আত্মহত্যা সমাধান নয়, চাই সচেতনতা

প্ল্যাটফর্ম প্রতিবেদন, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২০, শুক্রবার

লেখাঃ ডা. মিনহাজুল আবেদীন
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ (৭ম ব্যাচ)

আমাদের মেডিকেলের লেকচার গুলোতে যখন রোল কল করা হত তখন একটা রোল সবসময়ই অ্যাবসেন্ট থাকতো। আমরা তাকে কখনোই দেখতে পাইনি। আমাদের বন্ধুরা কখনোই তার সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পায়নি। কারণ মেডিকেলের ক্লাস শুরুর আগেই সে সুইসাইড করেছিল। সুইসাইড করার কারণটা ছিল কিছুটা অদ্ভুত। যতদূর শুনেছি বাবার কাছে ল্যাপটপ চেয়েছিল। বাবা ল্যাপটপ কিনে দেয়নি। অভিমানে আত্মহত্যা।
আচ্ছা নিজেকে হত্যা করার জন্য সে কারণটা কি যথেষ্ট ছিল? অবশ্যই না।

কিছুদিন আগে ঢাবির ইমাম হোসাইন নামে একটা ছেলে সুইসাইড করেছে। কারণ ছিল প্রেমে ব্যার্থতা। যে মেয়েটির কারণে আত্মহত্যা করেছে তার সাময়িক কোন সমস্যা হবে কিনা জানিনা। তবে মেয়েটি আল্টিমেটলি তার পছন্দের মানুষকে নিয়েই বাকি জীবন কাটানোর চেষ্টা করবে।

স্ত্রীর প্রতারণার কারণে আত্মহত্যা করেছিল ডাক্তার আকাশ। এইতো গত বছরের ঘটনা। প্রতারণার অভিযোগে স্ত্রী মিতু কয়েকদিন জেলে থাকলেও অল্পকিছুদিনের মধ্যেই জামিন পেয়েছিলেন। হাইকোর্ট এর কৃপায় বহাল তবিয়তেই আছেন এখন। শুধু মাঝখান থেকে নাই হয়ে গেল ডা. আকাশ।

উপরে যাদের কথা বললাম এরা আত্মহত্যা করে কি পেয়েছে আসলে?

তাদের আত্নহত্যার জন্য কারণগুলো কি যথেষ্ট ছিল?

আচ্ছা, এরকম অগণিত আকাশ কিংবা ইমামদের সামনে কি আত্মহত্যা ছাড়া কোন পথই খোলা ছিলনা?

অবশ্যই ছিল। তবে সে পথটা খোঁজার জন্য যতটুকু ধৈর্য্য ধরার প্রয়োজন ছিল ততটুকু ধৈর্য্যের লিমিট তাদের ছিলনা। এই ধৈর্য্যের লিমিট সবার সমান হয়না। বিপত্তিটা ঠিক এখানেই। যাদের লিমিট বেশি তারাই টিকে থাকে,গেইনার হয় এবং ভাইস ভার্সা। এই লিমিট জিনিসটা কম থাকার কারনেই মূলত পৃথিবীতে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন মানুষ সুইসাইড করছে। আর বছরে ৮ লক্ষ। আমাদের দেশে প্রতিবছর ১০ থেকে ২০ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করছে অর্থাৎ প্রতিদিন ৩০ জনেরও বেশি মানুষ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সুইসাইড করছে। প্রকৃত সংখ্যাটা নাকি আরো বেশি হবে।

আচ্ছা, সুইসাইড করছে কারা? এরা তো আমাদের চারপাশেরই মানুষ। আর পেশাগত কারণে সম্ভবত চিকিৎসক সমাজে সুইসাইড প্রবণতা একটু বেশিই।

গত কয়েকদিন জীবনে কখনো না কখনো সুইসাইড করার চিন্তা করেছে এমন অনেকের সাথে কথা বলেছি। যাদের অনেকেই সুইসাইডাল এটেম্প্ট ও নিয়েছিল। তাদের অনেকেরই সুইসাইডাল থট এর পেছনে খুব কষ্টকর কিছু ছিল আবার অনেকের ক্ষেত্রেই ছিল খুবই সিম্পল কারণ। (এটা নিয়ে একটা সার্ভে করছি, পরে প্রকাশ করব সেটা)।

ভালো লাগার ব্যাপার হল যাদের সাথে কথা বলেছি তাদের ম্যাক্সিমামই খুব ভালো আছে এমনকি আগের চেয়ে অনেক ভালো আছে। শুধু অল্প কয়েকজনকে এমন পেয়েছি যারা সুইসাইডাল থট এর ধকলটা কাটিয়ে উঠলেও পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে তাদের আরো কিছু সময় দরকার।
তবে ভয়ংকর লেগেছে, পরিচিত এমন অনেকের মাথায়ই সুইসাইডের ভাবনা এসেছিল যাদেরকে সবসময় স্বাভাবিক মনে হয়েছে। অর্থাৎ আমাদের চারপাশেই অনেক মানুষ সুইসাইডের চিন্তা নিয়ে ঘোরাঘুরি করছে আমাদের অজান্তেই।
সুইসাইডের প্রধান কারন ডিপ্রেশন। যা অগণিত মানুষকে আত্মহত্যার দুয়ারে ঠেলে দিচ্ছে। ডিপ্রেশন বিভিন্ন কারণে হতে পারে। আমাদের চারপাশে এমন ডিপ্রেসড মানুষ প্রচুর। এই ডিপ্রেশন একদিনেই কাওকে শেষ করে দেয়না। এটা সময় নেয়। একটা কারণের সাথে নতুন আরেকটা কারণ যুক্ত হয়। তখন ডিপ্রেশন বাড়ে। আর সুইসাইডের পথে একটু একটু করে এগোতে থাকে। সর্বশেষ কেউ কেউ হয়তো সুইসাইডকেই নিজের জন্য সমাধান হিসেবে বেছে নেয়, যেটা কখনোই সমাধান নয়।
আমাদের দেশে যে পরিমাণ মানুষ সুইসাইড করছে বা যে পরিমাণ মানুষ ডিপ্রেশনে ভুগছে এটাকে কমিয়ে আনার জন্য সে পরিমাণ উদ্যোগ চোখে পড়ছেনা। অন্যদিকে এদেশে সাইকিয়াট্রিস্টকে এখনো মানুষ পাগলের ডাক্তার হিসেবেই চেনে। এ ট্যাবু ভাঙ্গা দরকার। একবারতো একজনকে সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে যাওয়ার কথা বলে ঝাড়িও খেয়েছিলাম।

একটা অনুরোধ সবার প্রতি, আমরা আমাদের চারপাশের হতাশায় ভোগা মানুষগুলির প্রতি আন্তরিক হোন প্লিজ। আমরা তাদের সমস্যা গুলো সমাধান করতে না পারি, শুনতেতো পারি। ডিপ্রেশনের কথা অন্যকে বলতে পারলে ডিপ্রেশন কমে।

প্রতি বছর বিশ্বে ১০৮ মিলিয়ন মানুষ সুইসাইড জনিত কারণে স্বজনহারা হয়। আমাদের সামগ্রিক প্রচেষ্টা এই সংখ্যাটাকে হয়তো কিছুটা হলেও কমিয়ে আনতে পারে।

সর্বশেষ সবার কাছে একটা প্রশ্ন, সফলতা এবং বেশি থেকে বেশি প্রাপ্তির প্রচণ্ড কম্পিটিশনে পড়ে আমরা কেউ কেউ
(হয়তো বা নিজের অজান্তেই) আমাদের কথাবার্তা, কাজ কর্ম অথবা আচরণের মাধ্যমে অন্য কারো ডিপ্রেশন বাড়িয়ে দিচ্ছিনা তো? কিংবা দিনে দিনে নিজেই ডিপ্রেসড হয়ে যাচ্ছিনা তো?

হৃদিতা রোশনী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

একটি সরকারি হাসপাতালে প্লাস্টিক সার্জারীর সফলতার গল্প

Fri Sep 11 , 2020
প্ল্যাটফর্ম প্রতিবেদন, ১১ই সেপ্টেম্বর ২০২০, শুক্রবার লেখাঃ ডা. হাসিব রহমান সহযোগী অধ্যাপক, প্লাস্টিক সার্জারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (ডিএমসিঃ কে-৫১) নয় বছর মেয়েটি তার মুখ ঢেকে রেখেছে, স্কুলে যাওয়া বাদ দিয়েছে। প্রথম যখন ওকে দেখি ফার্স্ট ইন্সটিংক্ট ছিল ঝামেলা এড়াই(প্রায়শই দুর্বল প্রতিজ্ঞা করি আর কোন ঝামেলাপূর্ণ কাজ করবনা)। নাক বানানো […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo