ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ক্যাজুয়াল্টি থেকে বলছি

১৬ এপ্রিল, ২০২০

লিখেছেন- ডা. সাকিব হাসান

আমি বরাবরই ইন্ট্রোভার্ট(অন্তর্মুখী) আর চাপা স্বভাবের মানুষ ছিলাম, নিজের কমফোর্ট জোনের (স্বস্তির) বাইরে গেলে নার্ভাস হয়ে যেতাম। কিন্তুু মেডিকেলে ইন্টার্নির সময় থেকে যখন ক্লিনিকাল সাইডে যাওয়া শুরু করলাম আর হাজার পদের ইমার্জেন্সি ঝামেলা ম্যানেজ করা শুরু করলাম, তখন থেকে নিজের মধ্যে একটা অন্যরকমের কনফিডেন্স আসা শুরু করলো। রাস্তার পাগলা কুকুরের কামড় খেয়ে আসা ড্রাগ অ্যাডিক্টের পায়ের অ্যাবসেস ড্রেইন(পুঁজে ভরা ফোঁড়া) করা হোক বা লোকাল পাতি নেতার ১৫-২০ জন নিয়ে আসা শ্বাসকষ্টের রোগী হোক না কেন, কোন কিছু দেখলেই ঘাবড়াতাম না, ঠান্ডা মাথায় কাজ করতাম। হাসপাতাল হয়ে উঠলো আমার জন্য একটা কমফোর্ট জোন (স্বস্তির জায়গা)।

আর এখন একটা ভয়ংকর আতঙ্ক নিয়ে হাসপাতালে যাই, আমার কমফোর্ট জোনই এখন প্রায় এলম স্ট্রিটের মত নাইটমেয়ার(দুঃস্বপ্ন) জোন হয়ে গেছে। আগামীকালকের ২৪ ঘন্টা অ্যাডমিশন(রোগী ভর্তির দিন) ভাবলেই এখন পেট নাড়া দিয়ে উঠছে। ডিএমসি ক্যাজুয়াল্টির একজন নার্স কোভিড পজিটিভ হওয়ার পর করোনা থেকে নিজেদের এক্সপোজার কমানোর জন্য যে ২৪ ঘন্টা ডিউটি আমরা আগে দুই ভাগ করে, ১০-১২ জন মিলে করতাম। আর সেটা এখন মাত্র ৫ জন মিলে করছি, যাতে একটা গ্রুপ কোয়ারেন্টাইনে গেলেও ওয়ার্ড ফাংশনিং থাকে। (অর্থাৎ ৫জনের এক গ্রুপ কোয়ারেন্টাইনে গেলে অপর ৫জনের গ্রুপ এসে দায়িত্ব বুঝে নিবে। ফলে ক্যাজুয়াল্টি বিভাগে রোগীর চিকিৎসা অব্যাহত থাকবে) আর রোগীও মাশাল্লাহ করোনা টরোনা কিছু মানছে না, রোড ট্রাফিক অ্যাকসিডেন্ট কিছু কমলেও ফিজিকাল অ্যাসল্ট মারামারি বেড়ে গেছে অনেক। আগের অ্যাডমিশনে ৫ টা ল্যাপারোটমি(পেটের অপারেশন) হয়েছে। একজন রোগী এসেছে নিজের গায়ে ৯ টা বড় সাইজের চাপাতির কোপ, ওপেন চেস্ট উন্ড(বুকের খোলা ক্ষত) আর অ্যাকিলিস টেন্ডন কাট(গোড়ালির পিছনের রগ কাটা) নিয়ে, চেস্ট ড্রেইন টেন্ডন রিপেয়ার(বুকের ক্ষত ও পায়ের কাটা রগের অপারেশন) এর সাথে সেলাই লেগেছে, ভিতর বাহির মিলে ৭০-৮০ টার মত, দিতে দিতে পিঠ প্যারালাইজড(ব্যথায় অবশ)। শেষ রাতে এমন অবস্থা হয়েছিল যে, বাথরুমে যেতে হলেও অন্য কলিগ বড় ভাইদের অনুমতি নিয়ে যেতে হয়েছে। এতো রাশ এর মধ্যে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মত আছে গ্লাভসের সংকট, মাস্কের সংকট, ক্যাপের সংকট, আর ভ্যাপসা গরমে পিপিই(সুরক্ষা সামগ্রী ও পোশাক) পরে থাকার যন্ত্রণা। যে রেইনকোট পিপিই দিয়েছে। তার চেয়ে দুই তিনটা N95 মাস্ক আর কয়েকটা ৭-৭.৫ সাইজের গ্লাভস দিলেও কাজ হতো। ৬.৫ গ্লাভস পড়ে থাকতে থাকতে মনে হয় আঙ্গুলের নখ খসে পড়বে। এত কিছুর মধ্যে হাত কি নাকে গেল কিনা, মুখে কুলি করার পানি নেওয়ার আগে হাত স্যানিটাইজার দিয়ে ধুয়েছিলাম কিনা এত কিছু খেয়াল থাকে না, শুধু মনে হয় কখন ডিউটি আওয়ারটা শেষ হবে আর এই জাহান্নাম থেকে বের হবো। কি পরিমাণ কোভিড এক্সপোজার হতে পারে সেটা এক্সপেরিয়েন্স থেকেই বুঝে নিবেন। তাও বাসায় ঢোকার আগে প্রায় ১ ঘন্টা লেগে যায় নিজের ফ্যামিলির সেফটি এনশিওর করে ঘরে ঢুকতে।(ঘরে প্রবেশের আগে জীবাণু মুক্ত হবার বিশেষ ধরনের কৌশল যার মাঝে গায়ের পোশাক, জুতা, মাস্ক, চশমা ইত্যাদি খুলে সোজা ধুয়ে ফেলতে হবে এবং গোসল করে ফেলতে হবে। জীবাণু নাশক ব্যবহার করতে হবে। অন্যদের থেকে দূরে থাকতে হবে। )

“পালাচ্ছি না”, “Heroes work here” এইগুলা বলা যত সহজ ক্যারি আউট করা(কাজে পরিণত করা) ততটাই কঠিন, অন্তত আমার তাই মনে হয়। দিন শেষে আমরা সবাই শারীরিক মানসিক আত্মিক সীমাবদ্ধতাসম্পন্ন মানুষ। তাই আমার মতে আমাদের এমন কিছু দাবি করা ঠিক হবে না যেটা নিজেদের গলাতেই বোঝা হিসাবে আসে। শুধুমাত্র মেডিকেল সেক্টর কিরকম প্রেশারের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে সেটুকু বোঝানোর জন্যই নিজের এক্সপেরিয়েন্সটা বললাম। আর আমার মতে
এইরকম অবস্থা বেশিদিন চললে আমাদের ইন্ডিভিজুয়াল হিরোগিরি(ব্যক্তিগত একক নৈপুণ্য) বেশি দিন টিকবে না, পুরা সিস্টেম কলাপ্স করবে(ধ্বসে যাবে)।
”টানেলের শেষের লাইট এখনও অদৃশ্য ”

নিজস্ব প্রতিবেদক /সিলভিয়া মীম

Publisher

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

লক্ষ্মীপুরে করোনা সন্দেহে মৃত ব্যক্তির লাশ দাফনে ডাক্তার

Thu Apr 16 , 2020
প্লাটফর্ম নিউজ, বৃহস্পতিবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২০ কোভিড ১৯ এর উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়ায় চাঁন মিয়ার লাশ দাফন করতে অনিচ্ছুক আত্মীয়-স্বজনরা। জানাজা ও দাফনের কাজে একদল স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে এগিয়ে এলেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক ডা. রেজাউল করিম। লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার ফাজিল বেপারীরহাট এলাকার বাসিন্দা চাঁন মিয়া, জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত সোমবার […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo