ডাক্তার কি তাঁর যথাযথ সম্মান পাচ্ছেন?

১২ এপ্রিল, ২০২০

কলেজে জানের দোস্তি ছিলো! ঈদের দিন বেরিয়ে সাত-আট বাসায় ঘুরতাম। সেই বন্ধু ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হয়ে চুড়ান্ত ক্ষ্যাত হয়ে গেছে।

অবিশ্বাস্য সত্যি ব্যপার হল বুয়েটের গেট থেকে লাইটার জ্বালালে যে ঢাকা মেডিকেলের গেট থেকে দেখা যায়, সেখান থেকেও ওরা কোনোদিন আমাদের ক্যাফেতে আসে নাই চা খেতে। পলাশী তো দূরের কথা, আমাদের হলেও না। ঘ্যনাইতে ঘ্যনাইতে অসহ্য হয়ে, একসময় রাগ করে ফোন করা অফ করে রাখছিলাম।

একদিন কল দিলো একজন, পিসি নষ্ট! রাগ করে বললাম, ”তুই পিসিতে কি করস? এম্পিথ্রি কিনে নে, গান শুনবি।”

আমরা ফার্স্ট ইয়ার থেকে টিউশনি করি। আমি মোটামুটি সেমিস্টার ফী ছাড়া আর কিছু বাসা থেকে নিতাম না। ছেলেরা আরও বেশি করত। আর মেডিকেলের ওরা বিকালে ঘুমাতো। কল দেয়াও নিষেধ। রাতে পড়বে। প্রফের সময় তো নাম নেয়াও পাপ, আস্তে আস্তে চেহারা ভুলে যেতে থাকলাম।

২০০৬ তে আমাদের সবার আস্তে আস্তে ফেসবুক একাউন্ট হচ্ছে, ওরা সেখানেও গায়েব!
আমরা পাশ করেছি, ওরা তখনও পড়ে। দেখা করতে চাইলে খেঁকিয়ে ওঠে। সামনে প্রফ। সেইটা দিয়েও ইন্টার্ন করে।

‘সেই বাবলাতলা, সেই দড়ি, সেই খুঁটা, সেই তৃণহীন শূন্য আধার!’ পাশ করে যারা চাকরিতে ঢুকেছে, তাদের অবস্থা করুণ। সাত হাজার টাকায় মেডিকেল অফিসার। ইমার্জেন্সির ডিউটি বা ডিউটি ডক। আমরা তখন অন্তত পঁচিশ না হইলে জবে না করে দিচ্ছি। মন টানে না। টিউশনি করেই দশের ওপর হাতে পেতাম মাসে। ওদিকে ওরা রাত জাগে। হয় ডিউটি নয় পড়ে। এমডি করবে, নইলে এফসিপিএস। নামই জানি কেবল। এগুলা যুদ্ধের আর কিছুই জানিনা।

বিয়েশাদির দাওয়াতে নাই, বিয়েও করে কালেভদ্রে একটা দুইটা। টেবিল ছেড়ে শাড়ী পরেছে এসে, এমন দশা। অথচ সবগুলা অসাধারণ সুন্দরী!

প্র্যাকটিসের জগত কেমন, ওরা বলে না আমাদের। ক্লাসমেটের কাছে কেমন করে বলে এসব? আমি জেনেছি পরিবারের ডাক্তারদের থেকে। প্রাইভেট ফিল্ড মোটামুটি এমন, হাইফাই ফাইভ স্টার হাসপাতালে ফী চড়া, টেস্ট লেখার বাধ্যবাধকতা নেই, কিন্তু ডিগ্রি লাগে। অন্যান্য জায়গায়? টেস্ট না লিখলে কর্তৃপক্ষ শাসায়, লিখলে রোগী শাপান্ত করে। সরকারিতে আরও করুণ দশা। প্যারাসিটামলও স্টকে নাই, রোগি ডাক্তারের সামনে সপরিবারে দাঁড়িয়ে গালিগালাজ করে। অথচ মাথায় অসীম ভাবনা। বয়স ৩০, বিয়ে করে নি। করেছে যারা তাদের অবস্থা আরও ভয়াবহ, ন্যুনতম খরচ করতেও ধার করতে হয়েছে।

কেন বললাম এত কথা? সিস্টেমে ভূল কোন সেক্টরে নেই? ব্যাংকের আভ্যন্তরীন যোগসাজসে ঋণখেলাপি হচ্ছে না? কর্মকর্তা বিদেশ পলিয়ে গেছেন, তহবিল তছরুপ করে, হচ্ছে না? আমরা ইঞ্জিনিয়াররা সই দিতে বাধ্য হচ্ছি না কত অবৈধ জায়গায়? চাল খাবেন আপনি সাদা পাঞ্জাবীর রাজনীতিবিদ, জাহান্নামে যাবে কেবল কসাই ডাক্তার!?

কেন নিজে ডাক্তার না হয়েও লিখলাম এইসব? সংক্রামক রোগে ডাক্তার, নার্স এই পেশার সকলেই বৃত্তের কেন্দ্রে থাকে। কিনারায় থাকে রোগী, রোগীর আত্নীয় স্বজন। বৃত্তের ইনারায় থাকা মানুষদেরকে আলাদা রাখা গেলে, বিপদ যত সহজে এড়ানো যায়, কেন্দ্রের কেউ আক্রান্ত হলে, তত সহজে পার পাওয়া যায় না। ঝুঁকিতে পড়ে যায় কেন্দ্রের সবাই, কিনারার সব রোগি। এই সাধারণ কথাটা না বুঝলে ডাক্তারদের নিরাপত্তার দাবীকে মনে হবে ছেলেদের নতুন বলের আবদার! হালকা আহ্লাদ দিয়ে বা তাতে কাজ না হলে ধমক দিয়ে কাজ হয়ে যাবে। ফলাফল কি হচ্ছে, এই পর্যন্ত কতজন ডাক্তার এবং স্বাস্থ্যকর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, তার পরিসংখ্যান দেখলেই বোঝা হয়ে যাবে।

শুধু, আমার জায়গা থেকে আমি যা করতে পারি তা হল, আমার চেনা সকল ডাক্তারকে (আমার ছেলের ডাক্তার আপাকে স্পেশালি) আমি দাঁড়িয়ে একটা সালাম দিই। মনে মনে। ছেলে হবার সাত দিনের মাথায় গেছি ফলো আপে, আমাকে বসিয়ে বললেন, ‘সন্তানকে সময় দাও। আমার এগারো বছরের ছেলে আমার চোখে তাকায় না। ওকে আম্মার কাছে রেখে অনারারি করেছিলাম’। আমি একদিন হাতে বানানো একগাদা খাবার ভরে আপাকে দিয়ে আসছিলাম, নাম না জানিয়ে। যেন বাসায় নিয়ে যান।

আমার এলাকার ডাক্তার দম্পতিদের বাচ্চাদের মায়া লাগে, যথাসাধ্য খবর নিই। বাবা-মায়ের ত্যাগ বুঝতে শিখুক মানিকেরা, কম যত্নেও মানুষ হোক, দুয়া করি। সব ডাক্তারদের নন-ডাক্তার জামাই বা বউদের মনে মনে শ্রদ্ধা করি। আমি যে ডাক্তারের ৪০ নং সিরিয়াল পেয়েও ভাগ্যবান অনুভব করি, তাঁরা সে মানুষটার জন্য রাত জেগে বাসায় অপেক্ষা করেন।

আমার ডাক্তার ভাইগুলো, বোনগুলো, খালা-মামা, আমার বন্ধুবান্ধব সবাই যেন সুস্থ থাকে, অন্য সব ডাক্তারও। এদের জীবনের পেছনে বড় বেশি কষ্ট বিনিয়োগ করা হয়ে গেছে। এর শোধ আমি দিতে পারি না, পারবোও না।

লিখেছেনঃ মারদিয়া মমতাজ (BUET)
লেকচারারঃ ডেফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

Publisher

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

করোনার কারণে এবার অবরুদ্ধ হলো সুনামগঞ্জ!

Sun Apr 12 , 2020
১২ এপ্রিল, ২০২০। রবিবার সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ জেলার পর এবার সুনামগঞ্জেও হানা দিয়েছে প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস। তাই করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে এবং করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারের সকল নির্দেশনা কঠোরভাবে মেনে চলতে জনগণকে বাধ্য করাসহ তাদের সামগ্রিক নিরাপত্তায় সুনামগঞ্জ জেলাকে অবরুদ্ধ (লকডাউন) ঘোষণা করেছে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন। আজ রোববার (১২ এপ্রিল) বিকাল […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo