দেশ-বিদেশ, ডাক্তারী ও কিছু কথা || পর্ব-৪

প্ল্যাটফর্ম প্রতিবেদন, ৬ আগষ্ট ২০২০, বৃহস্পতিবার

ডা. সাদিয়া হোমায়রা সোহানা
এফ.সি.পি.এস (পার্ট-১; গাইনী)
এম.আর.সি.ও.জি (পার্ট-১)
প্রাক্তন মেডিকেল অফিসার, সুলতান কাবুস হাসপাতাল, সালালাহ, ওমান।

ওমানে আমার পোস্টিং হয় রাজধানী মাস্কাট থেকে প্রায় ১১০০ কি মি দূরে সালালাহ শহরে, সুলতান কাবুস হাসপাতালে। প্রথম দর্শনেই শহরটা ভালো লেগে যায়। গতানুগতিক মধ্যপ্রাচ্যের যে ছবিটা আমাদের মনে থাকে, তার চেয়ে একটু ভিন্ন। কেমন সবুজ চারপাশে আর মাস্কাটের মতো অসহনীয় গরম নেই।

পরদিন হাসপাতালে গেলাম, একটু অবাক হলাম একতলা হাসপাতাল দেখে। এই নাকি ২৬ টা হেলথ সেন্টারের জন্য রেফারেল সেন্টার, দেশের অন্যতম বড় হাসপাতাল! পরে মনে হয়েছে, এদের তো জায়গার অভাব নাই, তাই তারা উপরে বাড়ানোর ব্যাপারে মাথা ঘামায় না।

হাসপাতাল বেশ বড়, শুধু গাইনী অবস ডিপার্টমেন্টেই একশ দশ বেড। আমার আগেও বেশ কয়েকজন বাংলাদেশী ডাক্তার এখানে কাজ করেন, একজন তারমধ্যে আমার একই ডিপার্টমেন্টে, মনে মনে একটু খুশিই হলাম। কিন্তু প্রথম দিনই তার প্রতি বাকী ডাক্তারদের ব্যবহারে একটু ধাক্কা খেলাম, ঠিক স্বাভাবিক মনে হলোনা। সকালের সেশনে বা অন্য কাজের সময় মনে হলো সবাই ওত পেতে বসে আছে উনার ভুল ধরার জন্য। ঠিক নতুন ব্যাচ আসলে যেমন ইউনিভার্সিটিতে আমরা র‍্যাগিং এর কথা শুনি, তেমন। পরে উনি ডিপার্টমেন্ট বদলে চলে গেলেন, আমি আবার একা। প্রথম প্রথম অনেকের ব্যবহার খুব খারাপ লাগতো, আবার কেউ কেউ ছিলো বেশ ভালো। তবে আমি খুব চুপ করে থাকতামনা। যেখানে কথা বলা দরকার, বিনয়ের সাথে বলতে দ্বিধা করতামনা। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, চারপাশের এই শত্রু শত্রু দেখতে মুখগুলো একসময় বন্ধুর মুখ হয়ে গিয়েছিলো।

এর পরের ধাক্কা ভাষা। দুই সপ্তাহের সময় দেয়া হলো, একদিন পর পর ১২ ঘন্টা ডিউটি করতে বলা হলো আর আউটডোরে দু’দিন আরেকজন ডাক্তারের সাথে বসার পর বলা হলো একাই রোগী দেখতে। ভাষা না জানলে তো এ বিরাট মুশকিলের ব্যাপার। তবে মজার ব্যাপার হলো আরবী খুব সহজ ভাষা। কথ্য আরবীতে খুব বেশি ব্যাকরণের ঝামেলা নাই। আশেপাশের ডাক্তারদের চেয়ে রোগীদের কাছেই ভাষাটা বেশি শিখেছি। আর কিছু রোগী আসে যারা হিন্দি, উর্দু অথবা বাংলা ছাড়া কোন ভাষাই পারেনা। এই প্রথম দীর্ঘদিন হিন্দি সিরিয়াল দেখার কোন সুফল পেলাম। জ্বী, আমি হোস্টেলের সেই বিরক্তিকর আপুদের একজন যারা রাত দুইটায় “কাসুতি জিন্দেগী কি” দেখতে টিভি রুমে আসতো!

এরপরের ধাক্কা ডকুমেন্টেশন আর কাউন্সেলিং এর ধাক্কা। আমি কিছু করার পর যদি তা ডকুমেন্ট না করি, তার মানে সেটা আমি করিনি। রোগী দেখছো? লিখে রাখো, ইনভেস্টিগেশন করেছো? লিখে রাখো। কাউন্সেলিং করেছো? লিখে রাখো। রোগীর ব্যাপারে সিনিয়রের সাথে কথা বলেছো? লিখে রাখো। লিখোনি? তার মানে করোনি। দেশে তো এতো হ্যাপা পোহাতে হতনা। তবে এটা যদি আসলেই আমরা ঠিকঠাক করতে পারি, শুধু যে জবাবদিহিতা বাড়তো, তাই নয় অনেক অহেতুক দোষারোপ থেকেও বাঁচা যেতো।

প্রথম অনকল ডিউটিতে আমাকে বলা হলো সিজারিয়ান এর কনসেন্ট নিতে। আমি গিয়ে বললাম বাচ্চার অবস্থা খারাপ সিজার করতে হবে, রোগীর হাসব্যান্ড তেমন কোন গাইগুই না করেই দিলো কনসেন্ট। ডিউটিতে থাকা সেকেন্ড অন কল বললো কি কাউন্সেলিং করলা? শুনে উনি আবার গেলেন আমাকে সাথে নিয়ে, ভালো মতো বুঝিয়ে বললেন কেন সিজারিয়ান করা হচ্ছে, ১০০ জনে প্রায় ৮ জনের অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হতে পারে, ১০০০ জনের মধ্যে ১ জনের বাওয়েল/ ব্লাডার এ ইঞ্জুরি হতে পারে, সেক্ষেত্রে হাসপাতালে একটু বেশি দিন থাকতে হতে পারে এবং ২% এর ক্ষেত্রে বাচ্চার গায়ে আঘাত লাগতে পারে। মাথাটা একটু ঘুরে উঠলো। এতো কিছু আমি কিভাবে বলবো, তাও আরবীতে! তাও একটা ইমার্জেন্সি সিজারিয়ানের আগে। কিন্তু আমি পারলাম। প্রথম প্রথম মিডওয়াইফের সাহায্য নিয়ে আর পরে নিজেই খুব অল্প সময়ে বলতে শিখলাম। বুঝলাম, ইটস অল এবাউট প্র‍্যাক্টিস।

এভাবে অপারেশন-পূর্ব কাউন্সেলিং এর সুবিধা, অপারেশনের সময় যদি কোন সমস্যা হয় রোগী ও তার স্বজনেরা বুঝতে পারেন যে এটা অপারেশনের একটা ঝুঁকি, ডাক্তারের ভুল নয়। হঠাৎ যদি তাকে বলা হয় রোগীর রক্তক্ষরণ হয়েছে বা ব্লাডার ইঞ্জুরি হয়েছে সে দুঃখ পায়, কিন্তু মনে করেনা কসাই ডাক্তার তার রোগীর ভুল চিকিৎসা করেছে। আমাদের দেশে কোনটা সার্জারীর স্বাভাবিক ঝুঁকি, কোনটা চিকিৎসার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, তার সঠিক জ্ঞানের অভাবে সবকিছুই তারা ভুল চিকিৎসা মনে করে।

হেলথ-এডুকেশন চিকিৎসার এতো গুরুত্বপূর্ণ একটা ধাপ, তা আমরা বেশীর ভাগ সময় খুবই অগুরুত্বপূর্ণ মনে করি। অভ্যাসের অভাব, সাথে রোগীর বোঝার ক্ষমতার। একবার সার্জারী ওয়ার্ডে সিনিয়র স্যার পরদিন ল্যাপারোস্কপি হবে এমন এক রোগীর পাশে দাড়িয়ে আমাদের এই ল্যাপারোস্কপিক সার্জারী বিষয়ক ঝুঁকি পড়ান। পরদিন সার্জারীর আগে ওই রোগীকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি, ভয়ে পালিয়েছে। একদিনে আসলে সব বদলে যায়না। তবে আমরা যদি চেষ্টা করি খুব অল্প অল্প করে হলেও, একদিন হয়তো ঠিকই বদলাবে।

ওমানের গল্প আরো করব। তবে একটু বলে রাখি, ডিপার্টমেন্টে বেশিদিন আমাকে একা থাকতে হয়নি। কয়েক মাস পর আরও একজন বাংলাদেশি ডাক্তার আসেন এবং তিনি আমার প্রাণের বন্ধু হয়ে যান কিছুদিনের মধ্যেই। অন্যদেশের ডাক্তাররা যখন নিজেদের মধ্যে নিজের ভাষায় আরবি, হিন্দি, উর্দুতে গল্প করতো, আমরাও মনের সুখে বাংলা বলতাম। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমরা তাদের প্রায় সব কথা বুঝতাম,তারা কিন্তু আমাদের কথা বুঝতোনা। বাংলা খুব সহজ ভাষা নয় কিন্তু!

Sarif Sahriar

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

চীনে বুনিয়াভাইরাস সংক্রমণে ৭ জনের মৃত্যু

Thu Aug 6 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৬ আগস্ট ২০২০, বৃহস্পতিবার একটি রোগবাহী এঁটেল পোকা সংক্রমণজনিত নোভেল বুনিয়াভাইরাসের পুনরায় দেখা মিলল চীনে। এ পর্যন্ত ৬০ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং ৭ জনের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া যায়। CNA হতে জানা যায়, সম্প্রতি জিয়াংসু প্রদেশের নানজিং শহরের একজন ৬০ বছর বয়সী বৃদ্ধ চা-চাষকর্মী অসুস্থ হয়ে পরেন, […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo