কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প || পর্বঃ২১

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, শনিবার

অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া
চিকিৎসক, কাউন্সিলর, সাইকোথেরাপি প্রাকটিশনার,
ফিনিক্স ওয়েলনেস সেন্টার বাংলাদেশ।

মেয়েটির বয়স অল্প। চেম্বারে এসেছে, সাথে স্বামী। প্রারম্ভিক কুশলাদির পরে বললাম, “কথা কিন্তু আমি ওনার সাথে একা বলবো।”

ভদ্রলোক ওয়েটিং এরিয়াতে বসতে যেয়ে ইশারায় আমাকে বললেন, “আমি যদি আপনাকে না জানাই আপনি চিকিৎসা কিভাবে শুরু করবেন? বুঝবেন না, ও তো আপনাকে সব সত্যি কথা বলবে না।”

আমি বললাম, “আগে ওর কথা শুনব, সমস্যা যেহেতু তাঁর তাই অন্যের কাছে কিছু শুনলে বায়াসড হব হয়তো।”

তির তির করে কাঁপছে মেয়েটার চোখের পাতা। চোখে চোখে রাখছে না। এসি চলছে। তার মধ্যেও ঘেমে-নেয়ে একসা।

আমি বললাম, “ফ্যান চালাব?”
আলতো করে মাথা নেড়ে সায় দিল।
আমি বললাম : “পানি খাবেন?”
মেয়েটি বললো : “খেয়ে এসেছি।”
আমি বললাম, “আপনাকে আমি কথা দিচ্ছি আপনার কনফিডেনশিয়াল কথা আমি জানাবো না। আপনি কি নিজে এসেছেন নাকি আপনাকে জোর করে এনেছে?”
চোখের পাপড়ির কাঁপন দ্রুততর হচ্ছে।
আমি বললাম, “চা খাবেন?”
মেয়েটি বললো, “খাই না।”
আমি বললাম, “কখনোই খান না?”
মেয়েটি বললো, “আগে খেতাম, এখন খাই না ফালতু খরচ করে কি লাভ?”
আমি, “আসেন আমরা চা খেতে খেতে গল্প করি, সময় পার হলে আপনি বের হয়ে যাবেন।”
মেয়েটির প্রথমবারের মতন আমার চোখে চোখে তাকালো। বেশ অনেকক্ষণ চোখে চোখ রাখল। আমি হাসলাম।

তারপর বললাম, “এখানে যারা আসেন আমি সবার কথা শুনি, কেউ আমার কথা শোনেন না, নিজের কথা বলতে ব্যস্ত, আজকে আমার ভীষণ মন খারাপ,
শুন্য থেকে দশ গুণলে আজ দশে দশ মন খারাপ। মজার কথা হলো, দশে ছয় পর্যন্ত শোনানোর মানুষ আছে। তারপর আমি আর কিছু বলতে পারি না। আপনি সম্পূর্ণ অপরিচিত হলেও, আপনাকে বলতে ইচ্ছা করছে। এই প্রথম কেউ আমার এত বেশি মন খারাপের কথা শুনছে, তাই আপনার সম্মানটা আমি রাখবো, ভয় পাবেন না।”

মেয়েটি কেঁদে ফেলল। আস্তে আস্তে মুখ খুলল। শ্বশুরবাড়ির দেয়া প্রচন্ড মানসিক নির্যাতনে Post traumatic stress disorder (PTSD) তৈরি হয়। নিজের অপ্রাপ্তির বঞ্চনায় ইমোশনকে কন্ট্রোল করতে না পেরে এরপর যাচ্ছে তাই ভাবে রাগারাগি, বিশ্রী ভাষায় চিল্লাচিল্লি, তুচ্ছ কারণে ভাঙচুর এমনকি কান্নাকাটিসহ অনেক কিছুই করে।

তারপর সেই কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প-

ছবিঃ কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প।

মানুষ যখন তার আসল অনুভূতিটা প্রকাশ করতে পারে না তখন অন্য কোন একটা অনুভূতি দিয়ে নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করে। মেয়েটা ছিল প্রচণ্ড দুঃখী। কারণ তার স্বামী নিজের মা, বোনের প্রতিটি কথায় কথায় বিশ্বাস করত। মেয়েটিকে শোধরাতে চেষ্টা করত। স্ত্রীর অযত্ন কিন্তু স্বামীটি কখনোই করেননি। ফলে মেয়েটির বাপের বাড়িতেও একসময় বলে, “স্বামীতো ভালোবাসে তবে এত সমস্যা কেন?” বন্ধুদের সাথে বহু আগে থেকেই বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছে বিয়ের পরে পরেই। ধীরে ধীরে মেয়েটি যতই চেষ্টা করতে থাকে শ্বশুরবাড়িতে এডজাস্ট করবার, তার প্রতিটি অসফল প্রচেষ্টা তার ভেতরে মিসিং একসেপ্টেন্স তৈরি করতে থাকে। ধীরে ধীরে বৈরিতা বাড়তে থাকে। একটা সময় তার মনে হতে থাকে এই ঘর সংসার, এই স্বামী, কিছুই তার আপন নয়। এত অল্প বয়সে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, মাইগ্রেইন, কোমরের ব্যথা, কপালের বলিরেখা, চুল পাকা সবকিছু নিয়ে জবুথবু হয়ে যায়। তার উপরে ইদানীং যুক্ত হয়েছে মেয়েটাকে পাগল বলা। শাশুড়ি বলা শুরু করেছে, “পাগলের সাথে ঘর সংসার করা ধর্মীয়ভাবে নীতিবিরুদ্ধ।”

ছবিঃ প্রতীকী।

নির্দিষ্ট সময় শেষে আমি স্বামীকে ডেকে মেয়েটির সামনে বললাম, “মানুষের শরীর যখন আইসিউতে যায়, সেটা সবাই দেখতে পায়। কিন্তু মনটা আইসিউতে গেলে সেটা বোঝানো যায় না। এই মেয়েটা মনে মনে মারা যাচ্ছে। মেয়েটা মানসিকভাবে অসুস্থ না। সমাজের যেটা পাগল বলে লেবেলিং করে সেটা অবশ্যই আমি করবো না। ও শুধু আর নিতে পারছে না। তাই আইসিইউ রোগীর যেমন যত্ন দরকার ডাক্তার, নার্স, বাড়ির মানুষ সবার মিলিয়ে, তেমনি এই মেয়েটার যত্ন দরকার আপনার, আমার, বাড়ির মানুষ সবার সহযোগিতা মিলিয়ে। ওকে বেশ কিছু দিন আমার কাছে আসতে হবে যদি তার মন চায় এবং প্রতিবারই আমি একা কথা বলবো। সাথে যেটা না বললেই নয় সেটা হল অবশ্যই আপনাকে ধন্যবাদ কারণ আপনি ওকে আমার কাছে নিয়ে এসেছেন প্রফেশনাল সাহায্যের জন্য, ওকে সিদ্ধান্ত নিতে দিন প্রথম দিনের পরে আমাকে বাদ দিয়ে ও যদি অন্য কারো সাথে কথা বলতে চায় আমি রেফার করে দেবো তবে কারো না কারো কাছে যাওয়াটা ওর জরুরি।”

হত্যাকাণ্ড দু’রকম হয়। একটি শারীরিক যার প্রকাশ্য শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। আরেকটি মানসিক, যার কুশীলবরা পর্দার অন্তরালে ভালো মানুষের মুখোশ পরে সমাজে ঘুরে বেড়ায়। আপনার আমার সাথে চা খেতে খেতে গল্প করে। যারা মানুষকে মানসিকভাবে অত্যাচার করতে করতে অদৃশ্যভাবে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেন না তাঁদের জন্য অনেক ভালোবাসা আর সম্মান।

Sadia Kabir

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

করোনায় আক্রান্ত হয়ে নর্দান মেডিকেলের এনেস্থেসিওলজি বিভাগের অধ্যাপকের মৃত্যু

Sat Feb 13 , 2021
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১, শনিবার কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে শহীদ চিকিৎসকদের মিছিলে যুক্ত হলেন দেশের আরো এক চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. মাহমুদুর রহমান লাইজু, এনেসথেসিওলজি বিভাগ, নর্দান মেডিকেল কলেজ।(ইন্না-লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি র’জিউন)। গতকাল ১২ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর ল্যাব এইড হাসপাতালে কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo