লকডাউন নয় মুখডাউন চাই

মঙ্গলবার, ২৩ মার্চ, ২০২১

করোনার দিনগুলোয় “লকডাউন নয়, মুখডাউন চাই”

১। আজ এক বড়ভাই আসলেন আমার সাথে দেখা করতে। চমৎকার ভাবে নিয়ম মেনে মাস্ক পরা। অথচ গত একবছর তিনি এমন ছিলেন না। আমি কখনো তাঁকে মাস্ক পরিহিত দেখেছি বলে মনে পরছে না।যখনই দেখেছি তখন মাস্ক ছাড়াই দেখেছি। আজ তিনি চমৎকারভাবে মাস্ক পরিহিত।

কারণটা কি জানেন?

তিনি কিছুদিন আগে হার্ট এটাক করেছেন। মৃত্যুকে কাছে থেকে দেখে এসেছেন। আল্লাহর বরাতে ফিরে এসেছেন। তাঁর রক্তচাপ স্বাভাবিক ছিলো সবসময়। ডায়াবেটিস নাই। তারপরেও তাঁর হার্টএটাক হলো।অবশ্য এর মাস দেড়েক আগে তাঁর জ্বর, ঠাণ্ডা-কাশি হয়েছিলো। বেশ কিছুদিন কষ্ট করেছেন এবং অবশ্যই কোভিড টেস্ট করেননি। কারণ তাদের করোনা হয়না, তারা বিশ্বাস করেন না যে তাদের করোনা হতে পারে।

আমার ধারনা এটি পোস্ট কোভিড সিনড্রম। এই কারণেই তিনি ভয়ে মাস্ক পরছেন। অথচ আগে থেকে মাস্ক পরলে হয়তোবা এই হার্ট এটাক এড়াতে পারতেন। এখন পরছেন। তাও মন্দের ভালো।

২। আরেক বড়ভাই হঠাৎই স্ট্রোক করলেন।একপাশের হাত পা প্যারালাইজড হয়ে গেলো।প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে নিউরোসায়েন্সে পাঠালাম।ওখান থেকে পাওয়া গেলো ইস্কেমিক স্ট্রোক। যা আইডিয়া করেছিলাম তাই। এখন নিয়মিত ফিজিওথেরাপি নিচ্ছেন। কষ্ট করে হাঁটার চেষ্টা করছেন। তাঁর ও রক্তচাপ স্বাভাবিক ছিলো।ডায়াবেটিস ছিলো না। বয়স ৫০ এর আশেপাশে মাত্র। তিনি ও এখন নিয়ম করে মাস্ক পরেন। আগে পরতেন না কিংবা পরতে পারতেন না। এখন পারেন।আমার ধারণা তিনি ও পোস্ট কোভিড সিন্ড্রোম এর রোগী। তাঁর ও দেড়মাস আগে কোভিড টাইপ সিম্পটম ছিলো। তিনি ও পরীক্ষা করাননি। কারণ তাঁর ও ধারণা করোনা বলে কিছু নেই। মুমিন মুসলমানদের করোনা হয়না। অথচ কি ভোগান্তি এখন। তিনি ও হয়তোবা মাস্ক পরলে এমন পরিস্থিতি এড়াতে পারতেন। কি দুর্ভাগ্য! ছোট ছোট ছেলেমেয়ে ফেলে তিনি এখন কর্মে অক্ষম। নিজের জীবন বাঁচাতে লড়ছেন। আল্লাহ জানেন, সামনের অসীম সাগর কিভাবে পাড়ি দিবেন তিনি।

৩। গতকাল এসেছিলেন এক চাচী। তিনি অনেক কষ্টে আছেন। তাঁর বাঁচতে ইচ্ছা হয়না। সারা শরীর জ্বলছে। কোন ঔষধেই ভালো হচ্ছেনা। সারারাত ঘুম নেই। কোন টেনশন ও নেই। অনেকেই বলে টেনশন থেকে এমন হচ্ছে, আদতে তাঁর কোন টেনশনই নেই। তিনি ও মাস দুয়েক আগে কোভিড সিম্পটমে ভুগেছিলেন। কোভিড টেস্ট করাননি। কেউ বলেওনি। কারণ করোনা মানেই মারাত্বক কিছু, সাধারণ সর্দিকাশি তো নয়ই। এখন তিনি সম্ভবত পোস্ট কোভিড সিন্ড্রোমে ভুগছেন। যার কারনে মারাত্মক নার্ভাস সিস্টেম ইরিটেশন হচ্ছে আর তিনি কষ্ট পাচ্ছেন। এটাও তিনি এড়াতে পারতেন। তাঁর যুবক ছেলেমেয়েগুলো যদি মাস্ক পরতো অথবা তাঁর স্বামী যদি মাস্ক পরতেন। তারা কেউ মাস্ক পরেন না, পরাটাকে ও বোকামি মনে করেন অনেকেই।

আর গ্রামীণ এই সহজ মানুষগুলোকে উস্কে দেয় এক শ্রেণীর ধর্মব্যবসায়ী যারা ওয়াজের নামে লাখ লাখ টাকা নেন এবং ক্রমাগত বিজ্ঞানের বিরোধিতা মূলক কথা বলতে থাকেন। তারা সবকিছুকেই ধর্মবিরোধিতা বলে সাধারণ মানুষকে উস্কে দেন।তাদেরকে উৎসাহ দেন মাস্ক না পরতে। ধর্মের রেফারেন্স দিয়ে ব্যাখা দেন কেন মাস্ক পরা উচিত নয়। তাদের কারণে মারা যায়, পঙ্গু হচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। অথচ তারাই মানুষকে ধর্মভিত্তিক ব্যাখ্যা দিয়ে মানুষকে মাস্ক পরতে উৎসাহিত করতে পারতেন। মাস্ক পরলে তো কারো ক্ষতি হয়না।এরকম কোন তথ্য আমার জীবনে কোথাও পাইনি যে মাস্ক পরলে ক্ষতি হয়। কাজেই এটা পরাতে অসুবিধা কোথায়! কতিপয় মোল্লাদের সমস্যা কোথায়!

আমি এইসকল ধর্মব্যবসায়ীদের মুখডাউন চাই।
এ সকল উস্কানি পেয়ে সাধারন মানুষগুলো মাস্ক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। তাদের উস্কানির কারণেই মানুষ মাস্ক পরেনা, লকডাউন মানেনা। যেখানে ৯৯% মানুষ মাস্ক পরেনা, সেখানে লকডাউন জোর করে চাপিয়ে দিয়ে জনগণের অর্থনীতির বারোটা বাজানোর কোন মানে হয়না। লকডাউন আমরা চাই না। বিশেষত যারা মাঠ পর্যায়ের স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করি এবং করছি। লকডাউন আমাদের দেশে অন্তত কোন ফল বয়ে আনে না। কেননা জনগন এটা মানেননা। লকডাউন তো দূরের কথা তারা মাস্কই পরে না।

৪। জনগন কেন লকডাউন মানবে না?

আমাদের গ্রাম ৮৫৬৫০ টি। তথ্য বিভ্রাট হতে ও পারে। আমার অন্তত তাই মনে আছে। কোভিডের তীব্রতা মে-জুন থেকে আমাদের দেশে শুরু হয় এবং পিক এ ছিলো সম্ভবত নভেম্বর-ডিসেম্বরে। তখন কতজন মারা যেতো আপনাদের মনে আছে নিশ্চয়ই। এটি কোনভাবেই ১০০ নয়, অন্তত জাতীয় পরিসংখ্যান অনুসারে।

আমাদের গ্রামগুলোতে যদি প্রতিমাসে একজন কোভিড-১৯ এ মারা যায় এবং সেটি যদি গত জুলাই মাস থেকে চলতে থাকে তবু এই সংখ্যা হয় সাত লাখের উপরে। আবার প্রতিমাসে প্রতিগ্রামে একজনের মৃত্যু কোনভাবেই মানুষের চোখে লাগে না এবং এটাতে সিরিয়াস হবার কোন কারণ ও তারা খুঁজে পায় না। একই কারণে টিকা নেবার ক্ষেত্রে ও মানুষের অনাগ্রহ। (এখানেও স্ববিরোধী বক্তব্য তাদের। আমার কাছে যে কতজন এলেন টিকা না নিয়ে সার্টিফিকেট দিতে! আমি অবশ্য এখানে বড্ড বেরসিক। ধরে বুঝিয়ে টিকা দিয়ে দিছি। তারা আবার সবাই দাবী করেছে টিকা দেবার পরে তাদের শক্তি বেড়ে গেছে)।

পৃথিবীটা এমনই যে, যে মানুষটি মারা গেলেন তার জন্য ১০০% মৃত্যু। তার পরিবার দীর্ঘদিন যাতনা ভোগ করবে এই একটি মানুষের অভাবে। আমাদের সাধারন মানুষগুলোর এই সূক্ষ্ম হিসাব বুঝার মতো সেন্স নাই বললেই চলে। তারা দুর্দান্তভাবে মাস্ক পরে কোভিড আক্রান্ত হয়ে সেরে যাবার পরে। মাথার উপর দিয়ে যখন কবরস্থান ঘুরে তখন চৈতন্য হয় যে মাস্ক পরে জীবন বাঁচাই। এর আগে তাদের খবর হয়না। কাজেই ছোট ছোট ব্যবসায়ী যারা আমাদের বিরাট অংশ তাদের পেটে লাথি মারার কোন যৌক্তিকতা নাই।

আমাদের মানুষগুলো সাধারণ হতে পারে, কিন্তু এই মানুষগুলোই আমার কাছে অসাধারণ। আমাদের জাতি নির্মাণ করবো আমরা এই মানুষগুলো নিয়েই।আমাদের মানুষগুলোর বেঁচে থাকা খুব প্রয়োজন।কিছু অপাংক্তেয় লোকের কথার কারণে যখন বিরাট অংশের জীবন সংকটে পড়ে যায় তখন সত্যিই মনে হয় ঐ লোকগুলোর মুখডাউন করে দিন দয়া করে অর্থাৎ ওদের মুখ বন্ধ করে দিন কিছুদিনের জন্য, আমাদের জনগণকে বাঁচতে দিন। তারা বেঁচে থাকলেই আমাদের মূল্য থাকে। তা না হলে আমরা মূল্যহীন হয়ে যাই।

ডা. মোহাম্মদ আল-মামুন
কনসালটেন্ট (সার্জারী)
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, বাঞ্ছারামপুর

অংকন বনিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

দেশে করোনায় আরো ২৫ জনের মৃত্যু, নতুন শনাক্ত ৩৫৬৭ জন

Wed Mar 24 , 2021
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৪ মার্চ ২০২১, বুধবার দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে সংক্রমিত আরও ২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময় নতুন করে ৩৫৬৭ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে, সুস্থ হয়েছে ১৯১৫ জন। দেশে এখন পর্যন্ত ৫ লাখ ৮০ হাজার ৮০৮ জনের দেহে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ৮ হাজার ৭৬৩ জনের […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo