যাপিত জীবন -মৌমিতা দাস

প্ল্যাটফর্ম সাহিত্য সপ্তাহ -৪২

” যাপিত জীবন “

লেখক : মৌমিতা দাস
ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ
২০১৩-১৪ সেশন

জোড়হাতে সামনে দাঁড়িয়ে চোখ দিয়ে ইশারা করলাম, আশা করেছিলাম কাজ হবে।

কিন্তু ম্যান প্রোপোজেজ, ওম্যান ডিস্পোজেজ।

নাকচ হয়ে গেল।

এমনই হয় । সব আশায় কাজ হয়না ।

এইযে যেমন এতক্ষণে আপনারা ভেবে বসেছেন নির্ঘাত কোন প্রেমিক পুরুষ প্রেমভিক্ষায় করজোড়ে দাঁড়িয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে ,

কিন্তু আপনারা কেউ ভাবেননি যে আমি

ওটিরুমে সার্জিকাল ওয়াশ নিয়ে স্টেরাইল পজিশনে দাঁড়িয়ে অনুকে চোখের ইশারায় অনুরোধ করেছিলাম আমার সার্জিক্যাল গাউনটা যেন বেঁধে দেয় এবং সে বদলে নির্দয়ের মত সিস্টারকে ডেকে দিয়ে চলে গেছে।

মেডিকেল সেক্টরে এই এক দিক, দিনকতক আগে স্টুডেন্ট ছিলো, এখন হয়েছে ইন্টার্ন।

মানে কলিগ।

অথচ এইতো সেদিনই আইটেম টেবিলে লং ব্লেডেড অবস্টেট্রিক ফরসেপ্স ধরতে বললাম, সাইড ডিটারমিনেশন করতে পারলোনা,পেশেন্ট ডিলিং এ ক্লিনিশিয়ানের ক্রাইটেরিয়া জিজ্ঞাসা করলে সিম্প্যাথি ও এম্প্যাথি বলতে পারলোনা, পেন্ডিং দিয়ে বের করে দিলাম।

তার দিনদুয়েক পরে কি যেন একটা প্রোগ্রামে একটু পরিপাটি হয়ে আসা অনুর দিকে তাকিয়ে এই আপাত বুড়ো বয়সে নিজেকে একটা প্রশ্ন করলাম এবং জীবন বহুদিন পরে দ্বিতীয়বারেরমত ঠিক উত্তরে পেন্ডিং দিয়ে বের করে দিল।

নতুন ইন্টার্ন। শিখিয়ে দিতে হয়।

মেয়েটাকে দৌড়ের উপর রাখি। এই এখন এটা তো তখন ওটা।

আমার ম্যাকেনটশ, নোটস, আরও দরকারি অদরকারি হাবিজাবি বিভিন্ন কারণে রেজিস্টার রুমের চাবিটা ওর হাতেই দিই ।

সবাই দেখে খুব খাটিয়ে নিচ্ছি।

সকালে রাউন্ডে যাবার সময় ডেকে নিয়ে যাই।

দ্রুত শব্দে প্রত্যেকটা বেডের অর্ডার বলে দিই।

স্লিপ প্যাডে লিখতে লিখতে তাল হারিয়ে ফেললে শক্ত করে কথা বলি, রাজ্যের বিরক্তি স্পষ্ট শোনা যায়, ও কাঁপাকাঁপা হাতে গুছিয়ে নেয়।

এর বেশিকিছু কাউকে দেখতে দেওয়া হয়না।

মাঝেমধ্যে যে কাজের বাইরে কথা হয়না, তা না।

এই যেমন গতকাল।

সন্ধ্যায় দুটো প্রাইমারি পিপিএইচ পেশেন্টকে ইমিডিয়েট ম্যানেজমেন্ট দিয়ে অর্ডারের কাগজ নিয়ে ইউনিটে আসলো মেয়েটা।

আমি এককাপ চা করে দিতে বলে খেয়াল করলাম ওর মুখটা কেমন যেন,মনমরা।

পেশেন্ট এক্সপায়ার করেনি একটাও, করলে এসেই বলতো।

তবে অন্যকিছু হবে। পরিবেশ হালকা করতে হেসে বললাম, ” চা বানাতে বললাম বলে রেগে গেলে নাকি?”

শুনে হাসলো। ফিলসফিকাল হাসি।

জিজ্ঞাসা করলো, “স্যার, একই কেবিনে দুটো পাশাপাশি বেডে কত পার্থক্য, তাইনা! ”

রেজিস্টারদের ইন্টার্নরা স্যার বলেনা সাধারণত ,কিন্তু এই মেয়েটা বলে। ডিরেক্ট স্টুডেন্ট ছিলো কয়েকদিন,এজন্যই হয়তো।

একদিকে ভালো।

অমুকদা বলে ডাকেনা এটলিস্ট।

যাকগে , শুনে ভাবলাম একটু অভিজ্ঞতা ঝেড়ে দিই। বললাম,

“টিপিক্যাল বাঙালি ইন্সটিংক্টেই পাশাপাশি দুটো বেডের রোগী এবং তাদের এটেন্ডেন্টদের মধ্যে বেশ ভালো সম্পর্ক তৈরী হয়ে যায় ।

একবার হয়েছে কী,

তখন আমার তোমার বয়স,নতুন ইন্টার্ন। একদিন প্রোল্যাপ্স উইথ ডিকিউবিটাস আলসারের রোগীর মাস রিপজিশন করতে গিয়েছি ,গিয়ে দেখি অর্ধেকটা কেবিন ,ইনক্লুডিং আমার পেশেন্ট দরজার কাছের বেডের কাছে ভীড়ে দাঁড়িয়ে আছে ।

ভাবলাম কী না কী, খারাপই হয়ে গেল নাকি কেউ,

ঘটনা বুঝতে কাছে গিয়ে দেখি সেই বেডের চাচীর মেয়ের বিয়ে,সবাইকে ডেকে শাড়ি দেখাচ্ছে!

মানুষ শেষতক মানুষ ; আর তারচেয়েও বেশি বাঙালি হাজার হলেও বাঙালি!

হা হা! ”

মেয়েটা আমার কথা শুনলো।

অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে রইলো।

এত গ্রসলি বলে, সুযোগ থাকার পরও মহিলা মহল ইঙ্গিত করে খোঁচা না দিয়ে বলা মজার কথাটায় হাসি না দিয়ে অবাক কেন হলো, তা বুঝতে আমার সময় লাগলোনা।

ডিপার্টমেন্টাল হেড ছাড়া আমি আর কারও সামনে হাসি না বলে যে কথা প্রচলিত আছে,তা ডিপার্টমেন্টের দরজা-জানালাও জানে,

তাই সামনাসামনি কেউ না বললেও আমি জানি কেন ওর এমন রিয়্যাকশন!

চায়ে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “সে কি! হাসি পেলোনা ?”

সে কাজের বাইরে আমার সাথে বেশি কথা বলেনা ।

একটা অর্ডারে সিরিয়ালে সব লিখতে লিখতে বললো, “পেশেন্ট শিখা,বাচ্চার বয়স তিনদিন, মায়ের দুধ পাচ্ছেনা। ডমপেরিডনের ডোজটা কত স্যার?”

বলে দিলাম।

এটা শেষ করে পরের অর্ডারটা ধরলো।

পেশেন্ট রিক্তা ,সেম কেইস, প্রাইমারি পিপিএইচ,তিনদিন আগে বাসায় দাইয়ের হাতে ডেলিভারি ।

এটা লিখতে গিয়ে দু সেকেন্ড দেরী করলো।

ক্লান্ত চেহারাটা আর একটু অন্ধকার করে ফ্রেশ অর্ডারে খসখস করে কলম চালাতে চালাতে বললো

“তিনদিন আগে স্টিলবর্ন চাইল্ড। ইনার ক্যাবারগোলিন এর ডোজ কেমন হবে স্যার?”

বলে দিলাম। নতুন জয়েনিং। শিখিয়ে দিতে হয়।

তবে কেন জানিনা, আমার অযথাই মনে পরে গেল, বেশ কতদিন আগে এক সন্ধ্যায় এম্পাথি না বলার জন্য একজনকে পেন্ডিং দিয়েছিলাম।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

অপূর্ণ পূর্ণতা ২ - সুমাইয়া সুগন্ধি।

Thu Sep 6 , 2018
প্ল্যাটফর্ম সাহিত্য সপ্তাহ -৪৫ || অপূর্ণ পূর্ণতা ২ || লেখক – সুমাইয়া সুগন্ধি। শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ মেডিকেল কলেজ। ৩য় বর্ষ “জানি না আজ কথা গুলো কেন লিখছি, কিভাবে লিখছি।। আমি আদৌও জানি না একথা গুলো লিখে কোন লাভ হবে কিনা?? আচ্ছা, লাভ – লোকসানের হিসেব করে কি প্রেমে অংকটার সমাধান […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo