ডিসেকটিং দ্য মিথ অফ ‘কসাই’ ডাক্তার

লেখকঃ ডাঃ আব্দুল্লাহ সাইদ খান

বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের একটি সাধারণ অভিযোগ হল: ডাক্তাররা কসাইয়ের মত টাকা নেন। বিষয়টি নিয়ে ভাবলাম। মনে হল এই মিথটার ব্যবচ্ছেদ করা দরকার।

আমরা যারা তরুণ ‘সিম্পল এম.বি.বি.এস’ ডাক্তার তারা এ অভিযোগ শুনে অবাক হই। কারণ, ঢাকায় (মূল শহর থেকে একটু দূরে) আমরা প্রাইভেট চেম্বার দিয়ে বসলে প্রতি দুই দিনে গড়ে এক থেকে দুই জন এবং মাসে গড়ে বিশ থেকে পয়ত্রিশ জন রূগী পেতে পারি। ভিজিট দুশ, এলাকা ভেদে সর্বচ্চো তিনশ। আমাদের রূগী দেখার হারে কোন সাধারণ মানুষও কসাই বলবে না। তাহলে সাধারণ মানুষরা কিসের উপর ভিত্তি করে তাদের অভিযোগের জেনারালাইজেশন করছে?

চলুন একটু ঘেঁটে দেখি। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় একটি সমস্যা হলো ‘রেফারেল সিস্টেম’-এর বালাই নেই। রেফারেল সিস্টেম অনুযায়ী একজন ব্যক্তি অসুস্থ হলে তাকে প্রথমে দেখবে একজন ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান অথবা জেনারেল প্র্যাকটিশনার। তিনি রোগটির সমাধান করতে না পারলে পাঠাবেন একজন বিশেষজ্ঞের কাছে। কিন্তু বাংলাদেশে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের দেখানোর জন্য কোন ডাক্তারের রেফারেন্স প্রয়োজন নেই। শুধুমাত্র ফোন দিয়ে একটি সিরিয়াল নিয়ে নেয়া। আর ‘যেহেতু যে বিশেষজ্ঞ ইচ্ছে তার কাছেই যাওয়া যাচ্ছে সেহেতু প্রফেসরকেই দেখাই’-এই মানসিকতায় প্রফেসরদের কাছে রোগী যাওয়ার হিড়িক পড়ে যায়। ফলে কোন কোন প্রফেসর গড়ে একশ রোগী দেখেন।

যেই প্রফেসর গড়ে একশ রোগী দেখেন তার পক্ষে কি প্রত্যেক রোগীকে ৫ মিনিট করেও দেয়া সম্ভব? ৫০০ মিনিটে হয় ৮ ঘন্টা ২০ মিনিট। ফলে উক্ত প্রফেসর সর্বোচ্চ এক থেকে তিন মিনিট সময় দিতে পারেন। এই এক থেকে তিন মিনিটে তার ভিজিট পাঁচশ থেকে একহাজার (ডাক্তার ভেদে)। এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষের অভিযোগ ডাক্তাররা কসাই-এর মত টাকা নেয়।

কিন্তু কয়েকটা ব্যপার লক্ষ্যনীয়। উপরের চিত্রটি মেডিসিন প্রফেসরদের (অল্পকিছু)। বিশেষজ্ঞ ও প্রফেসর সার্জনরা হয়ত দু তিন মিনিটে রূগী দেখেন না, কিন্তু তারা সার্জারী করে মেডিসিন ডাক্তারদের চেয়েও বেশী আয় করেন। কিন্তু তাদের কথা সাধারণ লোকের মুখে সাধারণত আসে না। আবার মেডিসিন প্রফেসরদের উপরোক্ত চিত্রটি কিন্তু হাতে গোনা কয়েকজন চিকিৎসকের। অনেকটা ব্যবসায়ীদের মধ্যে শিল্পপতিদের সংখ্যাটা যেমন, ঠিক তেমন।এই যে শিল্পপতিরা এত টাকা আয় করছেন, রাজণীতিবিদরা দূর্ণীতি করে মানুষের কষ্টার্জিত টাকা মেরে খাচ্ছেন তাদের মানুষ ‘কসাই’ বলছে না কেন?

আমার ধারণা এর কারণ হল ‘Visibility’। মানুষের হাত থেকে যখন নগদ টাকা বেরিয়ে যায় তখন চোখে লাগে। বিশেষ করে তা যদি হয় দু-তিন মিনিটের এডভাইজের বিনিময়ে। প্রশ্ন হতে পারে, পণ্য কিনতে গিয়েও তো মানুষের হাত থেকে নগদ টাকা বেরোয়? পণ্য কিনলে মানুষ একটা ভিজিবল জিনিস কিনছে। কিন্তু ডাক্তারদের সেবাটা ভিজিবল না। আবার অন্য দিক দিয়ে, প্রফেসর ডাক্তারদের দু-তিন মিনিটে পাঁচশ টাকা ভিজিট নিয়ে নেয়াটাও মানুষের চোখে বেশ লাগে। অথচ, এই গুটি কয়েক প্রফেসরদের তাদের অবস্থানে যেতে কি পরিমাণ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তা তারা বিবেচনায় আনতে পারেন না। তদুপরি, প্রফেসরকে দেখাতে হবে এমন কোন কথা আছে কি? এসোসিয়েট প্রফেসর, এসিসটেন্ট প্রফেসর, কনসালটেন্ট যার কাছেই যান না কেন তারা এত বেশী অযোগ্য না যে আপনার সমস্যা বুঝতে পারবে না। বরং তাদের রূগী কম হওয়ায় তারা আপনাকে সময় বেশী দিতে পারবেন। আপনার কথা ধৈর্য্য ধরে শুনতে পারবেন। অর্থাৎ, এখানে সমস্যাটা জানার সীমাবদ্ধতার, বিশ্বাসহীনতার, অসচেতনতার।

একজন প্রফেসর হওয়া কি এতই সহজ? যে কয়জন প্রফেসরকে আমরা দৈনিক গড়ে ৫০-এর উপরে রূগী দেখতে দেখী তাদের সংখ্যা প্রফেসরদের মধ্যেও সীমিত এবং এরা প্রায় সবাই সরকারী ডাক্তার। কিন্তু প্রফেসর হওয়াটাই সময়সাপেক্ষ ব্যপার, দীর্ঘসূত্রিতার ব্যপার। আমি গত দিনের পোস্টে বলেছিলাম যে একজন সরকারী ডাক্তারের এমডি, এমএস বা এফসিপিএস ডিগ্রী অর্জন করতে ন্যূনতম ১৪ বছর লেগে যায়(এটি একটি হিসেব, বাস্তবে নানাবিধ জটিলতার কারণে সময় লাগে আরও বেশী)। অথচ, এই ডিগ্রী অর্জন ছাড়া একজন ডাক্তার কনসালটেন্ট পদে প্রমোশন পায় না। এমনকি, কতবছর ধরে সরকারী চাকুরী করছে তার উপর ভিত্তি করে, অনেক স্নাতোকত্তোর ডিগ্রীধারী ডাক্তাররাও প্রমোশন পায় না। উদাহরণস্বরূপ, সাতাশ বিসিএস ক্যাডাররা জয়েন করেছেন ২০০৮-এ। আজ ছয় বছর পেরিয়ে গেছে, এখনো অনেকেই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স-এ আটকে আছেন। ৫০% ক্যাডারের ডিগ্রী শেষ হলেও প্রমোশন হচ্ছে না জুনিয়র বিসিএস হওয়ার। এ ধরনের ঘটনা ডাক্তারদের জন্য বেশ ডিমোরালাইজিং। কনসালটেন্ট হওয়ার পর চাকুরীর অভিজ্ঞতার আলোকে এসিসটেন্ট প্রফেসর, এসোসিয়েট প্রফেসর ইত্যাদি পথ পেরিয়ে তারপর প্রফেসর হতে হয়। ফলে, প্রফেসর চিকিৎসক হতে গিয়ে বয়স কমপক্ষে ৫০ পেড়িয়ে যায়। তবে, অনেক ডাক্তার এত দূর যেতে পারেন না। তারপরও যে ডাক্তার এত পথ পাড়ি দিয়ে প্রফেসর হলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তিনি তার যোগ্যতার বলেই হন। যোগ্যতা এবং মেধার বিনিময় নেয়ার অধিকার তার আছে।

সাধারণ মানুষদের আরেকটি অভিযোগ হল অনেক ডাক্তারের মনোভাব ব্যবসায়ী হয়ে পড়ে। আমার ধারণা এটা মনে হওয়ার অন্যতম কারণ অল্প সময়ে রূগী দেখা, রূগীর কথা না শোনা। কিন্তু ডাক্তারদের এই সময় সংকোচনের পেছনে মানুষেরও-তো দায় আছে। তাদের কি শুধু প্রফেসরদের কাছেই যেতে হবে। হ্যাঁ, কিছু ডাক্তার আক্ষরিক অর্থেই ‘পুরোপুরি ব্যবসায়ী’ হয়ে যায়, যেটা কখনই কাম্য নয়। এটাকে আমি জাস্টিফাই করছি না তবে এর কারণ হিসেবে ডাক্তারদের দীর্ঘ অপ্রাপ্তি, ফ্রাস্টেশনের দায় আছে বলে মনে করছি।

আরও কিছু অভিযোগ আছে ‘ক্লিনিক’, ‘কমিশন’ ইত্যাদি বিষয়ে। ক্লিনিকের সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন করার সম্পূর্ণ সুযোগ আছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্লিনিক ডাক্তারদের দেয়া না, এটা মাথায় রাখা দরকার। বরং ক্লিনিকে যেই ডিউটি ডাক্তাররা কাজ করেন তারা ক্লিনিক কতৃপক্ষের কাছে জিম্মী থাকেন। ক্লিনিকে রূগী পাঠান ‘গ্রাম্য ডাক্তাররা’, তারা এর বিনিময়ে ক্লিনিকের কাছ থেকে কমিশন পান। ক্লিনিকের মালিক মুনাফার জন্য ডাক্তারদের অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষানিরীক্ষা দিতে বাধ্য করেন। ডাক্তাররাও জিম্মী। কারণ এখানে যাচ্ছে অবৈতনিক প্রশিক্ষনার্থী ডাক্তাররা তাদের জীবিকার জন্য। ক্লিনিক কতৃপক্ষের সাথে বাকবিতণ্ডায় গেলে তারা চাকুরী হারাবেন। আর কেউ একবার চাকুরী পেলে ছাড়তে চান না। কারণ অনেক তরুণ ডাক্তার এই অল্প বেতনের চাকুরীতে প্রবেশের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকেন।

‘কমিশন’ বিষয়টা চালুর পিছনে দায়ী প্রতিযোগীতামূলক ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ব্যবসায় এবং কিছু ডাক্তারদের লোভ ও ক্ষোভ। এ বিষয়টি এখন এত বেশী স্বাভাবিক হয়ে পড়েছে তথা হেল্দ-সিস্টেমের সাথে মিশে গেছে যে, যারা কমিশন নিতে আগ্রহী নন তারাও অনেক সময় বাধ্য হয়ে পড়েন। তবে এর পেছনে একদল ডাক্তারের পুঁজিবাদী মন মানসিকতা, লোভ ও স্বার্থপরতা দায়ী তা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে এটাতো সব মানুষের ক্ষেত্রেই সাধারণ সমস্যা। কিছু মানুষের অতিরিক্ত লোভ পুঁজিবাদী অর্থণীতিতে অনেক মানুষকে ভোগায়। এই কিছুর মধ্যে ডাক্তারদের একটি অংশ আছে। ‘কমিশন’ সিস্টেম দূর করতে হলে লাগবে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যনীতি নির্ধারকদের সদিচ্ছা। ডাক্তারদের উপযুক্ত সম্মানী দেয়া, উপজেলা পর্যায়ে ডাক্তারদের পেশাগত মর্যাদার উপযুক্ত স্বীকৃতি দেয়া, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ইত্যাদি উপায়ে। আর লোভ, স্বার্থপরতা দূর করে মানবিকতা তৈরী করতে হলে মূল্যবোধের শিক্ষা কতটা গুরুত্বপূর্ণ বলা বাহুল্য।

সুতরাং, ডাক্তারদের ‘কসাই’ উপাধীর ব্যবচ্ছেদ করে আমরা কয়েকটি পরস্পরজড়িত সমস্যা পেলাম। লক্ষ্যণীয়, স্বাস্থ্যনীতিতে শক্তিশালী রেফারেল সিস্টেম চালু থাকলে ডাক্তার-রূগী দু’দিক থেকেই অপ্রাপ্তি কমে আসতো। তারপরও একজন ডাক্তার হিসেবে সাধারণ মানুষদের কাছে অনুরোধ থাকবে, আপনারা ডাক্তার বলতে শুধ প্রফেসরদের বুঝবেন না এবং ডাক্তারদের মেধা ও পরিশ্রমের মূল্যায়ন করবেন, তাহলে দেখবেন তাদের ‘কসাই’ বলে উপাধি দেয়ার আগে আপনার জিহবাটা বেঁধে আসছে।

ডক্টরস ডেস্ক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

প্রসংগ ক্যারিঅন প্রথা

Fri May 23 , 2014
অনেকদিন ধরেই ক্যারি অন সিস্টেম এবং এবছর থেকে চালু হওয়া মেডিকেলের নতুন কারিকুলাম নিয়ে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে । অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে দলিল হাতে পেয়েছি। কিন্তু কপি দেওয়া হয় নি! সবার সুবিধার্থে নিয়মগুলো বলছি। এগুলোর উৎস MBBS Curriculum 2012 (September) যা বর্তমান সেশন তথা ২০১৩-১৪ এর জন্য প্রযোজ্যঃ ১। ১ম বৃত্তিমূলক […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo