“স্যারকে যেমন দেখেছি”

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৬ এপ্রিল, ২০২১, সোমবার

লেখাঃ ডা. আরিফা আকরাম বর্ণা
সহকারী অধ্যাপক (ভাইরোলজি)
ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন এন্ড রেফারেল সেন্টার, ঢাকা।

স্যারের সাথে আমার পরিচয় একটা ওয়ার্কশপে ২০১৬ তে, তখন আমার পোস্টিং আইইডিসিআর এ। দেখলাম সবাই উনাকে বেশ ভয় পায়, আমি তখন উনাকে চিনতাম না। খোঁজ নিয়ে জানলাম উনি সিডিসির লাইন ডিরেক্টর। তার কিছুদিন পরেই উনি আইইডিসিআর এর ডিরেক্টর পদে যোগদান করলেন। একসময় জানলাম উনি আমার মামা ডা. বেলাল হোসেনের বন্ধু। সেটা স্যারও জানলেন, তারপর আমাকে ডেকে বললেন, বেলালের ভাগ্নি মানে আমাদেরও ভাগ্নি তুমি। তারপর থেকে আমার সাথে স্যারের সম্পর্ক সহজ হয়ে আসে। স্যার দেড় মাস আইইডিসিআর’র ডিরেক্টর এর দায়িত্বে ছিলেন। ঐ সময়টাতে তিনি একইসাথে দুইটি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তখনই দেখেছিলাম স্যার কেমন কাজ পাগল মানুষ!

আইইডিসিআরে যোগদানের দেড় মাসের মাথায় স্যারকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে বদলি করা হয়। ২০১৮ তে স্যার মুগদা মেডিকেল কলেজে যোগদানের মাধ্যমে ঢাকায় ফিরলে। সেখান থেকে ২০১৯ সালের নভেম্বরে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরী মেডিসিন এন্ড রেফারেল সেন্টার, আগারগাঁও এর প্রকল্প পরিচালক পদে যোগদান করেন।

ছবিঃ অধ্যাপক ডা. এ কে এম শামছুজ্জামান তোষার

স্যার পেয়েছিলেন নির্মানাধীন ১৪ তালা একটি ভবন আর ৫/৬ জন মানুষ। তিনি ভবনের ভেতর বাহির প্লাস্টার, চুনকাম সহ ধীরেধীরে সেই ভবন গোছানোর কাজ শুরু করলেন। ইতিমধ্যে আমার সেখানে পোস্টিং হলো। স্যার আমাকে আগেই জানিয়েছিলেন তিনি আমাকে তার প্রতিষ্ঠানে নিয়ে যেতে চান। এছাড়াও আরও অনেককেই তিনি তার প্রতিষ্ঠানে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করে। স্যার এই প্রতিষ্ঠানকে ডাকতেন স্বপ্নপুরী। আমি যেদিন যোগদান করতে যাই, আমি প্রতিষ্ঠানটা খুঁজে পাচ্ছিলামনা, কেউ চিনেনা আর গুগল ম্যাপেও নাই, আমি সেদিনই অফিসে বসে ম্যাপে এড করি, আর ফেসবুক পেজ খুলি। এখন তো মোটামুটি সবাই জানে এই প্রতিষ্ঠানকে। ওয়েবসাইট খোলা হলো। স্যার আমাকে মেসেজ দিতেন, এখনও আমার মোবাইলে আছে, work on website. স্যার চাইছিলেন ওয়েবসাইটকে গুছিয়ে সব ইনফরমেশন শেয়ার করে রাখতে।

জানুয়ারি ২০২০ এ সাধারণ ল্যাবে কাজ শুরু হয়। মলেকুলার ল্যাব তখনও সেট আপ হয়নি। অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল কিন্ত কত দ্রুত করা যায় উনি সেটার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন। এরপর দেশে করোনা সনাক্ত হয়, আইইডিসিআর একাই টেস্ট করে। স্যারের ইচ্ছে আমাদের ল্যাবেও করোনা টেস্ট শুরু হবে, কিন্ত ভাইরোলজিস্ট ছিলাম আমি একা, সাথে একজন টেকনোলজিস্ট যে পিসিআর কাজ পারতো। তাকে নিয়েই ২৯ শে মার্চ করোনা টেস্ট শুরু করি। পরবর্তীতে স্যারের নির্দেশে সব ডিপার্টমেন্ট এর ডাক্তারগন করোনা টেস্টের কাজে যুক্ত হন। সেই সাথে স্যারের ক্যারিশমাটিক ব্যবস্থাপনায় আমাদের করোনা ল্যাবে যুক্ত হয় ৫৫ জন স্বেচছাসেবী টেকনোলজিসট যদিও তারা করোনা টেস্টের বিষয়ে পারদর্শী ছিলনা। কিন্ত এরাও তখন পারতোনা। এমন একটা আনাড়ি টিম নিয়েই আমরা ২৪ ঘন্টা করোনা টেস্টের কাজ শুরু করি যেখানে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত ল্যাবগুলোও ২৪ ঘন্টা কাজ করেনা। আমরা অল্প কিছুদিনের মধ্যেই দেশের সর্বোচ্চ করোনা টেস্ট সম্পন্নকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হই।

আমাদের দৈনিক সর্বোচ্চ টেস্ট ৪৩৩৩। ডিজি অফিসের প্রেস রিলিজের সবার উপরে আমাদের নাম, সাড়ে সাত লাখ টেস্ট অলরেডি করে ফেলেছি আমরা। সকালে এসে রাত ১০/১১ টা পর্যন্ত স্যার ল্যাবে থাকতেন, আমরা মাঝেমধ্যে জোর করে উনার রুমে পাঠায় দিলেও বাসায় যেতেননা, অফিসেই থাকতেন। কেউ কোভিড টেস্ট করতে আসলে উনি নিজ হাতে স্যাম্পল নিতেন। স্যার টেকনোলজিস্ট দের বলতেন, “৭১ সালে যুদ্ধ করিসনি, করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ টা কর”। ওরাও শুধু তাঁর মুখের কথায় আর আদরে বিনা বেতনে কাজ করে গেছে। অনেক প্রতিষ্ঠান থাকা খাওয়া ট্রান্সপোর্ট সুবিধা দিতে পারেনি গত বছর লক ডাউনে, স্যর সব ব্যাবস্থা করেছেন।

ঢাকার বেশিরভাগ মানুষের করোনা টেষ্ট বোধ করি আমাদের ল্যাবই হয়েছে। সবাই বলে দিত, আমার ল্যাবে সম্ভব না এত টেস্ট করা। রাত নাই, দিন নাই স্যারকে সবাই কল দিত- “রিপোর্ট পাইনি স্যার, স্যার, ভি আইপি রোগীর বাসায় পাঠাতে হবে”। টেকনোলজিস্ট, এমনকি ডা. দের পরিবারের জন্য বিএমএ আয়োজিত বুথের টেস্ট করার সময় স্যারই হেল্প করেছিলেন। সংসদ সদস্যদের টেস্টও আমাদের এখানেই হতো, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সংসদ অধিবেশনে ধন্যবাদও দিয়েছিলেন। ঢাকা শহরের করোনা টেষ্টের দায়িত্ব অনেকটা একাই নিজের কাঁধে নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে, ডিএনসিসিতে বিদেশগামী যাত্রীদের করোনা টেষ্টের দায়িত্ব পালনের সময়ও একই অবস্থা।

ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না‌ কি বলব! স্যার, কোনোদিন না করেন নাই। অন্য দুইটা প্রতিষ্ঠানে বিদেশগামীদের স্যাম্পল যেত ৫০০ করে, আর আমাদের কাছে আসতো প্রতিদিন ১৫০০-২৫০০ স্যাম্পল। আমরা খুব রাগ করতাম কিন্তু স্যার কারো কথা শুনতেন না। দেশের জন্য কাজ আমি করবনা! সবসময় এই কথা। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল থেকে পিসিআর সেট আপ ও কাজ শিখতেও আসতো আমাদের ল্যাবে। এই যুগে এরকম শিক্ষক, চিকিৎসক, পরিচালক- মোট কথা অভিভাবক পাওয়া খুব দুষ্কর।

কখনো ভাবিনি স্যারকে নিয়েও এমন লিখা লিখতে হবে, চোখের পানি আটকাতে পারছিনা, আর কোনোদিন আমাকে স্যার ডাকবেন না, বলবেন না, “বর্ণা এই ল্যাবে সব মলেকুলার কাজ হবে, রিসার্চ করব, সিকুয়েন্সিং করবো, মলেকুলার কাজের জন্য ১ নম্বর প্রতিষ্ঠান হবে এটা”। আমরা WHO proficiency pannel এ ১০০% স্কোর করেছিলাম কিছুদিন আগে, স্যার খুব খুশি ছিলেন।

স্যার স্পষ্টভাষী ছিলেন, উচিত কথা বলতে পিছপা হতেন না। অনেকে হয়তো এজন্য স্যারকে পছন্দ করতেন না কিন্ত এমন মানুষ আজকের দিনে কোথায় পাবেন যে কাউকে ভয় না পেয়ে, মুখের উপর সত্যি কথা বলতে পারে! কোনো প্রতিষ্ঠানের ডিরেক্টর মৃত্যুবরণ করায় সবার চোখে পানি কয়জন দেখেছেন! স্যার দারোয়ান, ক্লিনার থেকে শুরু করে সবাইকে এত ভালবাসা দিয়েছেন, সবাই নিজের উদ্যোগে কাজ করতো, একটা পরিবার করে রেখেছিলেন আমাদের সবাইকে। পরিবার গুছিয়ে মাথা যদি না থাকে, তাহলে কেমন হয়! যেই করোনাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে স্যার এত কিছু করলেন, সেই করোনায় আক্রান্ত হয়ে স্যার দেশের জন্য শহীদ হলেন।

দেশ একজন হিরো, দেশপ্রেমিক, অসাধারণ মানুষকে হারালো। এই ক্ষতি পোষাবার নয়।

কিছুদিন আগেই অনেকে বলছিলেন, করোনাকালীন সেবায় যদি একজন মানুষকে সম্মানিত করতে হয়, একুশে পদক এর মত সম্মাননা দিতে হয় তাহলে সেটা তুষার স্যারকেই দেয়া উচিত। জানিনা মরণোত্তর কোন সম্মাননা এই দেশে দেয়া হয় কিনা, হলে স্যারের প্রাপ্য।

হৃদিতা রোশনী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

এসএসসি পাস না করেই মেডিসিন ও বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ

Mon Apr 26 , 2021
প্লাটফর্ম নিউজ, ২৬ এপ্রিল, ২০২১, রবিবার তাঁর নাম এম কে এইচ খান বিজয়। সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলায় তাঁর বাড়ি। বিয়ে করেছেন কুষ্টিয়া শহরের হাউজিং এলাকায়। বিয়ের সুবাদে শ্বশুরবাড়িতে থাকেন। এখান থেকে শুরু করেন প্রতারণা। সিলেটের একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস পড়াশোনা করেছেন জানিয়ে কুষ্টিয়ায় শুরু করেন চিকিৎসাসেবা। প্রায় ১০ বছর ধরে […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo