” নাড়ির টান “

এক বিজয়ী মায়ের গল্প
নাভিদ ও শিলার সংসার বলতে এই দুজনই ছিল বেশ কয়েক বছর। ব্যবসা গুছিয়ে উঠতে সময় লেগেছে। এখন দুজনেই ব্যবসা দেখাশোনা করে। বাড়ি ছেড়ে দূর শহরে এসে ব্যবসা দাঁড় করানো, টিকে থাকা কঠিন ব্যাপার। মফস্বল শহরে বাবা মা, ভাই ভাবি, সন্তানেরা। মাঝে মাঝে বেড়াতে আসেন। আর এক ধরনের অস্বস্তি, একটা বাচ্চা নেই!
কাজকর্মের ফাঁকে বাচ্চা নেয়ার চিন্তা যে করেনি তা না, চেষ্টাও ছিল। হচ্ছিলো না। কী সমস্যা? চিকিৎসা করতে গিয়ে দেখা গেল সমস্যা তেমন নেই। এক দুইটা ওষুধ দিলো, কাজ হয়ে যাবে।
কিন্তু পরীক্ষা করতে গিয়ে ধরা পড়লো দুজনেরই রক্তে সমস্যা। স্বামী স্ত্রী দুজনেই থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট। অর্থাৎ থ্যালাসেমিয়া বাহক। এসব ক্ষেত্রে বাচ্চার থ্যালাসেমিয়া হবার সম্ভাবনা আছে, যদিও বাবা মা দুজনেই স্বাভাবিক জীবনযাপন করেন।
যদি বাচ্চার তাই হয়, প্রতিকার কি? নিয়মিত রক্ত দেয়া, কিছু খাবার বেছে খাওয়া, প্রায় মাসে চেক আপ করা ইত্যাদি। করতে হবে জীবনভর। রক্ত দেয়া বিষয়ক নানারকম ঝুঁকির কথা বিভিন্ন ভাবে জেনে নাভিদ দমে গেলো। সন্তানকে এমন পরিস্থিতি তে পড়তে কে দেখতে চায়? কিন্তু শিলা বাচ্চা নিবেই। তার অবস্থা দিনকে দিন পাগলের মতো হয়ে যাচ্ছে। গভীর রাতে ঘুম থেকে উঠে বসে কাঁদে। এখন উপায়? উপায় একটা আছে। বাচ্চা একটু বড় হলে বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট করতে হবে। সফল হলে চিরতরে থ্যালাসেমিয়া মুক্ত। সাফল্যের হার নাকি বেশ ভালো।
বাচ্চা নেয়ার প্রস্তুতির পাশাপাশি চিকিৎসা নিয়ে দেশে বিদেশে খোঁজ করতে লাগলো। বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট এর ব্যাপারে চিকিৎসক এক অদ্ভুত পদ্ধতির কথা বলেছিলেন। আগে কখনো শোনেনি। বাচ্চা জন্মের সময় যে নাড়ি কাটা হয়, সেই নাড়ি থেকে রক্ত সংগ্রহ করে বিশেষ পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা হয় কয়েক বছর। বাচ্চা একটু বড় হলে এই রক্ত থেকে বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা হয়। নিজের রক্ত দিয়ে করা হয় বলে ডোনার খুঁজতে হয় না। ডোনারের রক্ত নেয়ার যে জটিলতা, তা একেবারেই নেই। ব্যয়ও কিছুটা কমে আসে।
ব্যয় কমলে কি হবে, তবুও ব্যয়বহুল। দেশে এই পদ্ধতির চিকিৎসা নেই। বিদেশে গিয়ে মায়ের চেক আপ, বাচ্চা নেয়া, মায়ের পেটে থাকতেই বাচ্চার এই রোগ হলো কিনা চেক করা লাগবে। যদি রোগ হয়, তাহলে ডেলিভারি ওখানেই করতে হবে। যেন নাড়ির রক্ত সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা যায়। দেশে ফিরে এসে নিয়মিত চেক আপ, প্রয়োজন মতো রক্ত দেয়া।
কয়েক বছর পর বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট এর জন্য আবার যাওয়া। সেই যে নাড়ির রক্ত সংরক্ষণ করা হয়েছিল, সেটা দিয়েই।
এই ক’বছর নাভিদ-শিলা নানান মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে গেছে। এত লম্বা সময়ের চিকিৎসা, সফল হবে কি হবে না। বাচ্চা হয় কিনা, তার রোগ হয় কিনা, তার চিকিৎসা – নানান দুশ্চিন্তা। এর মাঝে উপরি হলো আশেপাশের লোকজন নানান পরামর্শ উপদেশ দিতো। বাচ্চা হয় না কেন, আরেকটা বিয়ে করে না কেন ইত্যাদি প্রশ্ন। দত্তক বাচ্চা নেয়ার সিদ্ধান্ত প্রায় নিয়েই ফেলেছিল। পরে সিদ্ধান্ত হলো, বাচ্চা দত্তক নিবে, পরে। এই চেষ্টা সফল হলেও, না হলেও। এর মাঝে নাভিদের পরিবারের অকুণ্ঠ সমর্থন ওদের আশাবাদী করেছে। ব্যবসা আর পরিবার, এর বাইরে কারো সাথে যোগাযোগ বলতে গেলে ছিল না বললেই চলে।
অবশেষে সবকিছু ভালোয় ভালোয় হলো। নিজের নাড়ির রক্তে বাচ্চার বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট হয়েছে বছর পাঁচেক হয়ে গেল। দুই ভাই মিলে সারাঘর এলোমেলো করে রাখে। মায়ের হালকা বকুনি কি আর ওদের থামাতে পারে! কে বলবে ওদের একজন এতিম, দত্তক? সবাই জানে ওরা যমজ। লোকজন অবাক হয়। দেখতে মোটেও এক না। আচ্ছা, হয় না এমন? সব যমজ কি দেখতে একরকম ? বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে বসে যায় তাদের মা। দিনের পর দিন এই একই ব্যাখ্যা দিয়ে আসছে। কোনো বিরক্তি নেই। হাসিমুখে ক্লাস নিচ্ছে যেন । এই একটা প্রসঙ্গ এলেই শিলার আগ্রহ হয় দেখার মতো।
মায়ের কাছে কি আর সন্তানের ভাগ যোগ হয়?
এদিকে নাভিদ গভীর চিন্তায় মগ্ন। সেদিনও এক আত্মীয়ের বাড়িতে নরমাল ডেলিভারিতে বাচ্চা হয়েছে শুনে দেখতে গেছে। গিয়েই জিজ্ঞেস করেছে নাড়ি আর গর্ভের ফুল কোথায়? পুঁতে ফেলা হয়েছে শুনে কিছুটা হতাশ যেন। লোকজন একটু অবাকই হয়েছে। বাচ্চা দেখতে চায় সবাই, উনি খুঁজছেন নাড়ি!
নাভিদের চিন্তায় তখন একটাই কথা। এত দামি একটা জিনিস! টাকায় কেনা যায় না। ফেলে দিলো ! রাখবেই বা কোথায়? দেশে তো আর কর্ড ব্লাড ব্যাংক নেই!

 

লেখকঃ
ডা. মুরাদ হোসেন মোল্লা
ডা. আশরাফুল হক
 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

দুই টুকরা মাংস -ডা.ফাহমিদা শিরীন নীলা

Wed Sep 12 , 2018
প্ল্যাটফর্ম সাহিত্য সপ্তাহ -৪১ ” দুই টুকরা মাংস “ লেখকঃ ডা.ফাহমিদা শিরীন নীলা এমবিবিএস; এফসিপিএস(গাইনী এন্ড অবস); ফিগো ফেলো(ইটালি) গাইনী কনসালটেন্ট, শাহজাহানপুর, বগুড়া। (১) ‘আম্মা, সত্যি সত্যি এবার আমাদের কুরবানি দেয়া হবেনা?’ খেতে খেতে শরিফা বেগমের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে দশ বছর বয়সী ছোট ছেলে সজীব। চুপ করে থাকেন মা। […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo