লাইফ ইন লকডাউন, ডে টুয়েন্টি ফাইভ

২ মে ২০২০, শনিবার
ডা. শুভদীপ চন্দ

পাশের ফ্ল্যাটের সে পিচ্চিটা চলে গেছে। আজ একবারও শুনলাম না ‘রা-জে-শ্ব-রী.. ওই ও রা-জে-শ্ব-রী…’! গতকাল, পরশুও শুনি নি। ওর নাম জানি না। রাজেশ্বরী এখন একা একা পুতুল খেলে। নিশ্চয়ই- তার পুতুলের সাথে বিয়ে হওয়া পুতুলও দুঃখী দুঃখী মুখ করে বসে থাকে।

কোভিড উনিশ এরকম অসংখ্য ছোটখাটো মনখারাপ গল্পের সমষ্টি। কতজন আটকে আছে, যেতে পারছে না বাসায়। ঘর তো সেটাই যেখানে মানুষ কাজ শেষে ফিরে। পরিবার থেকে দূরে কোনো মেসবাড়ি কখনো ঘর হতে পারে না। ছাদটা দেয়, সে তো ট্রেনের প্লাটফর্মও দেয়। এদেশে কেন জানি সব উল্টো করে হয়। যারা ক্লাসে আসে নি, ‘কেন আসে নি’- সে জবাব স্যাররা আজীবন তাদের কাছেই চেয়েছেন যারা এসেছে। সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং এর মুখে থুথু মেরে সেদিন যারা ট্রেনে-বাসে-লঞ্চে করে বাড়ি ফিরলো- দেখা গেল তারাই গেইনার। যারা সততা নিয়ে গেল না, তারাই কষ্টে থাকলো। আমার বাসায় যাওয়া হয় না বহুদিন। তবুও আমি ভাগ্যবান। লকডাউন শুরুর আগে মা বাবাকে ডাক্তার দেখিয়েছিলাম। নয়তো ‘দেখাতে পারছি না’, ‘হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে কিনা’, ‘ভেতরের ঘুনে পোকা সব শেষ করে দিচ্ছে কিনা’- এসব ভাবতে ভাবতেই অর্ধেক হয়ে যেতাম।

আজ পুরোটা দিন কাটলো ঘুমিয়ে। ওই যে বলে না- যত বড় প্রতি বিপ্লবীই হোক, বঙ্গ মুলুকে বৃষ্টি শেষে বাতাসে ঘুমুবে! এ ক’দিন খুব ভাল বৃষ্টি হচ্ছে। এক বৃষ্টি থেকে আরেক বৃষ্টি পর্যন্ত আকাশ মুখ কালো করে রাখছে। আজ মে দিবস। আশেপাশের বিল্ডিংয়ের কাজ চললো রাত পর্যন্ত। রাস্তায় রিকশা ভ্যানও অন্যদিনের মতো চললো। যেসব দোকান খোলা থাকে খোলা থাকলো। যেকোনো দিবসের তাৎপর্য তার আগের রাতের উপর নির্ভরশীল। আগের রাতে পেটে কিছু না পড়লে পরের দিন ‘দিবস’ নিয়ে ভাবার ফুসরত হয় না। এবারের মে দিবস লাল রঙ ও প্রতিশ্রুতির সবচেয়ে কম অপচয় হয়েছে।

পারিবারিক অশান্তি বাড়ছেই। এক পালকের ওজন কেউ কেউ টানতে পারছে না। সে কৃষকের গাধার মতন। এক কৃষক দূরে যাবেন। তার সব মালপত্র তার একমাত্র গাধার পিঠে উঠিয়ে দিলেন। এতো ওজন গাধা আর দাঁড়াতে পারে না। তারপরও খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটা শুরু করলো। কিছুদূর যেয়ে কৃষকের মনে পড়লো- নীল রঙের পাখির এক সুন্দর পালক বাকি পড়ে আছে। দৌড়ে গিয়ে ঘর থেকে পালক নিয়ে এলেন। গাধার পিঠে তুললেন। গাধা মুখ থুবড়ে পড়ে মরে গেল। কৃষক দুঃখ নিয়ে ভাবলেন- ‘ঈশ! আমরা গাধাটা এক পালকের ভার বইতে পারলো না!’

তিনি শুধু পালকটিই দেখলেন। তার আগে কত ওজন চড়িয়েছেন তা দেখলেন না! সামান্য কথায় অশান্তি লেগে যাচ্ছে। অথচ তার আগের কথা, তার তার আগের কথা কেউ মনে করছে না। এক ছাদের নিচে দু’জন মানুষ আজীবন থাকাই জীবনের অনেক বড় স্যাক্রিফাইস। মানুষ সবসময় দূর থেকেই সুন্দর।

প্রতিদিন এক শিডিউল। বাইরে থেকে এসে কাপড় ধোয়া। ইস্ত্রি করা শার্ট প্যান্ট গায়ে ওঠে না বহুদিন। আজ দেখলাম ইস্ত্রির দোকান খোলা। কথা বললাম। দোকানি বললো- ‘পাগলা কুত্তার কামড় খেয়ে মরার চেয়ে নিজের হিস্যার করোনাতে মরা ভাল’। কে তাত্ত্বিক না এদেশে? দু-একজন লিখে, ভাবে সবাই।

এত সুন্দর নদী, নামটি এমন খটমট কেন। কখনো মনু, কখনো ঘাঘট, কখনো মাতামুহুরি, কখনো যমুনা। নদী ধরে ধরে জীবন। অবলুপ্ত ব্রিজের এক দিকের পিলার অর্ধভগ্ন অবস্থায় পড়ে থাকে। কালের সাক্ষী হয়ে এ পাশের চালু ব্রিজটাকে ভেংচি কাটে। ধানক্ষেত, কচুরিপানা, বেগুনি বেগুনি পানা ফুল। দূরের ডিঙ্গি নৌকা যাত্রীভর্তি। নদীর নাম ‘পুংলী’।

আজ সকালে বেড়িয়েছিলাম শহর দেখতে। শহরের গলি গুলোর এমনিই ভগ্নদশা, যত্রতত্র রিকশা না দাঁড়ানোতে ঘা প্যাঁচড়া আরো প্রকট হয়েছে। বৃষ্টির কারনে পানি জমে আছে স্থানে স্থানে। তবে স্বীকার করি কর্তৃপক্ষ শহরকে অনেক পরিচ্ছন্ন রেখেছে। লোক নিতান্ত কম বের হয় নি। সবাই আসামি তাই পুলিশ ফেরার।

এবার আমগাছ গুলো যথেষ্ট ফলবতী। লম্বা লম্বা ডাটা দিয়ে ছোট ছোট আম ঝুলে আছে। প্রতি সকালেই এক পাঁজি কাঠঠোকরা আমার জানালার কাঁচকে কাঠ ভেবে ঠুকরোতে শুরু করে। দেরী করে উঠবো সে যো নেই। মোবাইলের এলার্ম নিজের হাতে পাখির এলার্ম ঈশ্বরের হাতে। সে পর্যন্ত হাত পৌঁছে না!

Platform

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

কোভিড-১৯ আক্রান্ত ডা. বিলাস কুমার সাহার রাষ্ট্রের কাছে খোলা চিঠি

Sat May 2 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২ মে ২০২০, শনিবার: ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরী বিভাগে কাজ করার সময় কোভিড-১৯ আক্রান্ত হন ডা. বিলাস কুমার সাহা। গত ২৬ এপ্রিল তাঁর কোভিড-১৯ পজিটিভ হওয়ার রিপোর্ট আসে। জানা যায়, জ্বর না থাকলেও গলাব্যথা ও মাথাব্যথা থাকার কারণে গত ২৫ এপ্রিল নমুনা পাঠান তিনি। বর্তমানে আইসোলেশনে নিজ […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo