করোনার বিপক্ষে যুদ্ধ- নেতৃত্বহীন মানব সম্প্রদায়

১৮ মার্চ ২০২০:
য়্যুভাল নোয়াহ হারারি
অনুবাদঃ ডা. মানিক চন্দ্র দাস

করোনা ভাইরাস এখন পৃথিবীতে ছড়িয়ে গেছে। হয়ে গেছে এপিডেমিক, এর দায় অনেকেই বিশ্বায়ন এর ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চাচ্ছেন এবং বলতে চাচ্ছেন সারা পৃথিবীতে এরকম রোগ বিস্তার শুধুমাত্র “বিশ্বায়ন” বন্ধ করে দিলেই সম্ভব। দেয়াল বানাও, লোকজনের চলাচলের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করো, ব্যবসা বন্ধ করো। শর্ট টার্ম কোয়ারেন্টাইন এপিডেমিক বা মহামারী আটকানোর ক্ষেত্রে জরুরী, কিন্তু লম্বা সময়ের জন্য কোয়ারেন্টাইন কোন কাজের কথা না। লম্বা সময় মানুষের এরকম পরস্পরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকাটা অর্থনৈতিক ধ্বস ছাড়া সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে কোন সত্যিকারের সুরক্ষা দেবেনা। বরং করতে হবে এর উল্টোটা। এই ধরনের এপিডেমিক বা মহামারী মোকাবেলার আসল অস্ত্র পৃথকীকরণ নয়, অস্ত্র হচ্ছে সহযোগীতা।

বর্তমান যুগের এই বিশ্বায়নের আগেও মহামারীতে কোটি কোটি মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। চতুর্দশ শতাব্দীতে বিমান বা কোন ক্রুজশিপ ছিলোনা কিন্তু তাও ব্ল্যাক ডেথ পূর্ব এশিয়া থেকে পশ্চিম ইউরোপ পর্যন্ত ছড়িয়েছে মোটামুটি এক দশকের মাঝেই। ওতে মৃত মানুষের সংখ্যাটা ৭৫ মিলিয়ন থেকে ২০০ মিলিয়নের মাঝে-ইওরোশিয়া এলাকার মোটামুটি চার ভাগের এক ভাগ মানুষ। ইংল্যান্ডে মারা গিয়েছিলো প্রতি দশজনের চারজন। ফ্লোরেন্সে ১ লাখ মানুষের মাঝে মারা গিয়েছিলো ৫০ হাজার মানুষ।

১৫২০ এর মার্চে ‘ফ্রান্সিসকো দ্য এগ্যুইয়া’- নামেন মেক্সিকো তে। লোকটা ছিলো স্মলপক্সের ক্যারিয়ার, এই একজন মাত্র মানুষ তখন মেক্সিকোতে স্মলপক্স নিয়ে গিয়েছিলেন। ঐ সময় সেন্ট্রাল আমেরিকায় কোন ট্রেন, বাস কিংবা গাধাও ছিলোনা। তাও মোটামুটি ডিসেম্বরের মাঝে গোটা সেন্ট্রাল আমেরিকা ‘স্মলপক্স’ একদম লন্ডভন্ড করে ফেললো, কিছু সূত্রানুসারে জানা যায় মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ মানুষ মারা গিয়েছিলো তখন।

১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লু মাত্র কয়েকমাসের মধ্যে গোটা পৃথিবীর একেবারে দুর্গম জায়গাতেও পৌঁছে গিয়েছিলো। হাফ বিলিয়ন মানুষ ওতে আক্রান্ত হয়-সংখ্যাটা হচ্ছে ঐ সময়ে পৃথিবীতে বসবাসকারী মানুষের মোট সংখ্যার চার ভাগের এক ভাগেরও বেশি।

তথ্যসূত্রানুযায়ী ভারতবর্ষের মোট জনসংখ্যার ৫ শতাংশ মানুষ এই ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। তাহিতি দ্বীপে মারা গিয়েছিলো মোট জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ এবং সামোয়াতে ২০ শতাংশ মানুষ। সব মিলিয়ে এই প্যানডেমিকে দশ মিলিয়নের বেশী-সম্ভবত সংখ্যাটা ১০০ মিলিয়ন এর কাছাকাছি- মানুষ মারা গিয়েছিলো এক বছরেরও কম সময়ে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ চার বছরের ধ্বংসযজ্ঞেও এতো মানুষ মারা যায়নি।

১৯১৮ সালের পর পেরিয়েছে এক শতক, এই সময়ে মানব প্রজাতি মহামারীর সামনে আরো খোলামেলা হয়ে পড়েছে। কারণ, বাড়ছে মানুষের সংখ্যা আর যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতিও হয়েছে চরম মাত্রায়। প্যাথোজেনিক ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার জন্য আধুনিক মেট্রোপলিটন সিটি টোকিও বা মেক্সিকো সেই মধ্যযুগের ফ্লোরেন্সের চাইতে শিকারের লোভনীয় জায়গা। তার উপর এখনকার গ্লোবাল ট্রান্সপোর্ট সেই ১৯১৮ সালের চাইতে অনেক বেশি দ্রুতগতির। তাই বলা যায় আমরা আসলে সংক্রামক রোগের এক নরকের মাঝে আছি, যেখানে প্লেগের মতো একটার পর আরেকটা মহামারী আসতেই থাকবে।

যাই হোক, মহামারীর প্রকোপ এবং এর প্রভাব আসলে কমেছে অনেকখানি। একবিংশ শতাব্দীতে এইডস এবং ইবোলা ভাইরাস মহামারীর চেহারা নিলেও সেই আগের মতো এতো পরিমানে মানুষ মেরে ফেলতে পারছেনা। এর কারনটা হচ্ছে জীবানুর বিরুদ্ধে মানুষের হাতে এখন যে অস্ত্রটি আছে তা আইসোলেশন নয়-অস্ত্রের নাম ইনফরমেশন, তথ্য। মানব সভ্যতা এখন মহামারীর বিরুদ্ধে জিতে যাচ্ছে কারন, এই জীবানু আর চিকিৎসকদের মধ্যকার যুদ্ধে জীবানুরা অন্ধের মতো নির্ভর করে মিউটেশন এর উপর আর চিকিৎসকেরা নির্ভর করেন ইনফরমেশন বা তথ্যের সায়েন্টিফিক অ্যানালাইসিস এর উপর।

জীবানুর বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়

চতুর্দশ শতাব্দীতে যখন ব্ল্যাক ডেথ পৃথিবীতে আঘাত করে, মানুষের কোন ধারণাই ছিলোনা এর কারণ কী, এর বিরুদ্ধে কি করা যায়। এখনকার আধুনিক যুগের আগে মানুষ রোগের কারণ হিসেবে দায় চাপাতো দেবতার রাগ, খারাপ আত্মা কিংবা মন্দ বাতাসের উপর। ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস যে এর পেছনে মূল কারণ হতে পারে, সে সম্পর্কে তাদের বিন্দুমাত্র ধারণা ছিলো না। মানুষ তখন ভূত-প্রেত, পরী, দানব এসবে বিশ্বাস করতো, তাদের কল্পনাতেও ছিলোনা যে জলের ছোট একটা ফোঁটায় কি ভয়াবহ এক পৃথিবী দানব থাকতে পারে। এ কারণে যখন ব্ল্যাক ডেথ বা স্মলপক্স এলো, সেটা ঠেকানোর জন্য কর্তৃপক্ষের মাথায় এলো নানা দেবতার কাছে প্রার্থনার কথা। ব্যাবস্থা করা হলো সমবেত প্রার্থনার। তাতে কোন সমাধান অবশ্য হয়নি। হয়েছে উল্টোটা। যখন মানুষ এক জায়গায় জমায়েত হয়েছে প্রার্থনার জন্যে, জীবানু আরো দ্রুত ছড়িয়েছে, বিস্তার হয়েছে সংক্রমনের।

গত শতাব্দীতে গোটা পৃথিবী জুড়ে বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, নার্সেরা এ ধরনের মহামারীর বিষয়ে তথ্য জোগাড় করে একসাথে বোঝার চেষ্টা করেছেন মহামারীর কারণটা কি এবং এর বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া যায়। বিবর্তনবাদ দিয়ে খুব ভালোভাবে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে কীভাবে নতুন নতুন রোগের উদয় হচ্ছে আর পুরোনো রোগগুলো ফিরে আসছে আরো শক্তিশালী হয়ে। জিনেটিকস এর কারনে বিজ্ঞানীরা এখন জীবানুদের নিজস্ব ইনস্ট্রাকশন ম্যানুয়ালের উপর নজরদারী করতে পারছেন। যেখানে মধ্যযুগের মানুষ জানতোই না ব্ল্যাকডেথের কারণটা কি, আর সেখানে এখনকার বিজ্ঞানীরা দু হপ্তার মাঝে নোভেল করোনা ভাইরাস সনাক্ত করেছেন, এর জিনোম সিকোয়েন্সিং করে ফেলেছেন এবং আক্রান্ত মানুষকে সনাক্ত করার একটা নির্ভরযোগ্য পরীক্ষাও বের করে ফেলেছেন।

যখনই বিজ্ঞানীরা ধরে ফেলছেন মহামারীর কারণটা কী, তখনই এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাটা সহজ হয়ে যাচ্ছে। টীকা দান কর্মসূচী, অ্যান্টিবায়োটিক, উন্নত পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকার অভ্যাস এবং আগের চাইতে উন্নত মেডিকেল ইনফ্রাস্ট্রাকচার অদৃশ্য শত্রুর হাত থেকে বাঁচিয়ে দিচ্ছে। ১৯৬৭ সালের দিকেও স্মলপক্সে ১৫ মিলিয়ন মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলো এবং মারা গিয়েছিলো ২ মিলিয়ন মানুষ। এর পরের দশকে সারা পৃথিবী জুড়ে স্মলপক্সের বিরুদ্ধে টীকাদান কর্মসূচী চললো পুরোদমে। পুরো কর্মযজ্ঞ এতোটাই সফল হয়েছিলো যে ১৯৭৯ সালে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন ঘোষণা দিয়ে ফেললো যে স্মলপক্সের বিপক্ষে মানবতার জয় হয়েছে। জিতে গেছে মানুষ। পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় নিয়েছে স্মলপক্স। তারপর থেকে ২০১৯ পর্যন্ত একজন মানুষও স্মলপক্সে সংক্রমিত বা মারা যায়নি।

করোনা সংকট মহামারীর বিষয়ে ইতিহাস আমাদের কি শিক্ষা দেয়?

প্রথমত, পাকাপাকি ভাবে বর্ডার আটকে দিয়ে আপনি নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে পারবেন না। মনে রাখতে হবে, বিশ্বায়নের বহু আগে, সেই মধ্যযুগেও মহামারী খুব দ্রুত ছড়িয়েছে। তাই, সেই ১৩৪৮ সালে ইংল্যান্ড যেমন মহামারী ঠেকাতে ঠাস করে সমস্ত পৃথিবীর সাথে সকল ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলো-সেরকম কিছুতে কোন কাজ হবেনা। নিজেকে বাঁচাতে শুধু আইসোলেশনের মতো মধ্যযুগীয় পন্থায় ফিরে গেলে হবেনা। যেতে হবে একেবারে প্রস্তর যুগে। তা কি করা সম্ভব?

দ্বিতীয়ত, ইতিহাস বলে, মানব সম্প্রদায়ের নিজেদের মাঝে নির্ভরযোগ্য বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য আদানপ্রদান ও বৈশ্বিক সংহতির মধ্য দিয়ে আসে সত্যিকারের সুরক্ষা। যখন কোন রাষ্ট্র মহামারীতে আক্রান্ত হয় তখন নিজেদের কোনরকম অর্থনৈতিক ধ্বসের ভয় না করে তাদের উচিৎ মহামারী বা রোগ সম্পর্কে অন্য রাষ্ট্রের সাথে সৎ ভাবে তথ্য ভাগাভাগি করা- যাতে অন্য রাষ্ট্রগুলো ভাগ করা তথ্য বিশ্বাস করতে পারে, ব্যবহার করতে পারে এবং রোগাক্রান্তকে বহিষ্কারের বদলে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারে। আজ, চীন করোনা ভাইরাস সম্পর্কে বিশ্বের অন্য দেশগুলোকে নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শেখাতে পারে, সমস্যা হচ্ছে বিষয়টা খুবই উঁচুমাত্রার আন্তরাষ্ট্রীয় বিশ্বাস এবং সহযোগীতার দাবী রাখে।

কার্যকর একটা কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা গড়ে তুলতেও দরকার আন্তর্জাতিক বা আন্তরাষ্ট্রীয় সহযোগীতা। কোয়ারেন্টাইন এবং লক-ডাউন মহামারী আটকানোর জন্য খুবই জরুরী। কিন্তু যখন একটি রাষ্ট্র আরেকটি রাষ্ট্রকে বিশ্বাস করে না, মনে করে ওর সমস্যা ওই সামলাক, তখন এ ধরনের শক্তিশালী সিদ্ধান্ত নিতে রাষ্ট্রের সরকার দোটানায় পড়ে যায়। যদি আপনি আপনার দেশে ১০০ করোনা আক্রান্ত রোগী পেয়ে যান, সাথে সাথে ঐ এলাকা বা বিভাগ কি লক-ডাউন করে দেবেন? বিষয়টা বড় করে দেখলে দেখা যায়, সিদ্ধান্তটা নির্ভর করছে আপনি অন্য রাষ্ট্রগুলোর কাছে কি আশা করছেন তার উপর। নিজের দেশের একটা শহর পুরোপুরি লক-ডাউন ডেকে আনতে পারে অর্থনৈতিক বিপর্যয়। যদি আপনি মনে করেন অন্য রাষ্ট্রগুলো তখন এগিয়ে আসবে আপনার পাশে- তখন এই তড়িৎ পদক্ষেপটা নিতে আপনি বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবেন না। কিন্তু যদি ভাবেন অন্য দেশগুলো এগিয়ে আসবেনা বা আপনাকে সাহায্য করবে না, সিদ্ধান্ত নিতে দেরী হবে- ততক্ষনে হয়তো অনেক দেরী হয়ে যাবে।

এ ধরনের মহামারীতে একটা খুব জরুরী বিষয় লোকজনের বোঝা উচিৎ, মহামারী কোন একটি রাষ্ট্রে হওয়া মানে গোটা মানব প্রজাতিই বিপদের মুখে। কারণ হচ্ছে ভাইরাসেরা বদলায়। করোনার মতো ভাইরাসের শুরুটা হয় প্রাণীতে, যেমন বাদুর। যখনই এরা মানুষের শরীরে প্রবেশ করে, শুরুর দিকে মানুষের শরীরে এদের খাপ খাওয়াতে কষ্ট হয়। মানুষের শরীরের ভেতর বংশবৃদ্ধি করার সময় এদের সাধারনত মিউটেশন হয়। বেশিরভাগ মিউটেশনই ক্ষতিকারক না, নির্বিষ ধরনের। কিন্তু এর মাঝেই কোন একটা মিউটেশন ভাইরাসকে অনেক বেশি সংক্রামক এবং মানুষের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ইমিউন সিস্টেম প্রতিরোধী করে তোলে- এই মিউট্যান্ট স্ট্রেইনটাই মানুষের মধ্যে তখন দ্রুত ছড়াতে থাকে। একজন মাত্র মানুষের ভেতর ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ভাইরাস পার্টিকেল অনবরত বংশবৃদ্ধি করতে পারে, প্রতিটি সংক্রমিত মানুষ তাই ভাইরাসকে ট্রিলিয়ন সংখ্যক নতুন নতুন সুযোগ করে দেন মানুষের শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থার সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকার রাস্তা তৈরী করে দেয়ার জন্য। প্রতিটি সংক্রমিত মানুষ তখন ভাইরাসের জন্যে একটা জুয়ার যন্ত্র যেখান থেকে তাকে লটারীর ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন টিকিট দেয়া হচ্ছে-এই ট্রিলিয়ন লটারী টিকিট থেকে ভাইরাসের টিকে থাকার জন্যে প্রয়োজন মাত্র একটা টিকিট। একটা বিজয়ী টিকিট।

যা বললাম তা কিন্তু কোন জল্পনা নয়। রিচার্ড প্রেসটন তাঁর ‘ক্রাইসিস ইন দ্য রেড জোন’ বইতে ২০১৪ সালে ইবোলা আউটব্রেক সম্পর্কে ঠিক এ ধরনের কিছু ঘটনার কথা বলেছেন। আউটব্রেকের শুরুটা হয়েছে যখন ইবোলা ভাইরাস বাদুড় থেকে মানুষের শরীরে ঢুকেছে। এই ভাইরাস মানুষকে ভয়াবহ অসুস্থ বানিয়ে ফেলতো কিন্তু তখনও তারা মানুষের শরীরের চাইতে বাদুড়ের শরীরে থাকার জন্যে বেশী মাত্রায় অভিযোজিত। মানুষের শরীরে খুব একটা সুবিধা করতে না পারা, খুবই অপ্রতুল ইবোলা ভাইরাস তাহলে কি করে একটা মহামারী তৈরী করে ফেললো? পশ্চিম আফ্রিকার মাকোনার কোন এক জায়গায় সংক্রমিত একজনের মধ্যে ইবোলা ভাইরাসের একটা সিঙ্গেল জিনে একবারের একটা মিউটেশনে হয়েছে এতো কীর্তি। সেই মিউটেশনে তৈরী হওয়া নতুন ইবোলা স্ট্রেইন- নাম মাকোনা স্ট্রেইন এ দেখা গেলো এরা মানুষের শরীরের কোষের কোলেস্টেরল ট্রান্সপোর্টার ভুল তথ্য দেয়া শিখে গেছে। ট্রান্সপোর্টার তখন কোলেস্টেরল এর বদলে ইবোলার মাকোনা স্ট্রেইনকে কোষের ভেতরে নেয়া শুরু করে দিলো। এই মাকোনা স্ট্রেইন ছিলো স্বাভাবিক ইবোলা ভাইরাসের চাইতে মানুষের জন্য চারগুন বেশি সংক্রামক।

আপনি যখন এই লাইনটা পড়ছেন, তখনই হয়তো তেহরান, মিলান বা উহানে সংক্রমিত কোন মানুষের ভেতর করোনা ভাইরাসের কোন একটা সিঙ্গেল জিনে এরকম একটা মিউটেশন হচ্ছে। যদি আসলেই তা হয়, হুমকি টা কিন্তু শুধুমাত্র ইরানি, ইটালিয়ান বা চাইনিজদের জন্য নয়, হুমকিটা আপনার নিজের জন্যেও। সারা বিশ্বের মানুষের মরা-বাঁচার প্রশ্নে লড়াইটা হচ্ছে করোনা ভাইরাসকে এরকম কোন সুযোগ দেয়া যাবে না। এর অর্থটা খুব সহজ, প্রতিটি দেশের প্রতিটি মানুষকে আমাদের রক্ষা করতে হবে।

১৯৭০ সালে স্মলপক্সকে মানব সম্প্রদায় হারিয়ে দিতে পেরেছিলো, এর কারণ হচ্ছে পৃথিবীর সমস্ত দেশের প্রতিটি মানুষকে স্মলপক্সের টীকা দেয়া হয়েছিলো। তখন যদি একটি দেশও তার সাধারণ জনগনকে টীকা দিতে ব্যর্থ হতো, বিপদে থাকতো গোটা মানব প্রজাতিটাই। কারন যতোদিন স্মলপক্স ভাইরাস টিকে থাকবে, কোথাও না কোথাও এর বিবর্তন হবেই, ছড়িয়ে পড়তে পারে আবারও বিশ্বের সবখানে।

ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মানব সম্প্রদায়ের উচিৎ খুব সাবধানে সীমানা পাহারা দেয়া। দুই দেশের মাঝের সীমানা না, মানব সম্প্রদায় আর ভাইরাস সম্প্রদায়ের সীমানা। পৃথিবী নামের এই গ্রহে আছে অগনিত প্রজাতির ভাইরাস, এদের অনবরত জিনগত মিউটেশন হচ্ছে। মানব সম্প্রদায় আর ভাইরাস সম্প্রদায়ের মাঝে যে সীমানাটা রয়েছে তা প্রতিটা মানুষের শরীরের ভেতরে রয়েছে। পৃথিবীর কোথাও যদি একটা বিপদজনক ভাইরাস এই সীমানা অতিক্রম করে মানুষের শরীরে ঢুকে যায়, বিপদে তখন গোটা মানব প্রজাতি।

গত শতাব্দীতে মানুষ এই সীমানাকে নজিরবিহীন ভাবে শক্তিশালী করেছে। আধুনিক স্বাস্থ্য ব্যাবস্থা এই সীমানায় কয়েক দফা দেয়াল তুলেছে আর বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, নার্সেরা ক্রমাগত পেট্রোলিং করে যাচ্ছেন, দেখছেন কেউ সীমানা অতিক্রম করে এদিকে ঢুকে পড়লো কিনা। যদিও এই সীমানার একটা বিশাল অংশ এখনো অরক্ষিত। সারা বিশ্বে এখনো কয়েকশো মিলিয়ন মানুষ আছেন যারা সাধারন ‘প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা’ থেকেও বঞ্চিত। এতে করে বিপদে আছি আমরা সবাই। ‘স্বাস্থ্য’ কথাটা আমরা এখনো বুঝি জাতীয় পর্যায়ে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বুঝে উঠতে পারিনি। একজন ইরানি বা চাইনিজ নাগরিকের জন্য ভালো স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিশ্চিত করার মানে হচ্ছে ওতে মহামারীর হাত থেকে ইসরাইলি বা আমেরিকান রাও রক্ষা পাবে। এই সহজ সরল সত্য কথাটা একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষটির ও বোঝা উচিৎ, কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে এই কথাটি পৃথিবীর কিছু খুব গুরুত্বপূর্ণ মানুষও বোঝেন না।

একটি নেতৃত্বহীন পৃথিবী

আজ মানব সম্প্রদায় করোনা ভাইরাসের কারনেই যে শুধু সংকট মোকাবেলা করছে তা কিন্তু না, এর জন্য দায়ী মানুষে মানুষে অবিশ্বাস। মহামারীকে হারাতে হলে, জনগনকে বিশ্বাস করতে হবে এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের, নাগরিকদের বিশ্বাস করতে হবে রাষ্ট্রযন্ত্রকে। গত কয়েক বছর ধরে কিছু দায়িত্বহীন রাজনীতিবিদ ইচ্ছাকৃতভাবে বিজ্ঞানের উপর বিশ্বাসকে খাটো করেছেন, রাষ্ট্রযন্ত্রকে দমিয়েছেন এবং আন্তঃরাষ্ট্রীয় সহযোগীতার ক্ষেত্রকে ছোট করেছেন। ফল হচ্ছে এ ধরনের সংকট আমরা একদম খোলাখুলি মোকাবেলা করার চেষ্টা করছি যখন নেতারা আমাদের উৎসাহিত কুরতে পারতেন, সংগঠিত করতে পারতেন, পারতেন অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে, বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়াকে চালিত করতে পারতেন সঠিক রাস্তায়।

২০১৪ সালের ইবোলা মহামারীর সময় আমেরিকা এরকম নেতৃত্বের জায়গায় ছিলো। ২০০৮ এর অর্থনৈতিক মন্দার সময়তেও সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে আমেরিকা। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে নেতৃত্বের জায়গা থেকে সরে এসেছে আমেরিকা। বর্তমান আমেরিকান প্রশাসন ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর থেকে সাহায্যের পরিমান ছেঁটে বাকী পৃথিবীকে পরিস্কার বুঝিয়ে দিচ্ছে যে আমেরিকার এখন আর কোন বন্ধু বলতে কিছু নেই- আছে স্বার্থ। করোনা সংকট যখন দেখা দিলো তখন আমেরিকা বসে সাইডলাইনে- সমাধানে তাদের নেতৃত্ব গ্রহনেরও খুব একটা ইচ্ছা নেই। নেতৃত্ব যদি আমেরিকা এখন নিতেও চায়, অন্যান্য দেশগুলোর আমেরিকান প্রশাসনের উপর বিশ্বাস এতোটাই ক্ষয়িষ্ণু যে তারা আদপেই আমেরিকাকে অনুসরন করবে কিনা সন্দেহ আছে। “আমিই আগে” এরকম দর্শন নিয়ে চলা কোন নেতাকে আপনি নিজেও কি মানবেন?

আমেরিকা যে শূন্যতা তৈরী করেছে তা কেউই পূরণ করেনি। হয়েছে উল্টোটা। ভিনদেশীদের অহেতুক ভয়, নিজেকে আলাদা করে রাখার চেষ্টা এবং অবিশ্বাস এখন বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক রীতির চরিত্র। বিশ্বাস এবং বৈশ্বিক সংহতি ছাড়া করোনা ভাইরাসের মতো মহামারী আমাদের পক্ষে ঠেকানো সম্ভব না বরং আরো ভয়াবহ কিছু মহামারী আমাদের জন্যে ভবিষ্যতে অপেক্ষা করছে। প্রতিটি সংকট আবার সম্ভাবনাও তৈরী করে। আশা করি এখনকার মহামারী নিজেদের মধ্যে বিভেদ যে আমাদের কতোটা দুর্বল করে দিচ্ছে তা বুঝতে সাহায্য করবে।

খুব বিশেষ কোন উদাহরন যদি যদি খুঁজতে বলা হয় তাহলে বলা যায় এই মহামারী ইওরোপিয়ান ইউনিয়নের জন্যে হতে পারে একটা সুবর্ন সুযোগ। যে সমর্থন তারা হারিয়েছিলো, এই মহামারী সামলে দিতে পারলে তার পুরোটাই উদ্ধার হয়ে যাবে। ইউনিয়নের কোন সদস্য দেশ যদি এখন খুব ক্ষতিগ্রস্থ কোন সদস্য দেশে অর্থ, চিকিৎসার যন্ত্রপাতি আর লোকবল পাঠিয়ে সাহায্য করে তাহলেই বোঝা যাবে ইউরোপের আদর্শ, দর্শন অনর্থক বক্তৃতার চাইতে অনেক বেশি কার্যকর। উল্টোদিকে যদি প্রতিটা রাষ্ট্র কে নিজের নিজের দেশই সামলাতে হয়, এই মহামারী হবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের জন্যে কফিনের শেষ পেরেক।

সংকটের এই মুহুর্তে, চূড়ান্ত সংগ্রামটা হচ্ছে মানুষে মানুষে। যদি এই মহামারী মানুষের সাথে মানুষের চরম অনৈক্য আর অবিশ্বাস তৈরী করে, জিতে যাবে ভাইরাসেরা। মানুষ যখন একা হবে- ভাইরাসেরা হবে দ্বিগুন। আবার এই মহামারীতে মানুষে মানুষে যদি সংহতি বাড়ে, বিজয় টা শুধু করোনা ভাইরাসের বিপক্ষে হবেনা- হবে ভবিষ্যতের সমস্ত জীবানুর বিরুদ্ধেও।

(এই অনুবাদটুকু বাংলাদেশে করোনা যুদ্ধে নামা ঢাল-তলোয়ার বিহীন ডাক্তার, নার্সদের জন্যে। এদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় হয়তো অনেকে বেঁচে যাবেন। অনেক ডাক্তারও এই যুদ্ধে চলে যাবেন আমাদের ছেড়ে, যেমনটা গিয়েছিলেন ডেঙ্গুর সময়।)

Platform

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

করোনা আউটব্রেক মোকাবেলায় বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যসেবকদের অভিবাদন

Wed Mar 18 , 2020
১৮.০৩.২০২০ চীনের উহান প্রদেশ থেকে ছড়িয়ে পড়া কোভিড-১৯ এখন মহামারীর রুপ নিয়েছে। এর সংক্রমণ রোধ করতে আয়োজনের কমতি নেই কিন্ত তবুও মানুষের জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত করে ফেলছে দিনদিন।কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে সামনে থেকে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদেরকে সমস্বরে অভিবাদন জানাচ্ছেন ইতালি,স্পেন এবং পর্তুগাল এর নাগরিকরা। কোয়ারেন্টাইনে থাকা ইতালীয় নাগরিকরা নিজ বেলকনি […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo