মেরুদন্ডের সুস্থতায় করণীয়

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ১৭ অক্টোবর ২০২০, শনিবার

ডা. মোঃ আহাদ হোসেন
কনসালটেন্ট ও পেইন ফিজিশিয়ান
কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা।
কনসালটেন্ট ও পেইন ফিজিশিয়ান
বাংলাদেশ সেন্টার ফর রিহ্যাবিলিটেশন, কাটাবন, ঢাকা।

মেরুদন্ড আমাদের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। পুরো শরীরের নিয়ন্ত্রণ এই মেরুদন্ডের সুস্থতার উপরে নির্ভর করে। মেরুদন্ড আমাদের পুরো শরীরের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করে। মেরুদন্ডের কোন অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে আমাদের পুরো শরীর ব্যথাগ্রস্থ হয় এবং স্বাভাবিক নড়াচড়া এবং চলাফেরা কষ্টদায়ক হয়। মেরুদন্ড সমস্যাগ্রস্ত হলে যে বিষয়টি প্রথমেই পরিলক্ষিত হয় সেটি হচ্ছে ব্যাক পেইন বা পিঠে ব্যথা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে অনির্দিষ্ট ব্যাক পেইন শিল্পোন্নত দেশগুলোতে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ ভাগ লোকের হয়ে থাকে। এই ব্যাকপেইনের অন্যতম প্রধান কারণ মেরুদন্ডের সমস্যা। আবার এই মেরুদন্ডের মধ্যে দিয়েই আমাদের শরীরকে নিয়ন্ত্রণকারী স্নায়ু সারা শরীরে বিস্তৃত থাকে।মেরুদণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হলে এই স্নায়ুর উপরেও চাপ পড়ে যার কারণে আমাদের ব্যাথা সহ অন্যান্য অনেক সমস্যা হতে পারে। তাই মেরুদন্ডের যত্ন নেয়া এবং যে সকল কাজ করলে মেরুদণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেগুলো থেকে বেঁচে থাকা আমাদের জন্য অত্যন্ত দরকারি। মেরুদন্ডের গঠন এবং কি কি কাজ করলে মেরুদন্ড ভালো থাকে এবং রোগ মুক্ত রাখা যায় সেই বিষয়গুলো সম্পর্কে আজকের আলোচনা-

মেরুদন্ডের গঠনঃ

মেরুদন্ড মূলত বিভিন্ন ধরনের কশেরুকা বা ভার্টিব্রা, মাংসপেশি, লিগামেন্ট এবং কশেরুকার মধ্যবর্তী নরম জেলির মত পদার্থ বা ডিস্ক এর সমন্বয়ে গঠিত। দুটি কশেরুকার মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গা দিয়ে দুই পাশ দিয়ে বের হয় আমাদের শরীরকে নিয়ন্ত্রণকারী স্নায়ুসমূহ। এদের কোন একটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে মেরুদন্ড তার ভারসাম্য হারাতে পারে। আবার কশেরুকা, মাংসপেশি, লিগামেন্ট, ও ডিস্ক এগুলোর সজীবতা রক্ষা করার জন্য দরকার সঠিক রক্ত চলাচল ব্যবস্থা। কোন কারণে ডিস্ক এর উপরে চাপ পড়লে সেটা পরবর্তীতে আমাদের শরীরকে নিয়ন্ত্রণকারী স্নায়ুর উপরে চাপ প্রয়োগ করতে পারে। সে ক্ষেত্রে তীব্র ব্যথা অনুভূত হতে পারে। যেহেতু কশেরুকা একটি হার সেহেতু এর সঠিক গঠন বজায় রাখার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি এর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এগুলোর অভাবেও কশেরুকা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বা ভঙ্গুর হতে পারে। যা ঘটে থাকে সাধারণত অস্টিওপোরোসিস রোগটিতে। যাদের অস্টিওপোরোসিস থাকে তাদের রক্তে ভিটামিন ডি এবং ক্যালসিয়াম এর পরিমাণ কম থাকে যে কারণে কশেরুকায় সঠিক মাত্রায় ক্যালসিয়াম থাকেনা। এছাড়াও অস্বাভাবিক নড়াচড়া বা মুভমেন্টের কারণে লিগামেন্টস ও মাংসপেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। হঠাৎ করে অত্যাধিক ভার বহন করার কারণেও আমাদের মেরুদন্ড ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

যে সকল কারণে মেরুদন্ড ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেঃ

১. আঘাতজনিত কারণে মেরুদণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
২. মেরুদন্ডে কোনো টিউমার হলে অথবা অন্য জায়গার কোনো টিউমার মেরুদন্ডে আসলে মেরুদণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
৩. ডিজেনারেটিভ ডিস্ক ডিজিজ হলে মেরুদন্ড ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
৪. জন্মগত অথবা অন্য কোনো কারণে মেরুদন্ড অস্বাভাবিক বাঁকা হয়ে গেলে।
৫. মেরুদন্ডের কশেরুকা হাড় একটির ওপর আরেকটি উঠে গেলে মেরুদন্ড মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে।
৬. রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস অথবা অন্য কোন কারণে মেরুদন্ডের স্বাভাবিক বাঁক নষ্ট হয়ে যেতে পারে যেটাকে বলা হয় স্পনডাইলোসিস।
৭. যারা দীর্ঘদিন যাবৎ অতিরিক্ত ভার বহনের কাজ করেন তাদের ক্ষেত্রে মেরুদন্ড ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে।
৮. যারা দীর্ঘদিন যাবত ধূমপান করেন তাদের ক্ষেত্রে মেরুদন্ডের ডিস্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যা পরবর্তীতে তার স্বাভাবিক জায়গা থেকে বের হয়ে এসে আমাদের শরীর নিয়ন্ত্রণকারি স্নায়ু কে চাপ দিয়ে মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে।
৯. যারা অস্টিওপোরোসিস এই সমস্যায় ভুগে থাকেন তাদের ক্ষেত্রে মেরুদন্ড যেকোনো সময় সূক্ষ্ম ভাঙ্গার সম্ভাবনা থাকে।

মেরুদন্ডের স্বাভাবিক গঠন বজায় রাখতে কিছু কৌশলঃ

১) সঠিক ঘুমের পদ্ধতিঃ
আমরা যখন ঘুমিয়ে থাকি তখন আমাদের মেরুদন্ড অনেক কাজ করে। মেরুদন্ড কে সজীব রাখার জন্য এর প্রয়োজনীয় উপাদান রক্তের মাধ্যমে পেয়ে থাকে। আমাদের ঘুমের সময় যদি মেরুদন্ডের ও শরীরের অন্যান্য সংযোগস্থলে স্বাভাবিক অবস্থা বজায় না থাকে তাহলে মেরুদন্ডের রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়। যার ফলে মেরুদন্ডের হাড় কশেরুকা মাংসপেশি ও লিগামেন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই অবস্থা দীর্ঘদিন চলতে থাকলে একসময় শরীরে ব্যথার সমস্যা তৈরি হয়। তাই সঠিক ঘুমের পদ্ধতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঘুমের সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন আমাদের হাত, পা এর পজিশনগুলো সঠিক ভাবে থাকে। একটি সাধারন কৌশল হলো ঘাড়ের নিচে বালিশ দিয়ে ঘুমানো। যদি চিৎ হয়ে ঘুমিয়ে থাকে হয় তাহলে হাটুর নিচে একটি বালিশ দিলে ভালো হয়। কাত হয়ে ঘুমালে দুই হাঁটুর মাঝখানে বালিশ বা কোলবালিশ ব্যবহার করা উত্তম। ঘুমানোর সময় অতিরিক্ত শক্ত ম্যাট্রেস বা অতিরিক্ত নরম ম্যাট্রেস ব্যবহার করা ঠিক নয়। মাঝারি ধরনের নরম ও শক্তের মাঝামাঝি ম্যাট্রেস ব্যবহার করা উত্তম। আমাদের সঠিক ঘুমের কৌশলের মাধ্যমে মেরুদন্ডে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক থাকে এবং সারাদিন সে যে লোড নেয় সেটি ওভারকাম করে স্বাভাবিক অবস্থা বজায় রাখতে পারে।

২) মাংসপেশির স্ট্রেচিং এক্সারসাইজঃ
মেরুদন্ডের স্বাভাবিক অবস্থা বজায় রাখার জন্য মাংসপেশির ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিয়মিত মাংসপেশির ব্যয়াম মেরুদন্ডের মাংসপেশিকে স্বাভাবিক রাখতে এবং অতিরিক্ত লোড নেয়ার জন্য সহনীয় করতে কাজে লাগে। এক্সারসাইজের মাধ্যমে মাংসপেশির রক্ত চলাচল বেড়ে যায় যার ফলে মেরুদন্ডে হার এবং ডিস্ক তাদের সজীব থাকার উপাদান যথাযথভাবে পেতে পারে।

৩) সঠিক জুতা ব্যবহার করাঃ
আমাদের শরীরের ভার পা দিয়ে গ্রাভিটি বা পৃথিবীর কেন্দ্রে নিউট্রালাইজ হয়। সাধারণত অস্বাভাবিক ধরনের উঁচু জুতা বা সামনে-পেছনে উঁচু-নিচু জুতা ব্যবহার করার কারণে আমাদের পুরো শরীরের ভার সঠিকভাবে নিউট্রালাইজ হতে পারে না। যে কারণে মেরুদন্ডের উপরে চাপ তৈরি হতে পারে। এজন্য সঠিক মাপের নরম ও হালকা উঁচু জুতা ব্যবহার করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে হাইহিল ব্যবহার মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে।

৪) সঠিক নিয়মে বসে কাজ করার পদ্ধতিঃ
যারা দীর্ঘক্ষণ বসে কাজ করেন তাদের ক্ষেত্রে সঠিক নিয়মে বসে কাজ করার পদ্ধতি জেনে নেয়া খুবই জরুরী। চেয়ারের পেছনে সামনের বাঁকানো ব্যাক রেস্ট ব্যবহার করা যেতে পারে। দীর্ঘক্ষন বসে কাজ না করে মাঝে মাঝে 5 মিনিটের জন্য একটু হেঁটে আবার বসে কাজ করা যেতে পারে। বসার জায়গা অত্যন্ত শক্ত বা অধিক নরম না করে শক্ত কাঠের চেয়ারে হালকা কুশন ব্যবহার করা যেতে পারে। বসে কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে নিজের শরীরকে ডানে এবং বামে ঘুরিয়ে কিছুটা চাপমুক্ত করা যেতে পারে।

৫) ধূমপান বর্জন করাঃ
দীর্ঘদিন ধূমপান করার কারণে আমাদের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় রক্তনালীগুলো সংকুচিত হয়। মেরুদন্ডে রক্তনালীগুলো এমনিতেই সরু। দীর্ঘদিন ধূমপান করার কারণে রক্তনালীগুলো আরো সরু হয়ে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে মেরুদন্ডের হাড়, মাংসপেশি, ডিস্ক এর সজীবতা রক্ষাকারী উপাদান সরবরাহ কমে যায়। যার ফলে মেরুদন্ড মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাই ধূমপান বর্জন আপনার মেরুদন্ডে স্বাভাবিক গঠন বজায় রাখতে খুবই সাহায্য করে।

৬) শরীরের ওজন সঠিক রাখা
৭) সুষম খাদ্য গ্রহণ
৮) ডায়াবেটিস ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা
৯) নিয়মিত হাঁটার অভ্যাস করা
১০) যারা বাসায় বয়োবৃদ্ধ আছেন তাদের ঘুমের সঠিক নিয়ম শেখানো ও মাঝে মাঝে বিভিন্ন জয়েন্ট গুলো অন্য কাউকে দিয়ে নাড়াছাড়া করিয়ে নেয়া।
১১) মাঝে মাঝে মাসাজ পদ্ধতি গ্রহণ করা যেতে পারে।
১২) স্বাভাবিক মাত্রায় পানি পান করা।
১৩) নিজের শরীরের ওজনের চার ভাগের এক ভাগের(২৫%) বেশি ওজন বহন না করা। যেমন-আপনার ওজন যদি ৬০ কেজি হয় তাহলে ১৫ কেজির বেশি হয়েছে না বহন করে।

যেসকল বিষয়ে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরিঃ

১) হঠাৎ কোনো অস্বাভাবিক আঘাত পাওয়ার কারণে ব্যথা অনুভূত হলে।
২) শরীরের কোন স্থানে টিউমার দেখা দিলে।
৩) অল্প সময়ের মধ্যে শরীরের ওজন কমে গেলে।
৪) হঠাৎ করে পা এ অবশ অনুভূত হলে।
৫) পায়খানা বা প্রস্রাবের নিয়ন্ত্রণ রাখতে না পারলে।
৬) অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে বা বসে থাকলে মাজায় ব্যথা অনুভূত হওয়া।
৭) মাজার ব্যথা পায়ের ডান পাশে বাবা-মা পাশ দিয়ে নিচে নেমে আসা।

পরিশেষে বলতে চাই মেরুদন্ড আমাদের শরীরের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। সুরক্ষার জন্য আমাদের সতর্ক ও তৎপর হওয়া উচিত। সামান্য অসতর্কতা অনেক সময় অনেক বড় বিপদ নিয়ে আসতে পারে। যে বিষয়গুলো আমাদের জানা সেই বিষয়গুলো তে সর্তকতা অবলম্বন করতে পারি। সকলে ভাল থাকুন সুস্থ থাকুন।

 

Tasnim Sanjana Kabir Khan

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

সেশনজট মুক্ত মেডিকেল শিক্ষাবর্ষের দাবিতে সিলেটে শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন

Sat Oct 17 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ১৭ অক্টোবর ২০২০, শনিবার আজ ১৭ অক্টোবর (শনিবার) সিলেটে সেশনজট মুক্ত মেডিকেল শিক্ষাবর্ষের দাবীতে মানববন্ধন করে শাবিপ্রবি অধীনস্থ মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীবৃন্দ। সিলেটের চৌহাট্টা পয়েন্টে কেন্দ্রীয় শহীদমিনারের সামনে এই মানববন্ধনের আয়োজন করেন মেডিকেল শিক্ষার্থীরা। এতে প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেন। তাদের ৩টি দাবি ছিলঃ ১) করোনাকালীন […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo