মেডিকেলিও যন্ত্রপাতিঃ থার্মোমিটার

ছোটবেলায় যখন জ্বর আসতো, সেই অসুস্থ সময়ে একটা আনন্দের উপলক্ষ্য ছিল বাবা যখন জিভের নিচে থার্মোমিটারটা রাখতেন। বাবার হাত থেকে নিয়ে যন্ত্রটা উঁচু করে ধরে খুব জ্ঞানীর মতো দেখতাম আর মনে মনে ভাবতাম বাবা আসলে ওর মধ্যে দেখেটা কি? কলেজে ওঠার আগ পর্যন্ত থার্মোমিটারের পারদটা কেবল খুঁজেই গেছি, চোখে পড়েনি (একটু গাধা টাইপের ছিলাম কিনা 🙂 )। সে যাক, আসল কথায় আসি। আমরা এখন যে ধরণের পারদ থার্মোমিটার ব্যবহার করি, সেটা প্রথম তৈরি করেছিলেন স্যার থমাস ক্লিফোর্ড আলবাট ১৮৬৬ সালের দিকে।

মানবদেহের তাপমাত্রা পরিমাপের ইতিহাসটা কিন্তু নতুন নয়। সেই প্রাচীন মিশরীয়, ভারতীয় বা গ্রিক সভ্যতায় যখন বিশ্বাস করা হতো যাবতীয় রোগের কারণ হলো কালো পিত্ত, হলুদ পিত্ত, রক্ত আর কফ তখন থেকেই এসবের পরিবর্তনের সাথে তাপমাত্রার সম্পর্ক নির্ণয়ের চেষ্টা করা হয়। তবে আধুনিক থার্মোমিটারের পূর্বপুরুষ হলো বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী গ্যালিলিও আবিষ্কৃত ‘ওয়াটার থার্মোস্কোপ’ (১৫৯২), যাতে একটি গ্লাস জারে পানির ভেতর কিছু রঙিন লিকুইড ক্রিস্টালের বল রাখা ছিল। তাপমাত্রার পরিবর্তন হলে পানির আয়তন ও ঘনত্ব পরিবর্তন হতো আর তার সাপেক্ষে বলগুলো কখনো ডুবে যেত, কখনো ভেসে থাকত। বলের অবস্থান দেখে তাপমাত্রা পরিবর্তন হয়েছে কিনা সেটা বলে দেয়া যেত; কিন্তু কতখানি পরিবর্তন হয়েছে সেটা বোঝা যেত না, কেননা গ্যালিলিও তাঁর থার্মোস্কোপে কোনো স্কেল ব্যবহার করেননি। এ সমস্যার সমাধান করেছিলেন আরেকজন ইতালীয় চিকিৎসাবিজ্ঞানী সান্তোরিও সান্তোরি (১৬১২) থার্মোস্কোপের সাথে কার্যকরী স্কেল ব্যবহার করে।

থার্মোমিটারে পানি ব্যবহারের একটা অসুবিধা ছিল তাপে পানির সংকোচন প্রসারণ খুব ধীরে হয়। তাই পানির একটা উত্তম বিকল্প দরকার হয়ে পড়েছিল। ১৬৫৪ সালের দিকে ফার্দিনান্দ দ্য মেডিকি আবদ্ধ থার্মোমিটারে পানির পরিবর্তে এলকোহল ব্যবহার শুরু করেন। আর প্রথম পারদ থার্মোমিটার তৈরি করেন ডাচ পদার্থবিজ্ঞানী ড্যানিয়েল গ্যাব্রিয়েল ফারেনহাইট ১৭১৪ সালে, যিনি আবার ফারেনহাইট স্কেল (১৭২৪) এরও জনক। আরেকটি স্কেল হলো সেলসিয়াস স্কেল, যার জনক সুইডিশ জ্যোতির্বিদ আন্দ্রে সেলসিয়াস (১৭৪২); যদিও এর প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যায় ১৬৬৫ সালে ডাচ গণিতবিদ ক্রিশ্চিয়ান হাইগেনস এর গবেষণায়। তবে মজার বিষয় হলো সেলসিয়াসের তৈরী স্কেলটি ছিল বর্তমান সেলসিয়াস স্কেলের উল্টো। তিনি পানির স্ফুটনাঙ্ক কে 0 এবং বরফের গলনাঙ্ক কে 100 ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড হিসেবে ধরেন। 😮 পরবর্তীতে ১৭৪৪ সালে সুইডিশ উদ্ভিদবিজ্ঞানী ক্যারোলাস লিনিয়াস একে বর্তমান রূপ দেন। অবশ্য সমসাময়িক কালে (১৭৪৩) আরো একজন একই ধরণের থার্মোমিটার তৈরি করেন; তিনি পদার্থবিজ্ঞানী জিন পিয়েরে ক্রিস্টিন।

সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে মেডিকেল থার্মোমিটারের ব্যবহার খুবই সীমিত ছিল। ডাচ চিকিৎসক এন্টন দ্য হেন (১৭০৪-১৭৭৬) বলেছিলেন, রোগীর শরীরের তাপমাত্রার পার্থক্য তার রোগ সম্পর্কে ভালো ধারণা দিতে পারে। কিন্তু তাঁর চিকিৎসক বন্ধুরা তাঁর কথায় তেমন একটা পাত্তা দেননি। আর দেবেনই বা কেন, ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্তও থার্মোমিটারগুলো ছিল প্রায় ১ ফুট লম্বা এবং সঠিক তাপমাত্রা দিতে সেগুলো প্রায় ২০ মিনিট সময় নিত। এত সময় ধরে তাপমাত্রা মাপলে তাঁরা রোগীর চিকিৎসা দেবেন কখন? এ সমস্যার সমাধান মিলল যখন স্যার থমাস ক্লিফোর্ড আলবাট ৬ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের একটি মেডিকেল থার্মোমিটার তৈরি করেন, যার তাপমাত্রা মাপতে সময় লাগতো মাত্র ৫ মিনিট।

আজ আমরা জানি সুস্থ মানুষের শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা 36.3 থেকে 37.5 °C (97.34 থেকে 99.5 °F) এর মধ্যে থাকে। সিদ্ধান্তটা দিয়েছিলেন জার্মান চিকিৎসক প্রফেসর কার্ল রিনোল্ড অগাস্ট ওন্ডারলিক তাঁর বিখ্যাত গবেষণাপত্রে (১৮৬৮) যেখানে তিনি প্রায় পঁচিশ হাজার রোগীর ১ মিলিয়নেরও বেশি তাপমাত্রার রিডিং এর তথ্য সন্নিবেশিত করেছিলেন। বোঝাই যাচ্ছে, চিকিৎসক হিসেবে তিনি নিশ্চয় খুব জনপ্রিয় ছিলেন। 🙂

জার্মান-আমেরিকান চিকিৎসক Theodor H. Benzinger ১৯৬৪ সালে প্রথম টিমপ্যানিক থার্মোমিটার তৈরি করেন এবং এতে ইনফ্রা রেড প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয় ১৯৮৪ সালে ডেভিড ফিলিপস এর হাত ধরে। তবে মজার বিষয় হলো সেই প্রাচীনকাল থেকে মানুষ কপালে হাত দিয়ে তাপমাত্রা দেখলেও কপালের তাপমাত্রা মাপার জন্য প্রথম থার্মোমিটার তৈরি হয় ১৯৯০ এর দশকে, যাতে একটি প্লাস্টিক স্ট্রিপে লিকুইড ক্রিস্টাল বসানো ছিল, যা তাপমাত্রা পরিবর্তনের সাথে রং পরিবর্তন করতো। পরবর্তীতে অবশ্য এতে ইনফ্রা রেড প্রযুক্তি যুক্ত হয়।

পরবর্তী বছরগুলোতে দেহের তাপমাত্রা পরিমাপের পদ্ধতির আরো উন্নয়ন সাধিত হয়েছে, ব্যবহৃত হচ্ছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। এই যেমন ২০১৬ সালে বাজারে আসা ‘Thermo’ ১৬ টি ইনফ্রা রেড সেন্সরের সাহায্যে Temporal artery এর তাপমাত্রা সর্বোচ্চ নিখুঁতভাবে মাপতে পারে এবং বয়স অনুসারে color-coded fever feedback দিতে পারে, যা একজন রোগী কিংবা চিকিৎসক খুব সহজেই তাঁর স্মার্টফোনের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। দেহের উষ্ণতা মাপার এ প্রযুক্তি দিন দিন আরো উন্নত হবে, এমনটা আশা করাই যায়। 🙂

………
আব্দুর রাফি,
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ।

drferdous

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

থ্যালাসেমিয়া-বংশগত রোগ,জানুন ও সচেতন হোন

Fri Sep 15 , 2017
লিখেছেনঃডা. নুসরাত সুলতানা লিমা সহকারী অধ্যাপক ভাইরোলজি বিভাগ পি এইচডি অধ্যয়নরত ( মেডিকেল জেনেটিক্স) বহুল আলোচিত রোগের মধ্যে অন্যতম থ্যালাসেমিয়া। এটি একটি বংশগত রক্তজনিত রোগ।বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ, ভারতে এর প্রকোপ বেশি। Non communicable disease গুলোর মধ্যে থ্যালাসেমিয়া ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। এর কোন প্রতিকার নেই।হিমোগ্লোবিনের ডিফেক্টের কারনে লোহিত […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo