লাইফ ইন লকডাউন, ডে ফোর্টি ফোর

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২১ মে ২০২০, বৃহস্পতিবার
ডা. শুভদীপ চন্দ

আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। যখন জাগলাম দেখি পাশের বেডের লোক মারা গেছেন কিছুক্ষণ হয়। কেমন যেন মিশ্র অনুভূতি হচ্ছিল। উনার জন্য খারাপ লাগছিল, ভয় লাগছিল, হতাশ লাগছিল। কিন্তু সাথে মনে হচ্ছিলো ‘আমি তো মরি নি’। কি হতো যদি উনার বদলে আমিই মারা যেতাম! কথা বলার কেউ নেই। লিখে রাখারও উপায় নেই। ডায়েরি মোবাইল ট্যাব হাসপাতালে ‘নট-এলাউড’। দেয়ালের দিকে পাশ ফিরে শুয়ে রইলাম। নীরবে কিছুক্ষণ কাঁদলাম। দেয়াল নীরব সাক্ষী হয়ে রইলো।

এদিকে দেহটি অনেকক্ষণ পড়ে আছে। ইসিজি মেশিন আনলো, কনফার্ম করলো, মৃত্যুর সনদ বানালো, স্ট্রেচার আসলো, বডি ব্যাগ, কাপড় বদলানো, দূর থেকে আত্মীয় স্বজন দেখা, লাশ নেয়ার জন্য আলাদা লোক। বিধি – আইন – নিরাপত্তা প্রটোকল। সময় তো লাগবেই। পিপিই পরা লোকগুলোকে মানুষ মনে হচ্ছিলো না। যমদূত লাগছিল!

আমি টের পাচ্ছিলাম এ রুমের আমরা সবাই বুঝতে পেরেছি ‘আমাদের’ একজন মারা গেছে। এ রুমে ঠিক কতজন আছি জানি না। কিন্তু আমরা শ্বাস নিচ্ছিলাম নিঃশব্দে, নড়াচড়া নিঃশব্দে। যেন শব্দ হলে যমদূতেদের চোখে পড়ে যাব। যেন আমরা চোখ বন্ধ করে পালিয়ে আছি।

না, আমি কোভিড নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হই নি। এ লেখাগুলো আমার বর্তমান নয়। একসময়ের ভয় আশংকা আজ বাস্তবতা নির্মমতা। এক কলিগের শ্বশুরের জন্য আইসিইউ বেড খুঁজছিলাম। একটি ম্যানেজ হলো, কিন্তু কলিগ কোভিড পজিটিভ হয়ে গেল। সে বেচারি আবার ৩৮ সপ্তাহের প্র‍্যাগনেন্ট। স্কয়ারের ম্যাডামের তত্ত্বাবধানে ছিল। এখন বুঝে পাচ্ছে না পরের বিপদ কোনদিক থেকে আসবে।

প্রত্যেক দিন তার আগের দিনের চেয়ে খারাপ। নতুন যোগ হয়েছে ঘূর্ণিঝড়। কাল পত্রিকায় উড়ে যাওয়া ঘরের চালের ছবি দেখবো। আর থাকবে ভেঙ্গে পড়া গাছের ছবি। এক বাউল শিল্পীর চল্লিশ বছরের সাধনা পুড়িয়ে দেয়া হলো। ঈশ্বর যে কেন এ ভূখণ্ডে আলাদা করে দূর্যোগ দেন- বুঝি না!

আজ দেখলাম এক কালো গাড়ি করে এক ভদ্রলোক ত্রাণ নিয়ে আসলেন। ইফতারের আগে আগে। লোকজন ছুটছে। ছেলে বুড়ো সবাই। গাড়ি থেকে বলছিল- একজন এক প্যাকেট পাবে। মানুষ কী আর তাতে নিরস্ত্র হয়? বুনো উন্মাদনা। কোনো ধন্যবাদ নেই, কোনো লাজলজ্জা নেই, কোনো অপরাধবোধ নেই। মুহূর্তের মধ্যে সব শেষ হয়ে গেল। উনি গাড়ি নিয়ে চলে গেলেন।

দীর্ঘ লকডাউন। আমরা প্রায় সবকিছু মিস করছি। চা ঘর, ইস্ত্রি করা কাপড়, সেলুন। শুধু রাজনীতি মিস করছি না। বক্তৃতা, গলাবাজি, জ্বালাও পোড়াও মিস করছি না। জানি না দেশ চালানোর জন্য কেন পেশাদার লোক থাকে না? আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে কেন নির্বাচিত হতে হয়। পরীক্ষা দিয়ে যদি ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার সিইও হওয়া যায়, প্রেসিডেন্ট কেন হবে না। এখানে পেশাদারিত্ব আরো বেশি দরকার। অন্তত গোষ্ঠী সিন্ডিকেটের মাফিয়াগিরি বন্ধ হতো। কিছুটা হলেও নীতি ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত হতো।

এ তো সত্য- আদর্শ সব দেউলিয়া। যদি লকডাউন আরো দুই মাস বাড়াতে হয়, দেশগুলো করোনার সাথে সহাবস্থান করতে বলবে। মানুষের পৃথিবী- বিপদের দিনে মানুষকে দুইমাস হাত বন্ধ রেখে খেতে দিতে পারে না! পৃথিবীর বয়স যত হাজার বছরই হোক- তার সে সামর্থ্য নেই! অথচ না জানি কত প্রজন্ম প্রজন্ম মানুষ তিলে তিলে এ পৃথিবীটা গড়েছে!

Platform

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

ইন্টারনেটের অস্কারখ্যাত 'ওয়েবি এওয়ার্ড' জিতলো সমীর-সেঁজুতির 'চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশন'

Thu May 21 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, বৃহস্পতিবার, ২১ মে, ২০২০ এবার ইন্টারনেটের অস্কারখ্যাত ‘Webby Award’ জিতলো সমীর-সেঁজুতির নিজ হাতে গড়া সংগঠন ‘চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশন’। বিল গেটস আর মার্ক জাকারবার্গ যাঁদের নিয়ে প্রশংসায় মত্ত, বলছিলাম সেই ড. সমীর সাহা ও তাঁর মেয়ে ড. সেঁজুতি সাহার কথা, যাঁরা ইতিমধ্যেই বিশ্বকে তাঁক লাগিয়ে দিয়েছেন। “সেঁজুতি মডেল” […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo