ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানির রিপ্রেজেনটেটিভ কর্তৃক চিকিৎসক ভিজিট এবং নৈতিকতাবোধ

মানব সভ্যতার ঊষালগ্ন হতে, চিকিৎসা পেশা একটি মানবিক এবং মহৎ পেশা হিসেবে সমাজে স্বীকৃত পেশা। আর তাই দল মত নির্বিশেষে সবাই চিকিৎসা পেশার সাথে সংশ্লিষ্ট সকল চিকিৎসক, নার্স এবং স্বাস্থ্যসেবা কর্মীকে সম্মানের চোখে দেখেন। আর সে জন্য চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যসেবার সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে উন্নত নৈতিক চরিত্রের এবং  মানবিক গুণ সম্পন্ন হওয়া আবশ্যক। আর সে জন্য সকল চিকিৎসক এবং নার্সসহ স্বাস্থ্যসেবার সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে “মেডিক্যাল এথিক্স” অনুসরণ করে স্বীয় দায়িত্ব পালন করতে হয়।

চিকিৎসক হিসেবে প্রত্যেক চিকিৎসকের দায়িত্ব অগ্রধিকার ভিত্তিতে রোগীর স্বার্থ রক্ষা করা এবং যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া। নার্স এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য টেকনিশিয়ানরাও স্ব স্ব ক্ষেত্রে স্বীয় দায়িত্ব অনুযায়ী রোগীকে সার্ভিস দেয়ার মাধ্যমে চিকিৎসা দেয়ার ক্ষেত্রে চিকিৎসককে সহযোগিতা করে থাকেন।

রোগীর চিকিৎসার ক্ষেত্রে তাই একজন চিকিৎসক তার অর্জিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, পেশাগত জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, প্রাকটিক্যাল প্রশিক্ষণ লব্ধ জ্ঞান কাজে লাগিয়ে সম্ভব স্বল্পতম খরচের মধ্যে প্রয়েজনীয় অত্যাবশ্যক ইনভেস্টিগেশনের মাধ্যমে রোগ নির্নয় করে এবং সম্ভব স্বল্পতম খরচের মধ্যে চিকিৎসা তথা “ঔষধ” প্রেসক্রাইব করে থাকেন।

ঔষধ কোম্পানি সমূহ তাদের উৎপাদিত ঔষধ বাজারজাত করার উদ্দেশ্যে, চিকিৎসকদের চেম্বারে ঔষধ কোম্পানির প্রতিনিধি (এমআর) গণ চিকিৎসকদের কাছে নতুন প্রোডাক্ট পরিচিত করার উদ্দেশ্যে ভিজিট করে থাকেন।

তাছাড়া ঔষধ কোম্পানির স্পন্সরশীপে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সাইন্টিফিক সেমিনার কিংবা সিম্পোজিয়াম অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে এবং তারাও প্রকারান্তে চিকিৎসককে চিকিৎসা প্রদানের ক্ষেত্রে সহযোগী ফোর্স হিসেবে কাজ করে থাকে।

তবে কখনো কখনো চিকিৎসক এবং ঔষধ কোম্পানির মধ্যকার এই সম্পর্ক যখন সীমাকে অতিক্রম করে, যখন কোম্পানী সমূহ চিকিৎসকদেরকে নিজেদের স্বার্থের অনুকূলে ব্যবহার করার জন্য চিকিৎসকদেরকে বিলাসী সামগ্রী গিফ্ট বা উপঢৌকন হিসেবে প্রদান করে তখন নৈতিকতার প্রশ্নটি উঠে আসে।

পক্ষান্তর চিকিৎসা শিক্ষার উদ্দেশ্যে আয়েজিত সাইন্টিফিক সেমিনার বা আন্তর্জাতিক সম্মেলন গুলো আয়োজনে ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানির সহযোগিতাকে কোন ভাবে অবমূল্যায়ন করার অবকাশ নেই।   তবে বর্তমানে এক্ষেত্রে ঔষধ কোম্পানির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব বিস্তারের প্রশ্ন নিয়ে নৈতিকতাবোধ মূল্যায়নের প্রশ্ন উঠে এসেছে।

আর এ কারণেই ঔষধ কোম্পানি কর্তৃক আয়োজিত এসব অনুষ্ঠান ঔষধ কোম্পানির ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য অর্জনে সহায়ক হলেও এথিক্যাল পয়েন্ট বা নৈতিক ভাবে এসব কর্মকাণ্ড আইনগতভাবে কতটা গ্রহনযোগ্য তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

চিকিৎসক এবং ঔষধ কোম্পানির মধ্যে সম্পর্কটা পিউরলি পেশাগত। এবং তা এটুকুর মাঝে সীমাবদ্ধ থাকলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু যদি কোন ঔষধ কোম্পানির অনৈতিক কোন গিফ্ট বা উপঢৌকন চিকিৎসককে তার পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র প্রভাবিত করে কিংবা রোগী যদি চিকিৎসকের সিদ্ধান্তের কারণে কোন ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন, তা হলে তার এ ধরনের কর্মকান্ড পেশাদারী নৈতিকতাবোধের পরিপন্থী।

চিকিৎসক এবং ঔষধ কোম্পানির মাঝে পারস্পরিক সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিৎ তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোন নির্দেশনা না থাকায় এটা নিয়ে প্রায়শঃই বিতর্কের সৃষ্টি হচ্ছে।  বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে চিকিৎসকদের উপর ঔষধ কোম্পানির অনৈতিক প্রভাব ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।

ফলশ্রুতিতে সম্প্রতি ডিজিএইচএস হতে সপ্তাহে দু’দিন চিকিৎসকদের ভিজিট করার জন্য ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানির রিপ্রেজেনটেটিভদের অনুমতি দিয়েছে। এই আদেশের মাধ্যমে ঔষধ কোম্পানির সাথে চিকিৎসকদের যোগাযোগ সৃষ্টি হবে এবং চিকিৎসকরা ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানির নতুন নতুন প্রোডাক্ট বা ঔষধ সম্পর্কে জানতে পারবেন।

তবে এক্ষেত্রে ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানির রিপ্রেজেনটেটিভরা যাতে অল্প সময়ে বেশী চিকিৎসকের কাছে / দ্বার প্রান্তে পৌঁছাতে পারেন বিশেষ করে জেলা হাসপাতাল অথবা বিশেষায়িত হাসপাতাল কিংবা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সে জন্য  আমার পরামর্শ তুলে ধরছি।

সরকার কর্তৃক নির্ধারিত সময়ে এবং  দিনে মেডিকেল রিপ্রেজেনটিভরা ডাক্তারদের ডোর টু ডোর ভিজিট এর পরিবর্তে যদি একটি হল রুমে সেমিনার করে কোম্পানির প্রডাক্ট সম্পর্কে বর্ণনা করা হয় বা প্রমোশন করা হয় তা হলে সেটা অনেক বেশী সময় ও পরিশ্রম সাশ্রয়ী হবে বলে আমি মনে করি।

তবে, এই সেমিনারের জন্য কোম্পানিগুলো আগের থেকে সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সিডিউল নিতে হবে। প্রতি সপ্তাহে কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্ধারিত এক একদিন এক একটা কোম্পানি তার অডিও – ভিজুয়াল এইডস্ ব্যবহার করে তাদের প্রোডাক্ট প্রমোশন করবে। এক্ষেত্রে তাঁরা সেমিনার হলে পোস্টার, লিফলেট বিতরণ, ডিসপ্লে বোর্ডের ব্যবস্থাও করতে পারেন।

আশা করি, এ ধরনের পদক্ষেপ নিলে একদিকে চিকিৎসকরা যেমন নতুন নতুন ঔষধ সম্পর্কে আপডেটেড হবেন তেমনি ঔষধ কোম্পানি গুলোও সহজে অনেক চিকিৎসকের কাছে পৌঁছাতে পারবে। আর সেই সাথে অনেক বিতর্কের অবসান হবে বলে আমি মনে করি।

লেখা :ডা.আজাদ হাসান

সিওমেক-২১

প্ল্যাটফর্ম কনট্রিবিউটর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

নবনির্মিত ম্যাটস ভবনকে চিকিৎসকদের ট্রেনিং সেন্টার করার প্রক্রিয়া চলমান

Wed Oct 8 , 2025
বুধবার, ০৮ অক্টোবর, ২০২৫ টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলা সদরে চার বছর আগে নির্মিত সরকারি মেডিক্যাল অ্যাসিসটেন্ট ট্রেনিং স্কুলটিতে (ম্যাটস) শিক্ষা কার্যক্রম চালু না হওয়ায় ভবনকে চিকিৎসকদের ট্রেনিং সেন্টার করার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি অবিলম্বে চালুর দাবিতে গত সোমবার (০৬ অক্টোবর) ম্যাটসের প্রধান ফটকে এলাকাবাসী মানববন্ধন ও সমাবেশ করে এবং উপজেলা প্রশাসনের […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo