বিজ্ঞান ও বিস্ময়ঃ পর্ব-০৪।। তিন মা-বাবার সন্তান

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৩১ আগস্ট, ২০২০, সোমবার 

ডা. আসির মোসাদ্দেক সাকিব
ডেন্টাল সার্জন,
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ।

আমরা সবাই দুই মা-বাবার সন্তান। কিন্তু লেখাটা লিখছি তিন মা-বাবার সন্তান নিয়ে। শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর ভেতরে আধুনিক টেস্ট টিউব বেবি বা যাকে ডাক্তারি ভাষায় আইভিএফ (in vitro fertilization) বলে সেটার সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা আছে। তাছাড়া আধুনিক পৃথিবীতে সারোগেসি বা গর্ভ ভাড়া দেয়ার করুণ পদ্ধতি সম্পর্কেও অনেকেই হয়তো জানে। কিন্তু এখানে যে তিন মা-বাবার সন্তানের কথা বলছি সেটা সম্পূর্ণ ভিন্ন ও ২০১৫ সালের আগে মানুষের মধ্যে কেউ বাস্তবিক ভাবে চোখে দেখেনি। ঘটনায় চলে আসি সরাসরি।

ছবিঃ প্রতীকী

জর্ডানের এক মুসলমান দম্পতি ১৯৯৫ সালে বিয়ে করেছিল। কিন্তু ১০ বছর পরেও এরা কোন সন্তানের মুখ দেখলো না। এই দশ বছরে ৪ টা গর্ভপাত হলো একে একে। ২০০৫ সালে পঞ্চম বারে এক কন্যা সন্তানের জন্ম হল। কিন্তু এই মেয়ের বয়স যখন ৫ বছর তখন ডাক্তারেরা তার একরকম জেনেটিক রোগ ধরতে পারে। এটাকে লেইহ সিন্ড্রোম (Leigh syndrome) বলে। এই লেইহ সিন্ড্রোম টা হয় ম্যাটারনাল মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ তে গোলযোগের জন্য।

নন-মেডিকেল পাঠকের সুবিধার জন্য দুই লাইন বাড়িয়ে বলি। মাইটোকন্ড্রিয়া হলো আমাদের প্রতিটা কোষের ভেতরে থাকা একটা অতি ক্ষুদ্র অঙ্গাণু যাকে আমরা বলি “কোষের ব্যাটারি”। এগুলো কোষের চালনা শক্তি দেয়। এখন আমরা যখন মাতৃগর্ভে তৈরি হই তখন মা আর বাবার শুক্রাণু আর ডিম্বাণুর সব উপাদানের প্রায় সমবন্টণ হলেও মায়ের কিছু বাড়তি জিনিস আমাদের দেহে থাকে। ডিএনএ বা ক্রোমোজোম প্রধানত কোষের প্রাণকেন্দ্র নিউক্লিয়াসে থাকে। নিউক্লিয়াস বহির্ভূত একমাত্র সামান্য কিছু ডিএনএ থাকে এই মাইটোকন্ড্রিয়ায়। আমাদের দেহের সব কোষের নিউক্লিয়াসের ক্রোমোজোমে মা-বাবার শুক্রাণু ডিম্বাণুর নিউক্লিয়াসের ক্রোমোজোম থাকলেও আমাদের প্রত্যেক কোষের এই মাইটোকন্ড্রিয়ায় যেসব ডিএনএ থাকে সেসব আসে পুরোটাই মায়ের ডিম্বাণুর মাইটোকন্ড্রিয়া (ডিম্বাণুর নিউক্লিয়াস থেকে নয়) থেকে, সেখানে বাবার কোন ভাগ নেই। এগুলোকেই আমি “ম্যাটারনাল মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ” বললাম।

এই বাচ্চা মেয়ের লেইহ সিন্ড্রোম টি হয় এই মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ তে গোলযোগের কারণে। তার মানে এই রোগের জন্য তার মা-ই দায়ী। এই রোগটি হলে মস্তিষ্ক ও অন্যান্য স্নায়ু সহ মাংসপেশি ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়। জেনেটিক রোগ হিসেবে এর কোন প্রতিকার আজও বের হয়নি। জর্ডানী দম্পতির সেই মেয়ে ৬ বছর বয়সেই মারা গেলো। এর পরে আরেকটা বাচ্চা হলো যে একই রোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৮ মাস বয়সে মারা গেলো। এই অসহায় দম্পতি বাধ্য হয়ে ইংল্যান্ডের নিউক্যাসল ফার্টিলিটি সেন্টারে যোগাযোগ করলো। এই উচ্চমানের জেনেটিক গবেষণা কেন্দ্রটি এরকম জেনেটিক ব্যাপার গুলো নিয়ে কাজ করে। এরা ১৯৮৩ সাল থেকে এই লেইহ সিন্ড্রোমের মতো মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ ঘটিত রোগ গুলো থেকে পরিত্রাণের জন্য উপায় খুঁজে আসছে। ১৯৯৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সির সেইন্ট বার্বানাস মেডিকেল সেন্টারের গবেষকেরা মাইটোকন্ড্রিয়াল রিপ্লেসমেণ্ট থেরাপি নামের একটা উপায় বের করেন। সেটা নিয়ে ২০০৪ সাল থেকে ইংল্যান্ডের এই প্রতিষ্ঠান আরো উন্নততর গবেষণা ও মানুষের উপরে প্রয়োগের উপায় চিন্তা করে আসছিল। এরা “প্রো নিউক্লিয়ার ট্রান্সফার” নামের একটা পদ্ধতি প্রথম মানুষের উপরে প্রয়োগ করার চেষ্টা করে।

ছবিঃ প্রো নিউক্লিয়ার ট্রান্সফার

এই পদ্ধতিতে একজন অন্য সুস্থ মহিলা ও জেনেটিক রোগে আক্রান্ত মা এই দুইজনের দুইটা ডিম্বাণু সংগ্রহ করা হবে। দুই ডিম্বাণুকে এক বাবার দুইটা শুক্রাণু দিয়ে নিষিক্ত করা হবে। এর পরে দুই নিষিক্ত ডিম্বাণুর নিউক্লিয়াস বের করে ফেলা হবে। সুস্থ মহিলার নিউক্লিয়াসবিহীন ডিম্বাণুতে অসুস্থ মায়ের নিষিক্ত নিউক্লিয়াস টা ঢুকিয়ে দেয়া হবে ও এই মিক্স ডিম্বাণুটা অসুস্থ মায়ের পেটে রেখেই বাচ্চা বড় করা হবে। এতে সুবিধা হল মায়ের ডিম্বাণুর নিউক্লিয়াস ঠিক থাকলেও ডিম্বাণুর মাইটোকন্ডিয়া অসুস্থ ছিল এবং সেই অসুস্থ মাইটোকন্ড্রিয়া সমৃদ্ধ ডিম্বাণু দেহ থেকে নিউক্লিয়াস টা বের করে সুস্থ মাইটোকন্ড্রিয়া সমৃদ্ধ ডিম্বাণু দেহে ঢুকানোর ফলে হবু সন্তানটি অসুস্থ মাইটোকন্ড্রিয়া থেকে বেঁচে গেলো। এই অতি সূক্ষ্ম পদ্ধতিটি সেই জর্ডানী দম্পতিকে ধীরে সুস্থে বুঝিয়ে দেয়ার পর কিছুক্ষণ তাঁরা আলাপ করে নাবোধক সায় দিল। কারণ তারা মুসলমান হিসেবে সেই পদ্ধতির একটা বাতিলকৃত নিষিক্ত ডিম্বাণু মেনে নিতে পারছিল না। তাঁরা বললো যে এমন কোন পদ্ধতি যদি থাকে যাতে ডিম্বাণু একবারই নিষিক্ত হবে ও কোন নিউক্লিয়াসের হবু প্রাণকে নষ্ট করতে হবেনা – সেই পদ্ধতি হলে তাঁরা গ্রহণ করতে রাজি আছেন। এই প্রস্তাব শুনে নিউক্যাসল ফার্টিলিটি সেন্টার খুব ঝামেলায় পড়লো ও হিউম্যান ফার্টিলাইজেশন অ্যান্ড এম্ব্রায়োলজি অথোরিটি (হেফা) এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যোগাযোগ করে। নিউইয়র্ক ফার্টিলিটি সেন্টারের লিডিং গবেষক চীনা বংশোদ্ভূত ড. জন ঝ্যাং এরকম একটা সুযোগ খুঁজছিলেন। কারণ তিনি বিভিন্ন টেকনিক উদ্ভাবন করলেও মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে সেগুলোর হিউম্যান ট্রায়াল করতে পারছিলেন না। ইংল্যান্ডে আসার পরে তিনি জর্ডানী দম্পতির জন্য প্রোনিউক্লিয়ার ট্রান্সফারের বদলে ম্যাটারনাল স্পিন্ডল ট্রান্সফার নামক আরেকটা পদ্ধতি প্রয়োগ করেন। এই সিস্টেমে শুক্রানু দিয়ে নিষিক্ত করার আগেই সুস্থ নারীর ও অসুস্থ মায়ের ডিম্বাণুর নিউক্লিয়াসটা বের করে আনা হয়। এর পরে অসুস্থ মায়ের নিউক্লিয়াস সুস্থ নারীর ডিম্বাণু দেহে ঢুকিয়ে একটা সুস্থ মিক্সড ডিম্বাণু তৈরী করা হয়। সেই ডিম্বাণুকেই একবারই আসল বাবার একটি মাত্র শুক্রাণু দিয়ে নিষিক্ত করা হয়, তারপর সেই নিষিক্ত ডিম্বাণু অসুস্থ মায়ের জরায়ুতে বড় হবে ও স্বাভাবিক টাইমেই ডেলিভারি হবে। এটা ড. ঝ্যাং “থ্রি প্যারেন্ট টেকনিক” বলে সম্বোধন করেন ঐ মা বাবার কাছে। যদিও এটার ডাক্তারি নাম মেটার্নাল স্পিন্ডল ট্রান্সফার সিস্টেম। শেষমেশ ২০১৫ সালে এই পদ্ধতির স্বপক্ষে হেফা এর সহযোগিতায় সরকারি লাইসেন্স পাওয়া যায় ও দ্রুত সেই দম্পতির উপরে প্রয়োগ করা হয়। অবশেষে ৬ এপ্রিল ২০১৬ সালে পৃথিবী প্রথম দেখলো তিন মা-বাবার ঔরসে জন্ম নেয়া এক পুত্র সন্তান।

ছবিঃ থ্রি প্যারেন্ট টেকনিক

এর পর থেকে আজ পর্যন্ত বেশকিছু বাচ্চার এভাবে জন্ম হয়েছে পৃথিবীতে। যেহেতু এই পদ্ধতিতে জন্মানো বাচ্চাদের বয়স এখনো মাত্র কয়েক বছর, তাই ছোট বেলায় এরা রোগ মুক্ত থাকলেও এদের পরবর্তী প্রাপ্তবয়ষ্ক জীবনে কোন ঝামেলা হচ্ছে কিনা সেটা বুঝা যায়নি এখনো। এই কারণে এই টেকনিক পৃথিবীর সবখানে এখনো লিগালাইজেশন হয়নি। মার্কিন দেশে কেবল ৪২ থেকে ৪৭ বছর বয়ষ্ক মহিলাদের খুব প্রয়োজন না হলে এই পদ্ধতি ব্যবহার করার অনুমতি দেয়া হয়না। মুসলিম দেশ গুলোতে প্রথম প্রথম এটার প্রতি অনাগ্রহ থাকলেও পরবর্তীতে এই পদ্ধতির বিস্তারিত জেনে, এখানে কোন ভ্রুন হত্যা হচ্ছেনা দেখে ও সরাসরি শরীয়ত বিরোধী কিছু হচ্ছেনা বুঝতে পেরে অনেকে এটার দারস্থ হওয়ার চিন্তা করছেন। যদিও এই পদ্ধতি কার্যকরী, তবে ব্যাপক গবেষণার অপ্রতুলতায় এখনো সীমাবদ্ধ বলা যায়। সম্প্রতি জেনেটিক গবেষণায় যে CRISPR gene editing পদ্ধতির ব্যাপক জনপ্রিয়তা আছে, জেনেটিক রোগ সারাতে সেটা প্রয়োগ করা গেলে এই তিন মা-বাবার পদ্ধতির প্রয়োজন নাও হতে পারে বলছেন মার্কিন গবেষকেরা। কিন্তু CRISPR এর মানব ট্রায়ালের আগে পর্যন্ত এই “থ্রি প্যারেন্ট টেকনিক”  টা প্রায় ১০ থেকে ১১ প্রকার জেনেটিক রোগ সারাতে ব্যবহার করা যেতে পারে।

Md. Nafiul Islam

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

স্থূলকায় ব্যক্তির ক্ষেত্রে করোনা ভ্যাক্সিনের কার্যকারিতা হ্রাসের আশঙ্কা

Mon Aug 31 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৩১ শে আগস্ট, ২০২০, সোমবার হাসপাতালে কোভিড-১৯ এর চিকিৎসার ক্ষেত্রে দ্বিগুন ঝুঁকিতে আছেন স্থূলকায় ব্যক্তিরা। তাদের ক্ষেত্রে বাড়ছে মৃৃৃত্যু ঝুুঁকিও। স্থূলতার কারণে সাধারণত ডায়াবেটিস, উচ্চ-রক্তচাপসহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দিয়ে থাকে। স্থূলকায় ব্যক্তিদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়াতে তারা কোভিড মোকাবেলার ক্ষেত্রে অত্যন্ত ঝুঁকির মুখে থাকেন। বলা হয়ে […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo