো ফেরদৌস আরা জে জাহান। তিনি কিছুতেই তাকে সঠিক নামে ডাকবেন না। তার ধারণা  সেখানে পড়াশোনা হয় না। জীবনে অগোছালো, এই পাগলা লোকটা একটা জায়গায় ছিলেন নির্ভুল ও গোছানো। চিকিৎসা আর রোগীর বিষয়ে তিনি নির্ভুল ছিলেন। রোগীর মুখ দেখে, হাটা দেখে তিনি রোগ বুঝতেন। হাই স্টেপিং গেইট কি জিনিস সেটা তিনি আমাকে দেখিয়েছিলেন। স্টুপিং গেইট, অ্যালকোহলিক অ্যাটাক্সিয়া, অ্যালকোহলিক গেইট সব পড়িয়েছিলেন। বলেছিলেন, সওদাগর দেবদাসরে চন্দ্রমুখী ছাইড়া দিসিল এমনে হাটে বইলা। বলে তিনি মুচকি মুচকি হাসতেন। উত্তর না দেওয়া হলো বুদ্ধিমানের কাজ। দিলেই হয়তো বলবেন ওহ! পড়া না পইড়া দেবদাস পড়স। এইবার বল দেবদাসের গলা দিয়া রক্ত পড়সে ক্যান?
তারপর আমি যখন ইমপ্রেসে শুভেচ্ছা বানাতাম, তার চেম্বার ছিল সিদ্ধেশ্বরীতে একই বিল্ডিং এর দোতলায়। মাঝে মাঝে খবর পাঠাতেন। সওদাগরকে ডেকে আন। চা খাওয়াতেন আমাকে, নানা রকম কথা বলতেন।

একদিন কথায় কথায় বললেন, ভালো শিক্ষক তার চেয়েও ভালো ছাত্র বানায়। কারণ মরতে হবে তো ছাত্রের হাতের ওপরে।

তিনি বিশ্বাস করতেন শুধু দেশের না, পৃথিবীতে সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা হয়, এমন একটা জায়গা হলো তার ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও তার নিজের ওয়ার্ড হলো তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ। স্যার ঢাকা মেডিকেলেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।

তিনি তার সবচেয়ে গর্বের ও পছন্দের জায়গাটিকেই বেছে নিয়েছিলেন শেষ দিনটিতেও। কিন্তু স্যারের শেষ কথাটা বড় নির্মম। স্যার, আপনি নাকি বলেছেন, তোরা আমাকে মাফ করে দিস। স্যার আপনার সব ছাত্রদের আপনি মাফ করে দিয়েন। এই ভংগুর স্বাস্থ্য ব্যবস্থায়, এই নীতিহীনতায় আমরা সব মেরুদন্ড বাঁকা করে টিকে আছি। আমরা ন্যুব্জ, কাতর, অসহায়। এই দেশে করোনার এই দিনে ডাক্তারদের জন্য একটা আলাদা হাসপাতাল তো দূরের কথা, একটা ভালো বেড, একটু অক্সিজেনের জন্যও এখানে সেখানে তদবির করতে হয়।

আপনি যখন চলে যাচ্ছেন, সেদিনই কিবরিয়া স্যারও চলে গেছেন। শুনেছি তিনি বারবার বলেছিলেন, একটু সিএমএইচ এ নিয়ে হাই ফ্লো ক্যানুলা দিয়ে অক্সিজেনের ব্যবস্থা করতে। ডাক্তাররা সেটা পারে নাই। তিনি অসহায়ের মতো বলেছেন এত অবদান রেখে কি হলো? সিএম এইচে একটা বেড, একটু ব্যবস্থা হলো না? আমরা পারি নাই। আপনি আজকে প্রফেসর থাকলে এরকম হতো বলে মনে হয় না। আমি নিশ্চিত আপনি হুংকার দিয়ে কর্তৃপক্ষকে বলতেন প্রফেসর কিবরিয়ার জন্য। আপনি আমাদের মাফ করে দিয়েন। আপনার মতো আপনার কোন ছাত্র হতে পারে নাই।

আপনার মতো করে আমরা বলতে পারি না, আই অ্যাম THE প্রফেসর (এন আই খান)।

আল্লাহ আপনাকে বেহেশতেই নেবেন বলে বিশ্বাস করি। আপনি লক্ষ রোগীকে সুস্থ করেছেন। তাদের দোয়া কবুল হবেই।
হে আল্লাহ! শিক্ষক পিতামাতার মতোই ভালোবাসার ও শ্রদ্ধার। “রাব্বিরহামহুমা কামা রাব্বাইয়ানি সাগিরা” আমার শিক্ষকদের আপনি বেহেশতবাসী করে দিন।

আর দি প্রফেসর এন আই খান, আপনি ও কিবরিয়া স্যার আমাদের সকলকে ক্ষমা করে দিয়েন।

Silvia Mim

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

কোভিড-১৯: আরো ৩৫ জনের মৃত্যু, নতুন শনাক্ত ২৬৩৫ জন

Sat Jun 6 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, শনিবার, ৬ জুন, ২০২০ গত ২৪ ঘন্টায় বাংলাদেশে কোভিড-১৯ এ নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন ২৬৩৫ জন, মৃত্যুবরণ করেছেন আরো ৩৫ জন ও আরোগ্য লাভ করেছেন ৫২১ জন। এ নিয়ে দেশে মোট শনাক্ত রোগী ৬৩,০২৬ জন, মোট মৃতের সংখ্যা ৮৪৬ জন এবং সুস্থ হয়েছেন মোট ১৩,৩২৫ জন। দুপুর ০২.৩০ […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo