সরকারি চাকরি কেন করবো?

লেখকঃ ডাঃ ইমু ইমরান কায়েস

সরকারি চাকরি কেন করবো?
এই প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতেই চাকরির প্রথম দুই মাস কেটে গেছে। সার্জারিতে পোস্ট গ্রাজুয়েশন করছি, সরকারি জায়গায় গরিব রুগির অভাব নেই, বলে হাসতাম ।
অনেকেই সন্দেহের চোখে তাকাত।
গরিব মানুষ বলে যা তা করবেন! তার পেটে ছুরি মেরে অপারেশন শিখতে হবে!
জটিল পরিস্থিতি।
যারা ডাক্তার তারা জানে ঘটনা ঠিক এরকম না।
হুট করে তো আর অপারেশন শুরু করে দেয়া যায় না! দেখতে হয়, এসিস্ট করতে হয়, তার পর ধীরে সুস্থে। যেটা অন্যকোথাও অনারারি ট্রেনিং করলে( বিনা পয়শায় কাজ করা) , বা কাজ করলে সুযোগটা কম পাওয়া যায়। কারন রুগি এবং অপারেশন দুটাই কম হয়, হলেও নানা রকম রুগি পাওয়াও যায় না।
আমরা যারা জয়েন করেছিলাম, তাদের একেক জনের একেক যুক্তি ছিলো, একেক চিন্তা ছিলো। সবার এখন দেড় বছর হয়ে গেছে। ভালো ভালো মেডিকেলে ট্রেনিং পোস্ট এ আসার জন্য এক ধরনের অস্থিরতাও তৈরি হয়ে যাচ্ছে। নেতা ধরা, দল লীগ এর পরিচয় শঙ্কট ও স্পস্ট হচ্ছে।
তবে একটা ব্যাপারে আমাদের সবারই খুব মিল।
দুই একজন অতি বুদ্ধিমান আর প্র্যাগমেটিক ছেলে মেয়ে ছাড়া একটা ব্যাপারে প্রায় সবাই একটা বড়সড় ধাক্কার মত খেয়েছি।
সেটা হচ্ছে দুর্নীতি
এত জটিল শব্দ না বলে সরল বাংলায় বলি চুরি।
পোস্টিং, ফরওয়ার্ডিং, সাইন, অর্ডার প্রায় সব ক্ষেত্রে।
সবাই টাকা খাচ্ছে!
ডিজি অফিস থেকে শুরু করে, ডিভিসনাল অফিস, সিভিল সার্জন অফিস, উপজেলা, ট্রেনিং সব জায়গায় হরির লুটের দশা! কেউ দেখার নেই। কারো কিচ্ছু করার নেই।
আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা আসলে কেমন?
জাপানি এক সিস্টার আমাদের সদর হস্পিটালে জাইকার কি এক প্রোগ্রামে কিছুদিনের জন্য এসেছে। এটা তার প্রশ্ন। আমি এলোমেলো উত্তর দিয়ে তাকে সন্তুষ্ট করার প্রাণপণ করেছি।
আমি নিজে কি মনে করি আসলে?
আমি মনে করি ভিশন অনুন্নত, দুর্নীতিগ্রস্ত, প্রয়োজনীয় মানুষের অভাবে, অপ্রোয়োজনীয় মানুষের পদচারনায় মুখরিত একটা বেরাছেড়া ব্যবস্থা।
আমাদের হেলথ এসিস্ট্যান্টরা অনবরত প্রেস্ক্রিপশন লিখছে ।
ভাইরাল ফিভারে এন্টিবায়োটিক লিখে এন্টিবায়োটিক এর বারটা বাজানো শেষ। খুব বেশি দিন নাই। বাংলাদেশে আর একটা এন্টি বায়োটিকও কাজ করবে না ।
হেলথ ইন্সপেক্টর বলে একটা পদ আছে।
মাঠলেভেলে কাজ করার কথা, প্রায় কেউই করেননা। যেকোন জরিপ আসলেই বানিয়ে বানিয়ে লিখে দেন। মাস শেষে ঠিক বেতন নিয়ে বাড়ি ফিরেন।
ফ্যামিলি প্ল্যানিং এ মাঠপর্যায়ে কাজ করার কথা যাদের তাদের খুঁজেই পাওয়া যায় না।
কাগজে কলমে হাতি ঘোড়া মেরে বসে আছেন।
উপজেলা, জেলা লেভেলে কোন ডায়োগনস্টিক সেন্টার ঠিক নেই। প্যাথলজি বলে কিছু নেই। কোন ইনভেস্টিগেসন করার সুযোগ নেই।
ক্লিনিক গুলো বড়সড় ডাকাত দলের আধুনিক সংস্করন। দুই নাম্বারি, জোচ্চরি, গরিব মানুশের শেষ সম্বল বেঁচে আনা টাকায় মিথ্যা ইনভেস্টিগেসন এর ফর্দ।
হাস্পাতালের জানালা নেই, দরজা নেই, বাথরুম ভাঙা, নোংরা আবর্জনায় ভরা।
তাহলে স্বাস্থ্য ক্ষাতের সাফল্যের রহস্যটা কি!
কোন রহস্য নেই।
কমবয়সি কিছু ডাক্তার দের নগন্য বেতনের বিনিময়ে হাড় ভাঙা খাটুনি আছে।
দাঁত মুখ গুজে গ্রামে গঞ্জে পরে থাকা এই ছেলে মেয়েগুলোর অক্লান্ত পরিশ্রম আছে। নেতা পাতি নেতা জঘন্য দুর্গন্ধযুক্ত দল লীগের জঞ্জালদের অসহ্য দুর্ব্যবহার সহ্য করে ইমার্জেন্সি তে দিন রাত পরে থাকা আছে। মাঝে সাঝে চড় থাপ্পড় আছে। উপজেলা লেভেলের অন্যান্য ক্যাডারদের (বিসিএস পাশ) হামবড়া ভাব উপেক্ষা করে ঘাড় নিচু করে রাখা আছে। এবং তাদের বিন্দুমাত্র নিরাপত্তার কথা দিনের পর দিন উপেক্ষা করে বড় বড় মিটিং, সিম্পোজিয়াম শেষে গরম চা আর টাকার খাম আছে।
সিম্পল।
তেত্রিশ তম বিসিএস এর প্রায় সাড়ে ছ হাজার নতুন ডাক্তার গ্রামে গঞ্জে, উপজেলায়, সাবসেন্টারে ছড়িয়ে পরবে। এটা দেশের যে কত বড় আনন্দের একটা সংবাদ তা কেউ জানে না।এই গরিব দেশটা নিরবে কত বড় একটা ঘটনা যে ঘটিয়ে দিয়েছে তা বোঝার মত লোক এ দেশে খুব বেশি নেই।
তবে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রের অফিস গুলা জানে।
তাদের ঘরে ঘরে আজ ঈদের আনন্দ।
সারে ছয় হাজার নতুন চকমকে মুরগি তারা পাচ্ছে।
সারে ছয় হাজার খাম এখন নিয়মত তাদের ফুলে ফেপে সুটকেস হয়ে উঠা পকেটে তশরিফ নেবে।
সবাই জানবে, সবাই দেখবে, কেউ কিচ্ছু বলবেনা।
শুধু দেশ টাই দিনে দিনে মলিন হয়ে যাবে।

ডক্টরস ডেস্ক

6 thoughts on “সরকারি চাকরি কেন করবো?

  1. আপনার লেখা পড়ে খুব ভাল লাগল। আমি সরকারি চাকরি করি না, ঘুষ দেওয়া সম্পর্কে বিস্তারিত ধারনা কম। শুধু স্বাস্থ্য অধিদপ্তর না, শতকরা %১০০ সরকারি অধিদপ্তরের একই দশা হওয়ার কথা। আপনার কাছ থেকে যে ঘুষ নেয়, সে ভাল অংকের টাকা দিয়ে সেখানে পোস্টিং নিয়েছে। সামান্য কেরানি পদের চাকরির জন্য (যদি ভবিষ্যতে ঘুষের সম্ভবনা থাকে) লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে ঘুষ দিয়ে সে হয়ত চাকরিতে ঢুকেছে। সে তার এইসব পুরাতন ইনভেস্টমেন্ট এর রিটার্ন চাইবে এটাই স্বাভাবিক।

    শুধু রাজনীতিবিদদের দোষ দিয়ে কি লাভ, আমরা জাতিগত ভাবে দিনদিন আদর্শহীন, নৈতিকতাহীন, বিবেকহীন, মেরুদণ্ডহীন হয়ে যাচ্ছি। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের আদৌ কোন উপায় আছে বলে কি মনে হয়?

    1. ঘটনা আসলেই পারস্পরিক সম্পর্কিত অতি জটিল সমিকরনে বাঁধা।তবু একটা জায়গা থেকে সমাধান শুরু করতে হয় কিন্তু আমরা করছি না।
      যত দেরি হবে তত কঠিন হবে সমাধান।

      জাতিগত ভাবে আমাদের অধপতন আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত। প্রাইমারি স্কুলের স্যার দের যদি তৃতিয় শ্রেণীর পদমর্যাদা দিয়ে ভালো ছেলে মেয়ে আসার রাস্তা বন্ধ করে রাখি তবে কি করে হবে!

  2. আপনার কথা গুলো একবারে সত্য, আমি নিজেই এর প্রমান, আমি ফ্যামিলি প্লানিং এ চাকুরি করি

    1. আমাদের ডিপ্রাটমেন এ এমন কর্মচারী আছে যারা এই এস সি পাশ করে কয়েক মাস ট্রেনিং করে ডাক্তার এনারাই রোগী দেখে, অথচ এনাদের মেডিসিন বা মেডিসিনের ডোজ সম্পর্কে তেমন কনো ধারনাই নেই।

  3. ডাঃ ইমরান আপনার পুরো বক্তব্যের সাথে একমত হতে পারছি না। আপনি যেভাবে পুরো স্বাস্থ্য বিভাগকে দোষারোপ করেছেন তাতে মনে হচ্ছে আপনারা ৩৩তম বিসিএস কর্মকর্তাগণই শুধুমাত্র হাসপাতাল গুলোতে কাজ করছেন, বাকীরা শুধু ঘুষের ধান্দা করছে। অন্যদিকে আমাদের অভিজ্ঞতা ভিন্ন। জুনিয়র চিকিৎসক ও কনসাল্টেন্টদের অধিকাংশই নিয়মিত হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করেন না। অন্য ক্যাডারদের সঙ্গে তূলনায় আপনারা পিছিয়ে থাকেন কারণ আপনারা ইন্ট্রোভার্টেড। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে আপনারা নিজেদেরকে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হন। আমি বুঝি না যারা দেশের সেরা মানুষ তারা নিজেদের প্রকাশ করতে কেন ব্যর্থ হন। সবচেয়ে বড় যে ব্যাপার সেটা হল, আপনারা আপনাদের বিভাগের অফিস সহকারী বা প্রধান সহকারীদেরভাই ডাকেন যা অন্য ক্যাডারের কোন কর্মকর্তা করেন না।আপনি তাকে ভাই ডাকেন আর তারা সেটাকে দুর্বলতা ভাবে। সুতরাং সবদিক বিবেচনা করে কাজ করুন সবকিছু ঠিকভাবে চলবে। স্বাস্থ্য বিভাগের অনেক সাকসেস আছে।স্বাস্থ্য পরিদর্শকরা মাঠে না গেলে সেটা আমাদের কর্মকর্তাদের ব্যর্থতা।তবে এটাও ঠিক মাঠ পর্যায়ের কাজের জন্যই আমাদের অনেক রোগ কমেছে।স্বাসথ্য বিভাগে শুধু ঘুষখোর নেই, বেশ অনেক ভাল কর্মকর্তা ও কর্মচারী আছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

দেশের চিকিৎসাসেবায় বৃহত্তম বিপ্লবের সূচনা

Fri Aug 8 , 2014
গতকাল ৭ই আগস্ট, বৃহস্পতিবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সংখ্যক ডাক্তার (৬১৯১ জন) একসাথে স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ে যোগদান করেন। ৩৩তম বিসিএস এ নিয়োগ প্রাপ্ত এই সকল ডাক্তারকে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে দেশের ৬৪ জেলার প্রতিটি উপজেলায় শূন্যপদে পদায়ন করার ঘোষনা দেয়া হয়। এত বিপুল সংখ্যক মেধাবী ডাক্তার উপজেলা পর্যায়ে […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo