ধূমপান: কীভাবে কাজ করে?

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৮ জুন ২০২০, রবিবার

মঈনুল ইসলাম
চট্টগ্রাম মা-ও-শিশু হাসপাতাল মেডিকেল কলেজ

ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
ধূমপান কর্কট রোগের কারণ।

পৃথিবীতে শুধুমাত্র এই একটা জিনিস বা দ্রব্যের উপরেই লেখা থাকে, এই দ্রব্যটি খারাপ, এটা আপনার শরীরের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। তাও মানুষ সেই দ্রব্যটি দেদারসে কিনে খায়। ব্র‍্যান্ডিং এর জগতে কোনকিছুতে যদি “দ্রব্যটি খারাপ” লিখে বেচা যায়, তবে সেটা একটা জিনিসই, তা হলো সিগারেট। আপনি বাজার করতে গেলে নিশ্চয়ই ভুয়া দুই নাম্বার পণ্য কিংবা পচা মাছ মাংস কিনে বাসায় আসেন না! কিন্তু প্যাকেটে “স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর” লেখা দেখেও মনের আনন্দে “ধুর! কিছুই হবেনা” বলে মনকে বিশাল সান্তনা দিয়ে একটা সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে বাড়িতে চলে যান।

আসুন বায়োলজির ভাষায় দেখে আসি আমাদের শরীরে কী কী প্রভাব ফেলে এই সিগারেটঃ

১) সিগারেটের প্রতিটা টানে প্রায় পাঁচ হাজারের মতো রাসায়নিক বস্তু আপনার শরীরে প্রবেশ করে থাকে, যেটা পরবর্তীতে আপনার শরীরের কোষের সংস্পর্শে চলে যায়।
যেমন- “টার” নামক রাসায়নিক আপনার দাঁত ও মাড়িকে কালো বানিয়ে দেয়, তারপর দাঁতকে ভঙ্গুর করে দাঁতের এনামেলকে নষ্ট করে ফেলে।

২) সিগারেটের ধোঁয়া নাকে ও মুখে গিয়ে নাক-মুখের নার্ভগুলোর কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয় এবং ধীরে ধীরে নার্ভগুলো নষ্ট হয়ে যায়। ব্যাক্তি কোন কিছুরই ঘ্রাণ পায় না।

৩) সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হয় ফুসফুসে। যেহেতু সেখানে সরাসরি ক্ষতিকর ম্যাটেরিয়ালস গুলো চলে যায়, তাই শ্বাসতন্ত্রের রোগ যেমন- ব্রংকাইটিস, ইম্ফাইসেমা দেখা দেয়, ফুসফুসের প্রদাহ তৈরি হয়। এগুলো ঘটে শ্বাসনালীর সিলিয়াগুলোকে ধ্বংস করার মাধ্যমে। সিলিয়ার কাজ হলো আমাদের শ্বাসযন্ত্রকে পরিষ্কার রাখা, যাতে ধুলোবালি আমাদের ফুসফুসে চলে আসতে না পারে। কিন্তু সিলিয়াগুলো নষ্ট হবার কারণে বাহিরের ধুলোবালি সরাসরি ফুসফুসে চলে যেতে পারে সহজেই।

তারপরের ক্ষতিটা হয় ফুসফুসের ভেতরে থাকা লাখ লাখ এলভিওলি তে। এলভিওলি এর কাজ হলো আমরা যেই অক্সিজেনটা বাতাস থেকে নেই সেটা রক্তে দেয়া আর কার্বন-ডাইঅক্সাইড কে রক্ত থেকে নিয়ে বাহিরে বের করে দেয়া। কার্বন-মনোক্সাইড নামক বিষাক্ত গ্যাস সিগারেটের মাধ্যমে ফুসফুসে গিয়ে অক্সিজেনকে ফুসফুস থেকে রক্তে যেতে দেয়না এবং সে নিজে রক্তে চলে যায় হিমোগ্লোবিনের সাথে যুক্ত হয়ে। তাই ধূমপায়ী ব্যক্তিদের শরীরে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দিতে পারে, যেটা পরবর্তীতে শাসকষ্ট ঘটায়।

৪) ধূমপানের দশ সেকেন্ডের মাঝে রক্তের মাধ্যমে নিকোটিন চলে যায় ব্রেইনে, যেটা ব্রেইন থেকে ডোপামিন এবং অন্যান্য নিউরোট্রান্সমিটারকে মুক্ত করতে সাহায্য করে; যেমন- এনডরফিন। যেগুলো আমাদের শরীরে ভালো লাগার প্রকাশ ঘটায়, এতে মানবদেহ ধীরে ধীরে সিগারেটের প্রতি অতিরিক্ত নেশায় পতিত হয়।

৫) নিকটিন শরীরের রক্তনালীগুলোকে চিকন করে দেয় এবং রক্তনালীর কোষগুলোকে নষ্ট করতে থাকে। যার কারণে শরীরের রক্ত প্রবাহে ব্যাঘাত ঘটে। রক্তনালীগুলোর মাঝে প্লাটিলেট জমতে থাকে, ফলে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। এতে হার্ট এট্যাক এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

৬) সিগারেটের মাঝে থাকা অনেকগুলো রাসায়নিকই মারাত্নক মিউটেশন ঘটাতে পারে জিনের মধ্যে। বিশেষ করে আর্সেনিক এবং নিকেল বেশিরভাগ মিউটেশন ঘটায়। তারা ডিএনএ কে রিপেয়ার হতে দেয়না, এতে ক্যান্সার প্রতিরোধ করা শরীরের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। তিনভাগের একভাগ ক্যান্সার রোগীই প্রতিবছর মারা যাচ্ছে ধূমপানের কারণে। ধূমপান শুধুমাত্র ফুসফুসের ক্যান্সারেরই কারণ না; মানুষ ধূমপানের কারণে আক্রান্ত হচ্ছে-
মুখ, নাক, গলা, অন্ননালী, ব্লাডার, কিডনি, অগ্ন্যাশয়, উরেথ্রাল, ওভারিয়ান, লিভার ক্যান্সারে।

৭) ধূমপান চোখের দৃষ্টিশক্তিকে নষ্ট করে।

৮) ধূমপান হাড্ডিকে ভঙ্গুর করে তোলো।

৯) ধূমপায়ী মহিলাদের মা হবার সম্ভাবনা কমে যায় এবং সন্তানের ঝুঁকি দেখা দেয়।

১০) ধূমপান পুরুষদের ইরেক্টাইল ডিসফাংশন ঘটায়।

যখন আপনি ধীরে ধীরে ধূমপান ছেড়ে দিবেন, যে অবিশ্বাস্য পরিবর্তন গুলো আপনার শরীরে আসা শুরু হবে

১. ধূমপান ছেড়ে দেবার বিশ মিনিটের মাঝে আপনার হৃদস্পন্দন এবং রক্তচাপ স্বাভাবিক মাত্রায় নেমে আসবে।

২. ১২ ঘন্টা পর কার্বন-মনোক্সাইড এর লেভেল অনেকটা কমে আসবে এবং দেহে অক্সিজেনের লেভেল বাড়তে থাকবে।

৩. একদিন পর হার্ট এট্যাকের সম্ভাবনা কমে আসবে, যেভাবে রক্তচাপ স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিলো।

৪. দুই দিন পর মুখ ও নাকের নার্ভগুলো সতেজ হওয়া শুরু করবে এবং ব্যক্তি আবার ঘ্রাণশক্তি ফিরে পাবেন।

৫. ফুসফুস এক মাস পর সেরে ওঠা শুরু করবে, কাশি থাকলে সেটাও বন্ধ হয়ে যাবে।

৬. নয় মাসের মধ্যে সিলিয়াগুলো আবার জেগে উঠবে, আপনার ফুসফুসকে ইনফেকশনের হাত থেকে বাঁচাবে।

৭. এক বছর পর রক্তনালীগুলো আবার খুলে যাবে এবং রক্তপ্রবাহ স্বাভাবিকের দিকে মোড় নেবে।

৮. পাঁচ বছর পর আপনার স্ট্রোকের সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যাবে।

৯. দশ বছর পর ফুসফুসের ক্যান্সার এবং অন্যান্য ক্যান্সারে ভোগার সম্ভাবনা কমে যাবে। কারণ ডিএনএ রিপেয়ার হওয়া শুরু করবে তখন।

এইভাবে পয়েন্ট আকারে বলে যাওয়া যতোটা সহজ, ধূমপান ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা হয়তো ধূমপায়ী ব্যক্তিদের জন্য ততোটা সহজ নয়। প্রাথমিকভাবে ধূমপান ছেড়ে দিলে ডিপ্রেশন, দুশ্চিন্তা কাজ করতে পারে, তবে সেটা সাময়িক সময়ের জন্যই। এইসব ঘটে নিকোটিন উইতড্রোয়াল এর জন্য। কাউন্সেলিং এবং কগনিটিভ বিহেভিয়ারেল থেরাপি, কিছু এক্সেরসাইজ ধূমপানে পুনরায়ে জড়িয়ে পড়ার হাত থেকে রক্ষা করতে পারে।

Sayeda Alam

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

দেশে চিকিৎসকদের করোনা সংক্রমণের হার কেন এত বেশি? করণীয় কী?

Sun Jun 28 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৮ জুন, ২০২০, রবিবার ডাঃ ফাহমিদা রশীদ স্বাতি, সহকারী অধ্যাপক,প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ আমাদের দেশে ডাক্তাররা একপ্রকার ঢাল তলোয়ার ছাড়া যুদ্ধে নেমেছে। করোনার এই ভয়াবহ রূপ ধারণের কারণে ডাক্তাদের প্রায় অনেকাংশই আক্রান্ত হয়েছেন। কিন্তু এমন হলে তখন লক্ষ লক্ষ আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা কে দেবে? এভাবে […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo