লাইফ ইন লকডাউন, ডে টুয়েন্টি টু

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৮ এপ্রিল ২০২০, বুধবার
ডা. শুভদীপ চন্দ

আজ ঘুম ভাঙ্গলো মেঘের শব্দে। হাজার ঘোড়সওয়ারসহ বখতিয়ার খলজী যেন বাঙলা আক্রমণ করেছে। একটু পর ঝুম বৃষ্টি নামলো। সাথে দমকা হাওয়া। আটটা বাজতে আর দেড় দুই ঘন্টা বাকি। আমাকে হাসপাতাল যেতে হবে। সব ছুটির সাথে একটি ‘বৃষ্টি ছুটি’ থাকলে ভাল হতো। নিয়ম হতো- নাগরিকরা বৃষ্টির দিন সকালে উঠে মর্জিমাফিক সিদ্ধান্ত নিবে। এমন থাকলে আমি আজ ছুটি নিতাম।

প্রতিদিন কালো এক মিটসুবিসি জীপে করে হাসপাতালে যাই। কালো কাঁচের ভিতর দিয়ে ধানক্ষেত, পুকুর, আকাশ, বৃষ্টি, হাইওয়ে, মানুষ দেখি। উচ্চপদস্থরা যেমন দেখেন- ছবির মতো করে। এ ছবিগুলো স্কুলে পড়ার সময় আঁকতাম। সামনে হাঁস মুরগী, পিছনে টিনের বাড়ি, তার পিছনে কলা গাছ, তার পিছনে ধান ক্ষেত, নদী, দূরের গাছ, তার পিছনে আকাশ, তার পিছনে পাখি। এখন গ্রামে এসে দেখছি খুব বেশি ভুল আঁকতাম না! সরকার থেকে ইউএইচএফপিও-দের গাড়ি দিয়েছে। আমাদের এম্বুলেন্স চড়ে যাওয়ার পাট চুকেছে।

এক ছেলে এসেছে কয়েকটি ঘুমের বড়ি খেয়ে। আমাকে ডাকা হলো মৃত্যুদণ্ডের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেয়ার জন্য। ডাক্তারিতে মৃত্যুদণ্ড হচ্ছে স্টোমাক ওয়াশ। এটি এমন এক ক্রুড প্রসেস যে কাউকে একবার দিলে সে ট্রেনের নিচে ঝাপ দিয়ে মরতে পারে, কিন্তু বিষ খাওয়ার কথা পরজন্মেও আর ভাববে না। আমি বললাম ‘কেসটা কি নিয়ে?’ উপস্থিত বাকিরা বললো ‘মোবাইল চাইছিলো, বাপ মায়ে দেয় নাই।’

ওরা সব দেখলো। ফোর-আর্মের ভিতরের দিকে ব্লেড দিয়ে সদ্যলেখা ‘R’ অক্ষরটি দেখলো না। একটি নাইনে পড়ুয়া ছেলে মোবাইলের জন্য স্যুইসাইড করতে যাবে না। তার পিছনে প্রযুক্তির চেয়েও বড় কোনো শক্তি আছে। যেটা সমাজমতে তাকে অউন করার পারমিশন দেয় না।

ছেলেটা পড়া বলছিলো। অপরপাশ থেকে মেয়েটা খুব স্বাভাবিক ভাবে দেখছিলো। ওই পদ্মফুলের মতো বড় বড় চোখের দিকে চোখ পড়তেই- পড়া আর পড়া থাকে! নিয়ন্ত্রণ হারানো গাড়ির মতো সবসুদ্ধ খাদে পড়ল। পহেলা বৈশাখ, পহেলা ফাল্গুন, রবীন্দ্রজয়ন্তী- মেয়েরা একটু সাজে। ধরা না পড়ে একনজর বারবার দেখবে বলে ছেলেদের কত গেরিলা ট্রেনিং। কত উত্তেজনা। প্রয়োজন বানিয়ে অপ্রয়োজনে এক বাড়ির সামনে দিয়ে বারবার আসা যাওয়া। যদি একবার দেখা হয়। যদি একটু লক্ষ্য করে। হিরোগিরি, পাকনামো, জ্ঞানী জ্ঞানী উদাসী ভাব সব তার জন্য। স্কুল কলেজের বোকা প্রেমের আশেপাশে কোনো প্রেম ভালোবাসা নেই। নিজের মার্কসটা দেখেই তার মার্কস দেখা। ঈশ্বরের মতো সবসময় দূর থেকে খেয়াল রাখা- কোনো বিপদ আপদ হলো না তো!

দ্বিতীয় তৃতীয় চতুর্থ প্রেমের তাও সাক্ষী থাকে। অধিকাংশ প্রথম প্রেমের কোনো সাক্ষী নেই। মনের একদম গোপন ঘরে তালাবদ্ধ অবস্থায় পড়ে থাকে। মুখ ফুটে বলতে পারে আর ক’জন। তবে এটি এমন এক শক্তি জেনারেট করে জীবনের বাকি প্রেমগুলো এখান থেকে শক্তি ধার করে করেই চলে যায়।

প্রথম প্রেমের হতাশা স্পর্শ করে নি এমন মানুষ বিরল। এ ছেলেটি সাহসী। সে একটি সাইন রেখে দিচ্ছে। সময়ের সাথে নিশ্চয় তারও প্রেম হবে, বিয়ে হবে; সে আজকের দিনের কথা ভুলে যাবে। কিন্তু সে মহাকালকে এ চ্যালেঞ্জটা দিতে পেরেছে। সে তার শরীরেই অক্ষর খোদাই করে নিছে। এ দাগ শুকোবে না। অধিকাংশ তো এমনিই অভিমান গিলে নেয়। সে গিলে নি।

‘কিং কং’ সিনেমার কথা মনে পড়লো। একদম শেষ দৃশ্যে বিশালাকৃতির গরিলা কিংকং মরে পড়ে আছে। সৈন্যরা মৃত প্রাণীটি ঘিরে ছবি তুলছে। দুষ্ট পরিচালক আসলেন। ভীড় ঠেলে উঁকি দিলেন। জিজ্ঞেস করলেন ‘কি হয়েছে?’ উপস্থিত ফটো সাংবাদিক বললো ‘উড়োজাহাজ দিয়ে তাকে মেরে ফেলা হয়েছে।’ তিনি একটু সময় নিলেন। বললেন-
‘ইট ইজ নট দ্য এয়ারপ্লেনস, ইট ইজ দ্যা- বিউটি কিলড দ্যা বিস্ট..।’

ভালোবাসার চেয়ে বড় বিউটি আর কিছু নেই। যাইহোক আমাকে একটি রায় দিতে হবে। বললাম- ‘দেন স্টোমাক ওয়াশ।’

সে একটা স্কারমার্ক চাচ্ছিলো। পৃথিবীর অংশ হিসেবে আমরা সেটি আরেকটু গাঢ় করে দিলাম। সব জায়গায় বই, গাইডলাইন, প্রয়োজন খুঁজতে নেই!

কোভিড উনিশ আরেকটি জিনিস আমাদের দিচ্ছে। স্কার মার্ক। এখন শুনছি- অনেক জায়গায় ডাক্তাররাই ডাক্তারদের এভোয়েড করছেন। যার পেশেন্ট এক্সপোজার বেশি- তাকে এড়িয়ে চলছেন বাকিরা। যে বড় প্রতিষ্ঠানে আছেন- তাকে এভোয়েড করছে অন্যরা। শুধু বাড়িওয়ালী আর এলাকার মাতব্বরের কথা বলে লাভ কী! কোভিড আসলে মুখোশ খোলার কাজ করছে। ক্ষতে ভরা এক মুখের চিত্র বের করে আনছে। এটিই আমাদের রিয়েল ফেস।

আপন প্রাণ বাঁচানোই প্রাণীর ধর্ম। দিনশেষে মানুষ একটি প্রাণী ছাড়া আর কিছু নয়!

Platform

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

মৃত্যুঝুঁকি উপেক্ষা করে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন ফ্রান্সের ৯৮ বছর বয়সী প্রবীণতম চিকিৎসক

Wed Apr 29 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ বুধবার, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২০ খ্রিস্টাব্দ করোনা ভাইরাস পরিস্থিতিতে ঝুঁকির মুখে রয়েছেন প্রবীণরা। তবে একজন চিকিৎসক হওয়ায় সর্বোচ্চ ঝুঁকির মধ্যে থেকেও সেবা কার্যক্রম থেকে নিজেকে দূরে রাখতে চান না ফ্রান্সের প্রবীণতম চিকিৎসক ৯৮ বছর বয়সী ডা. ক্রিস্টিয়ান। প্রতি সপ্তাহেই ফ্রান্সের এক বৃদ্ধাশ্রমে থাকা প্রবীণদের সেবা দিতে যান তিনি। […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo