হার্ড ইমিউনিটি – আশঙ্কার নীতি


৬ মে, ২০২০, বুধবার

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে হার্ড ইমিউনিটি নিয়ে বেশকিছু কথাবার্তা হচ্ছে এবং এর অধিকাংশই অত্যন্ত আশঙ্কাজনক। সেই সাথে হতাশাজনক তো বটেই। হার্ড ইমিউনিটির পক্ষের যে যুক্তিগুলো, সেগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে; এখানে অর্থনীতি, বাণিজ্য, সমাজ ব্যবস্থা, মানুষের বিহেভিয়রাল ব্যাপার গুলি আলোচিত হলেও, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যপারটিই কিন্তু একেবারে পুরোপুরি উপেক্ষিত হয়েছে। আর সেটা হচ্ছে ‘জীবন’। এটি কেবল হতাশার কথা তাই নয়, এর চেয়ে বড় আর কিছু এই মুহুর্তে হতে পারে না। আমাদের দেশে মানুষের সংখ্যাটা অনেক বেশি বলেই কি তাদের জীবন এত মূল্যহীন?

হার্ড ইমিউনিটির কার্যকারিতার ব্যাখ্যায় যাবার আগে এটি কীভাবে কাজ করে তা সংক্ষেপে বলা যাক। কোন একটি অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ যখন একটি ভাইরাসের প্রতি ইমিউন বা প্রতিরোধী হয়ে ওঠে, তখন বলা যায় যে ঐ বিশেষ জনপদটি সামষ্টিকভাবে ইমিউনিটি বা প্রতিরোধ ব্যবস্থা অর্জন করেছে। তখন কোন একজন ব্যক্তি যদি আক্রান্ত হয়, তবে সে যাদের সংস্পর্শে আসে তাদের অধিকাংশই যেহেতু আগে থেকি ইমিউন তাই, রোগটি আর খুব বেশি মানুষকে সংক্রমণ করতে পারে না।

সাধারনত একটি দেশের ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ মানুষ যখন সংক্রমিত হয়ে যায়, তখন দেশটি Herd Immunity তে পৌঁছায়। তবে এই সংখ্যাটা একেবারে সত্য নয়, কোন মহামারি কতটা সংক্রামক, তার উপর নির্ভর করে এই সংখ্যাটাও কম-বেশি করতে পারে।

হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করতে হলে আমাদের ১৮ কোটি জনগোষ্ঠীর শতকরা ৬০ থেকে ৬৫ ভাগকে (অথবা আরো বেশি) করোনাতে আক্রান্ত হতে হবে। যারা বেঁচে থাকবে তাদেরকে পুরোপুরি করোনা প্রতিরোধীও হয়ে উঠতে হবে। ব্যপারটা একই সাথে ফ্যান্টাসি এবং হরর এর সংমিশ্রণ। ফ্যান্টাসি এ কারণে যে, আমাদের কাছে এখনো কোন রকম তথ্য প্রমাণ নেই যেটা দাবি করে যে একই মানুষ একাধিকবার করোনায় আক্রান্ত হতে পারে না, বরং একাধিকবার আক্রান্ত হবার খবর আমরা দেখেছি এবং সেটা কেবল বৃদ্ধ রুগ্ন মানুষের ক্ষেত্রে নয়। একেবারে সুঠাম কমবয়সী মানুষের ক্ষেত্রে ঘটেছে।

অন্যদিকে হরর বা ভয়াবহ একারণে যে আমাদের ১৮ কোটি মানুষের ৬০ থেকে ৬৫ ভাগ মানুষ বলতে কিন্তু বোঝায় একটি অবিশ্বাস্য রকমের বড় সংখ্যা। যদি করোনা আক্রান্ত রোগীর শতকরা ৫ ভাগও হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় এবং শতকরা ১ ভাগ মৃত্যুবরণ করে তবে সেই সংখ্যা কত ভয়াবহ হবে সেটা আমরা সবাই বুঝতে পারছি। আমাদের দেশের হাসপাতাল গুলির ধারণ ক্ষমতার কথা চিন্তা করলে ভয়াবহতাটা আরো অনেকগুন বেড়ে যায়।

ব্রিটেন প্রথমদিকে হার্ড ইমিউনিটির এই বিপদজনক কথা ভেবেছিল। তবে বিজ্ঞানী ফার্গুসনের মডেলে তাদের প্রায় ৫ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর প্রেডিকশন দেখে তাদের টনক নড়ে ওঠে এবং তারা এই ভয়ঙ্কর চিন্তা থেকে সরে আসে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রোগত্বত্ত্ব বিশেষজ্ঞ ডাঃ মারিয়া ভ্যান কারকোভ তাই সরকারগুলিকে বারবার সাবধান করছেন অপেক্ষা করবার জন্য। একটা কার্যকরী ঔষধ কিংবা ভ্যাকসিন না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা ছাড়া আমাদের এখনো দ্বিতীয় কিছু ভাববার সময় আসে নি।

‘হার্ড ইম্যুনিটির’ জন্য সুইডেন এর উদাহরণ অনেকে ব্যবহার করেন। সুইডেন অনেক স্বল্প জনসংখ্যার একটি দেশ বলে পারসন-টু-পারসন সংক্রমণ হওয়ার ঝুঁকি কম ছিল। তাছাড়া সেদেশের জনগণ অনেক সচেতন কিন্তু তারাও সাম্প্রতিক সময়ে পার্শিয়াল লক ডাউনের কথা ভাবছে। সুইডেনে যেখানে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে মাত্র ২৫ জন মানুষ বসবাস করে, সেখানে বাংলাদেশের প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ১১০০ জনেরও অধিক মানুষ বাস করে। অর্থাৎ স্যাটায়ারিক ভাবে বলা যায়, বাংলাদেশের জনবসতির ঘনত্বের সাথে তুলনা করলে সুইডেন সবসময়ি আইসোলেশনে থাকে। তাই কোনভাবেই এই দুই দেশের তুলনা বাস্তব সম্মত নয়।

এতদিন দেশ লকডাউন করার পর এখন হার্ড ইমিউনিটির কথা বললে জনগণ ব্রিভান্ত হবে।পাশাপাশি যারা এতদিন সোশ্যাল ডিস্টেন্সের নিয়ম মেনে চলছিল তারাও নিয়মের প্রতি উদাসীন হবে । কাজেই হার্ড ইমিউনিটির কথা না বলে আমাদের উচিত হবে:
(১) দেশজুড়ে টেস্ট করার পরিমান আরো বাড়ানো । বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৪০০০-৫০০০ টেস্ট করা হচ্ছে অর্থাৎ প্রতি ১ মিলিয়ন মানুষের মধ্যে মাত্র ৩৬৩ জন। যা যথেষ্ট নয়।

(২) টেস্ট করে পাওয়া আক্রান্ত ব্যক্তিদের ট্রেসিং করতে হবে। অর্থাৎ, আক্রান্ত ব্যক্তির টেস্ট পজিটিভ আসার আগে তার দ্বারা যারা সংক্রমিত হতে পারে তাদের চিহ্নিত করা। এভাবে ট্রেসিং করে ঝুঁকির মাঝে থাকা ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে তাদের জানাতে হবে এবং কোয়ারেন্টাইন করতে হবে।

(৩) গার্মেন্টস, শপিংমলসহ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরী করতে হবে, যাতে তারা কর্মক্ষেত্রে সকল কর্মচারীর জন্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, প্রতিষ্ঠানগুলোতে ডিস-ইনফেক্ট্যান্ট ব্যবহার, প্রবেশের পূর্বে তাপমাত্রা পরীক্ষা করা, স্যানিটাইজার সরবরাহ এবং ব্যবহার করা, কেউ অসুস্থ হলে নোটিফাই করা বাধ্যতামূলক করা, দুজন কর্মচারীর মাঝে কিছুটা দূরুত্ব বজায় রাখা এবং করোনা প্রতিরোধে বেসিক ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করা। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো এসব নীতি মেনে না চললে জরিমানাসহ শক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।

(৪) জনগণের মাঝে সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং এবং হাইজিন-এর (হাত ধোয়া, স্যানিটাইজার ব্যবহার করা, মাস্ক ব্যবহার করা) চর্চা করার জন্য জনসচেতনতা বাড়ানোর জন্য সোশ্যাল ক্যাম্পাইনের ব্যবস্থা করতে হবে। তবে তাও হতে হবে নিয়ম মেনে। আমরা অনেক দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের দেখেছি ৫০ ব্যাগ রিলিফ দিতে শতাধিক মানুষের বহর নিয়ে শোডাউন করতে। এতে জনস্বাস্থ্য আরো ঝুকির মধ্যে পড়বে।

(৫) অসুস্থদের চিকিৎসাসেবা অব্যাহত রাখার জন্য চিকিৎসকদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে।
পৃথিবীর প্রত্যেকটা দেশই এখন করোনার সাথে লড়ছে। যার যা কিছু আছে সবটুকু সম্বল নিয়ে। বাংলাদেশের লড়াই চলছে, তবে এখনই কোনভাবেই হাল ছাড়ার সময় নয়।

ডা. শাহরিয়ার রোজেন, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
এবং
মুহাম্মদ রহমান, প্রকৌশলী ও পিএইচডি গবেষক

Platform

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

অসহায় হতদরিদ্রদের পাশে 'সোসাইটি অফ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল স্টুডেন্টস অফ কুমিল্লা'

Wed May 6 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, বুধবার, ৬ মে, ২০২০ করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকার ঘোষিত লকডাউনের এই উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অসহায় হতদরিদ্রদের পাশে এবার এগিয়ে এসেছে কুমিল্লার মেডিকেল ও ডেন্টাল শিক্ষার্থীদের সমাজসেবামূলক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘সোসাইটি অফ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল স্টুডেন্টস অফ কুমিল্লা’। সংগঠনটির পক্ষ থেকে এই মহামারি অবস্থায় কুমিল্লা শহরের কালিয়াজুরিতে গরিব ও অসহায় […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo