কুসংস্কারচ্ছন্ন সমাজ- বিপাকে চিকিৎসা ব্যবস্থা

#Piles_of_Prejudice

১……

#ইনহেলারঃশেষ_চিকিৎসা

বিরক্তি চেপে প্রেসক্রিপশন লেখার চেষ্টা করছি, সমস্যা হলো বিরক্ত ভাবটা চেপে রাখা যাচ্ছে না, প্রকাশ হয়ে যাচ্ছে।সামনে যে লোক বসে আছে, সে ব্যাটা মহা ধাড়িবাজ টাইপের। একই সাথে মহাপন্ডিতও…..

লোকটি অ্যাজমার রোগী, আগের বার চিকিৎসাপত্রে ইনহেলার দিয়ে কাউন্সেলিংও করেছিলাম, কোনো লাভ হয় নাই, মুখে খাবার ঔষধগুলো খেলেও ইনহেলার তিনি নেন নাই।অথচ চেম্বারে ঢুকেই তার প্রথম কথা, “আপনের ওষুধে কোনো কাম হয় নাই…”

আমিঃ(বিরক্তি চেপে) ইনহেলার নেন নাই কেনো?

মহাপন্ডিতঃ গ্যাসের কথা বলতেছেন?গ্যাস নিমু না…

আমিঃআরেহ যন্ত্রণা! গ্যাসে সমস্যা কি?

মহাপন্ডিতঃ(উদাস হয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে)এইটা হাঁপানির শেষ চিকিৎসা, আমি শেষ চিকিৎসা নিমুনা….

২…..

#জন্ডিসঃহলুদ_চিকিৎসা

স্থানঃবনানী।Preetom এর বার্গার আর গ্রিলড্ স্যান্ডুইচ খেয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঢেঁকুর তুলছি।এমন সময় দুই বঙ্গ ললনার কথোপকথন কানে এলোঃ

১ম জনঃআন্টির জন্ডিস, তুই আমারে আগে বলবিনা!

২য় জনঃডাক্তার আঙ্কেল দেখছে আম্মুকে, কোনো ওষুধ তো দিলো না…

১ম জনঃআন্টিকে হাত ধোয়াইছিস?হলুদ পানি বের হয় যে….

২য় জনঃনারে, এখনো ধোয়াইনাই…

১ম জনঃ তোরা তো আসল চিকিৎসাই করাস নাই এখনপর্যন্ত..

‘অভিজাত পাড়ায় থাকলেই মানুষ মনমানসিকতায় অভিজাত হবে ‘–এ ভ্রান্ত ধারণা আমার আগেও ছিলোনা, এখোনো নেই, বঙ্গললনাদের কথাবার্তায় সেটা পরিবর্তনের সম্ভাবনাও ক্ষীণ…..

Aristocratic এরিয়ার কথা বাদ দেই, ম্যাঙ্গো পিপলদের জায়গা- “কামরাঙ্গীরচর”–সে এলাকার কথা বলি …

প্রতিদিন সকালে এক ভন্ড নিয়মিত অর্ধশত বা ততোধিক লোকের জন্ডিসের চিকিৎসা দেয়া শুরু করে।সে এক অদ্ভুত দৃশ্য……

২০ টাকা দিয়ে শরীর থেকে জন্ডিস নামানোর জন্য এইসব লোক সকাল থেকে সিরিয়াল দিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে।ভন্ড চিকিৎসক প্রত্যেককে নিজ হাতে গোসল করায়।গোসল শেষে যে বালতিতে গোসল করানো হয় তার পানি হলুদ হয়–সিরিয়ালে থাকা লোকগুলোর চোখ ‘হলুদ পানি’ দেখে আনন্দে চকচক করে ওঠে, সামনে এগিয়ে যাবার জন্য ঠেলাঠেলির জোর এরা আরো বাড়িয়ে দেয়…..

ভন্ড চিকিৎসক এসব দেখে গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলে ওঠেঃ” ঠেলাঠেলি কইরেন না, ঠেলাঠেলিতে ফায়দা নাই….”

৩….

#SteroidsঃThe_Magic

চেম্বারে এক ছিপছিপে তরুণ এলো, সামনে বিয়ে, তাই ওজন বাড়াতে চায়। এই স্ট্রাকচার নিয়ে বউয়ের সামনে গেলে কি আর মান-ইজ্জত থাকে!

কাউন্সেলিং করলাম যে– “মোটা হওয়া কোনো ভালো জিনিস না, মোটা দেহ হাইপ্রেসার আর ডায়াবেটিসের আখড়া।তাই যেমন আছেন তেমনই থাকেন….”

কথায় বলে, “উচিৎ কথার ভাত নাই”। আমার ভালো কথা উনার ভালো লাগে নাই।হোমিও চিকিৎসা চালালেন….

মাস ছয়েক পর আবার আমার চেম্বারে যখন ঢুকলেন তখন তার “ফুটবল” দশা।যে ওষুধ খেয়ে তার এই হস্তীরূপ, সে ওষুধ তিনি এখন ছাড়তে চাইলেও ওষুধ এখন তাকে ছাড়েনা। প্রেসক্রিপশনে Steroid induced Cushing’s Syndrome লিখে পরবর্তী স্টেপ নেয়া শুরু করলাম….

যারা চিকিৎসক নন, তাদের জন্য একটা তথ্য দেই।ওজন ও রুচি বাড়ানো , বাত ব্যাথা এবং হাঁপানির চিকিৎসায় দেশীয় কোয়াকরা হরহামেশা Steroid নামক এক কেমিক্যাল ব্যবহার করে।সাময়িক সময়ের জন্য এটি Magic এর মত কাজ করলেও এর লং টার্ম ইফেক্ট ভয়াবহ।আমরা অনেক সময় ভুলে যাই -Magic দেখতে ভালো লাগলেও সেটা আসলে সাময়িক Eye wash…..

৪….

#বাবুরাম_সাপুড়েঃ

ইমার্জেন্সী ডিউটিতে দায়িত্বরত ছিলাম।রাতবিরাতে সাপের কামড়ের এক রোগী এলো, সাথে জনা দশেক লোক।যে পায়ে সাপে কামড়েছে সে পায়ের অবস্থা ভীতিকর,লোকটিও যায় যায়…

আমিঃ ঘটনা কি? পায়ে কি সাপে কামড় দিছে না কুকুর? এমন ছেড়াবেড়া অবস্থা কেন?….

সাথের লোকঃ(নায়কোচিত কণ্ঠে)স্যার, কামড় দেয়ার লগে লগে ওই জায়গার মাংস খাবলায়ে তুইলা লাইছি।ওঝার কাছে নিছিলাম,বিষ কিছু কমায়া আপনের কাছে পাঠাইছে। বিষ যাতে শরীরে না ঢুকে তার লাইগা জায়গায় জায়গায় গিটও মারছি ….

আমিঃ ভালো করছেন, এবার কবরের মাটি টাও কাটেন গিয়া….

সাপে কামড়ের ব্যাপারে রুট লেভেলে শিখানো হয়–‘ হাতে কামড় দিলে হাত নাড়াবেন না, পায়ে কামড় দিলে হাঁটবেন না, গিট দেবার প্রয়োজন নেই এবং দ্রুত নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে যান’।

ঘটনা কখনোই এমন ঘটে না।যেটা ঘটে তা হলো–ইচ্ছামত শরীরের বিভিন্ন জায়গায় গিট দিয়ে গ্যাংগ্রিন তৈরি করা হয়, যে জায়গায় কামড়েছে সেখানকার মাংস তুলে ফেলা হয় এবং ডাক্তারের কাছে বা হাসপাতালে না গিয়ে ওঝার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়…..

যারা চিকিৎসক নন তাদের জানিয়ে রাখি–আমাদের দেশের বেশীর ভাগ সাপই অবিষাক্ত।কাজেই বেশীর ভাগ সাপের কামড়ে তেমন কিছুই হয় না।তথ্যটা ওঝা ব্যাটা ঠিকই জানে, জানে বিধায় সাপের কামড়ে আক্রান্ত লোককে ঝাড়ফুঁক করার রিস্কটা সে নেয়।ঝড়ে বক মরে, ওদিকে ওঝার কেরামতি আর খ্যাতি বাড়ে……

৫….

#স্যন্ডেল_ট্রিটমেন্টঃ

মতিঝিল দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি।একটা জটলা দেখে আড়চোখে তাকিয়ে চলে যেতে চাচ্ছিলাম।আড়চোখে Fraction of Second এ দেখে যা বুঝলাম, তা দেখে জটলাকে আর অগ্রাহ্য করতে পারলাম না….

এক লোককে ধুমায়ে স্যান্ডেল দিয়ে পেটানো হচ্ছে।লোকটির খিঁচুনী চলছিলো।আমি জটলায় ঢুকে রোগীকে উদ্ধার করতে করতে আরেক উৎসাহী বান্দা চিৎকার করে বলে উঠলোঃ “আরে, এইডা তো খিচুনী রোগ, স্যান্ডেলডা নাকে দেন, স্যান্ডেলের গন্ধ পাইলেই খিঁচুনী শেষ…..”

Helpful বাঙালি জাতি বলে কথা! লোকটি কথা শেষ করতে না করতেই আরেক সাহায্যকারী ছাগলা লোকটির নাকে তার স্যান্ডেল ঠেসে ধরলো।খিঁচুনী আর স্যান্ডেলের বাড়িতে এমনেই লোকটির ত্রাহিত্রাহি দশা, নাকে স্যান্ডেল ঠেসে ধরায় এবার জীবনটাও যায় যায়….

৬…..

এদেশের চিকিৎসাজগতে যে বহুল প্রচলিত কুসংস্কার ও অনিয়মগুলো দেখি তার থেকে মাত্র পাঁচটি ঘটনার কথা বললাম।আরো বলতে পারি, সেগুলো পরবর্তী সময়ের জন্য তোলা থাকুক।আপাতত এই পাঁচটি Prejudice নিয়েই থাকি, এই পাঁচটি Prejudice কেও যদি এই দেশ থেকে উধাও করে দেয়া যায়–সেটাও তো কম না…..

কোথায় যেন পড়েছিলাম-‘ প্রত্যেক চিকিৎসক একেকজন সমাজ সংস্কারক, একেকজন সেলিব্রেটি’।আমাদের দেশে এত ডাক্তার থাকতে এসব অনিয়ম ও কুসংস্কারগুলো কিভাবে চলে? আমরা আমাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছি তো? দেশের এই অনিয়ম ও কুসংস্কারের বেড়াজাল যদি আমরা ছিন্নভিন্ন করতেই না পারি, তবে আমরা কিসের সেলিব্রেটি?

৭….

কলেবর বৃদ্ধি পাচ্ছে, ইতি টানি…..

গত বছর সকালে পেপারে খবর পড়ছিলাম–‘১০ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে মহাকাশ বিজ্ঞানীরা নাকি নতুন Galaxy Cluster খুঁজে পেয়েছেন।নাম দিয়েছেন IDCS-1426…. দুঃখের কথা কি আর বলবো–ঐ একই দিন বিকেলে খোদ ঢাকা শহরে আমার সামনে খিঁচুনীর রোগীকে জনতা জুতা দিয়ে পিটিয়েছে তাকে সুস্থ করার বাসনায়….

এই পৃথিবীর এক প্রান্তে যখন কোয়ার্ক নামক সাব এটমিক পার্টিকেলের বিহেভিয়ার নিয়ে ইকুয়েশন তৈরি হয়, তখন এদেশের লোক সাপের কামড়ের চিকিৎসায় ওঝাকে খুঁজে বেড়ায়।বিশ্বের তাবৎ ঘাঘু ম্যাথমেটিশিয়ানরা যখন নতুন Prime number ডিসকাভার করে আনন্দে উদ্বেলিত হয়, আমরা তখন জন্ডিসের সময় শরীর ধুইয়ে হলুদ পানি ফোঁটায় ফোঁটায় পড়তে দেখে মিথ্যা আনন্দে আত্মহারা হই।বিশ্বের অন্যপ্রান্তে যখন Nanorobot দিয়ে ধমনীর জঞ্জালকে পরিস্কার করার Live demonstration চলে, আমার দেশের লোক তখন অ্যাজমার চিকিৎসায় ইনহেলার নেয়াকে ‘শেষ চিকিৎসা’ বলে ভ্রম করে। মিথকে এরা অন্ধবিশ্বাসের মত আঁকড়ে ধরে রাখে, অন্তরে সেটা লালন করে।জ্ঞান বিজ্ঞানের উৎকর্ষতায় বিশ্ব আগায়, আমার দেশের লোক Piles of Prejudice রচনা করে।আমি এই দুঃখ কোথায় রাখি?.

লিখেছেনঃ ডা. জামান অ্যালেক্স

drferdous

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

গত বছর অর্থোপেডিক সার্জারি বিভাগ, বিএসএমএমইউ -এ লক্ষাধিক রোগী সেবা নিয়েছে

Tue Mar 28 , 2017
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে হ্যান্ড এ্যান্ড রিকন্সট্রাক্টিভ সার্জারি উইং-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তথ্য প্রকাশ, ২০১৬ সালে অর্থোপেডিক সার্জারি বিভাগে লক্ষাধিক রোগী সেবা নিয়েছেন, রোগীর সংখ্যা বেড়েছে ২৬০ শতাংশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থোপেডিক সার্জারি বহির্বিভাগে গত ৫ বছরে ২৬০ শতাংশ রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। অপারেশনের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ১৯০ […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo